KABYAPOT.COMধারাবাহিকপ্রবন্ধ

প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (তৃতীয় পর্ব) ✍️ শৌভিক

Spread the love

প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (তৃতীয় পর্ব)

✍️ শৌভিক

ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি ঠাকুর –

ভিন্নধর্মী মানুষের সাথে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল চিরকালীন সুসম্পর্ক । তিনি এদের সুখ-দুঃখের অংশভাগী হয়েছেন বেশ কয়েকরার। সে সময় দক্ষিণেশ্বের মন্দিরের খুব কাছেই ছিল মুসলিম পাড়া। আব্দুল শেখ আর তার যমজ ভাই বরকত শেখ ছিলেন ঠাকুরের স্নেহধন্য। আব্দুল কামারহাটি জুটমিলের কর্মচারী ছিলে। কিছু কাল আগে তার দুই মেয়েই মারা গেছে। সবেধন একমাত্র ছোটো ছেলের সেই সময় মরণাপন্ন অবস্থা। ডাক্তার কবিরাজরা হাত তুলে দিয়েছেন। আর কোনো সুরাহার আশা না দেখতে পেয়ে আব্দুল এসে পড়লেন ঠাকুরের চরণে – তার কান্না আর আকুতি ঠাকুরের কাছে, ” আমার ছেলেটিকে বাঁচাও গো ঠাকুর, তুমিই পারো বাঁচাতে, ডাক্তার – বৈদ্য যে জবাব দিয়ে চলে গেল !” অপার করুনাময় ঠাকুর, মা ভবতারিণীর প্রসাদী বেলপাতা দিলেন আব্দুলের ছেলের আরগ্য কামনা করে, বললেন, ছেলের মাথায় এই বেলপাতা ছুঁইয়ে দিতে কিন্তু দিশেহারা অশান্ত আব্দুলের মন শান্ত হল না তাতেও। তাঁর বিশ্বাস, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তার বাড়ি গিয়ে ছেলেটিকে আশীর্বাদ করলে তবেই তার ছেলে বাঁচবে। চরম আবেগ আর ব্যাকুলতা নিয়ে বারবার এই অনুরোধ করে চলেছেন তিনি ঠাকুরকে করজোড়ে। আর ঠাকুর রাজী হচ্ছেন না। শেষমেশ সে বলে বসলো, ” আমি মুসলমান বলে আমার কুটিরে যেতে  আপনার আপত্তি !” আব্দুলের কাথা শুনে, ঠাকুর লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “ল্যাংটার আবার বাটপারের ভয় ? আমি সাধু আমার আবার জাত বিচার ? ”

এর পরের ঘটনা অলৌকিক ভিন্ন অন্য কিছু নয়, ঠাকুর আব্দুলের বাড়ি গিয়ে তার মরণাপন্ন শিশু পুত্রের কপাল স্পর্শ করলেন এবং মা ভবতারিণীর চরণস্পর্শী বেলপাতা নিজে হাতে বুলিয়ে দিলেন। এর কয়েক দিন পর থেকে ধীরে ধীরে শিশুটি সুস্থ হয়ে উঠল। আব্দুল এবং তাঁর পরিবার মুসলমান ধর্মী হলেও ঠাকুরের কৃপায় ছেলের জীবন ফিরে পেয়ে পরবর্তীতে ঠাকুরকেই সয়ং আলহা পয়গম্বর রূপে ভক্তি করতেন তাঁরা।

আরো একটা ঘটনা, ডাক্তার ওয়াজীজ সাহেব ছিলেন ঠাকুরের পরম ভক্ত রামচন্দ্র দত্তের বন্ধু। সেই সূত্রে ডাঃ ওয়াজীজের , রামচন্দ্রের  সঙ্গে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বন্ধু আব্বাস আলী কে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে আসেন পরমহংস দেবকে দর্শন করার জন্য কিন্তু মুসলমানী নিয়ম অনুযায়ী সেলাম করার মনোবাসনা থাকলেও তিনি ও তাঁর ডেপুটি ম্যাজিসট্রেট বন্ধু ঠাকুর কে দেখে ভাব বিহ্বলিত হয়ে, ঠাকুরের পা স্পর্শ করে প্রণাম করেন।

ওয়াজীজ সাহেব আর তাঁর বন্ধু বসেছেন একদিকে। অন্যদিকে ঠাকুর। ওয়াজীজ সাহেব মনে মনে ভাবছেন, ইনি হিন্দু সাধু কিন্তু তাঁরা মুসলমান বলে হয়তো স্পর্শ বাঁচিয়ে দূরে বসেছেন।

সেই মুহূর্তেই ঘটে গেল প্রায় অলৌকিক ঘটনা ! ঠাকুর হঠাৎ নিজের আসন থেকে উঠে গিয়ে ওয়াজীজ সাহেব ও তাঁর বন্ধুর কম্বলাসনে গিয়ে বসে পড়লেন। তারপর তাঁদের মাথায় রাখলেন তাঁর স্নেহস্পর্শ। ডাঃ ওয়াজীজ সাহেব এই প্রসঙ্গে পরে বলে ছিলেন, “আমাদের মুসলমান ধর্মে, পয়গম্বরের যে সমস্ত লক্ষণ বলা আছে, তাঁহাকে দেখিয়া, তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া তাঁহাকে আমাদের পয়গম্বর বলিয়াই জ্ঞান হইয়াছিল।”

চিড়িয়াখানা দর্শন –

এশিয়া মহাদেশের বৃহৎ এবং প্রাচীনতম চিড়িয়াখানা গুলির অন্যতম হল – কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানা। কখনও বাঘ সিংহের মিলন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ এক নতুন প্রানী সৃষ্টি করা, কখনও মার্মসেইত চুরি হয়ে যাওয়া, আবার কখনো শিবা নামক বাঘের মানুষ খেয়ে ফেলা, এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পৃথিবীর প্রাচীনতম কচ্ছপটিও এখানেই ছিল। বহুল বিচিত্র ঘটনার ইতিহাস বহন করে চলেছে এই সুপ্রাচীন পশুশালাটি। মহানগরী কলকাতার এই গর্বের স্থান টি দর্শন করে গিয়েছেন দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত মানুষ আগামী দিনেও বহু ব্যক্তিত্ব আসবেন নিশ্চিত কিন্তু ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আলিপুর চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখার কাহিনী আজও খুব কম মানুষই জানেন।

কথামৃত গ্রন্থে সেই দিনের ঘটনার বর্ননা রয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, ঠাকুর আলিপুর পশুশালার কথা শুনেছিলেন ভক্তদের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে, ঠাকুরের ছিল আজীবন বালক স্বভাব। দক্ষিণেশ্বরে তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়কে শহরের নতুন আকর্ষণের স্থল চিড়িয়াখানা দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ঠাকুরের কথা ফেলতে পারেননি শাস্ত্রী মহাশয়। এদিকে তাঁর একটি জরুরি কাজও ছিল। অনেক ভাবনাচিন্তার পর তিনি স্থির করেন পরমহংসদেবকে তাঁর গাড়ি করে কিছুটা পথ এগিয়ে দেবেন। এরপরের দায়িত্ব শিষ্য নরেনের এবং সেই ব্যবস্থা মত পশুশালা দর্শনের দিন কলকাতার সুকিয়া স্ট্রীট পর্যন্ত ঠাকুরকে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় এবং পরের পথ টুকু তাঁকে ওই গাড়ি করেই আলিপুরের চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসেন নরেন। ইংরেজ সাহেবদের তৈরী কলকাতার এই চিড়িয়াখানার বয়স তখন মাত্র দশ বছর৷ ১৮৮৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি শীতের হিমেল সকালে ঠাকুরের পদধূলি পড়েছিল আলিপুর চিড়িয়াখানায়।

পশুশালায় প্রবেশের পর ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ, মহামায়া দেবী দুর্গার বাহন সোনালী কেশরের পশুরাজ সিংহের দিকে তাকিয়ে, ‘‘সিংহ জগজ্জননীর দেবী দুর্গার বাহন’’, এই কথা উচ্চারণ করতে করতে ভাব সমাধিস্থ হয়ে পড়েন। সেদিন তিনি আর কোনও পশু দেখেন নি। দেবীর বাহন সিংহ দেখেই তিনি বিহ্বল হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ঠাকুর নিজে তাঁর চিড়িয়াখানা দর্শনের কথা শুনিয়ে ছিলেন দক্ষিনেশ্বরের ভক্তদের – “চিড়িয়াখানা দেখতে লয়ে গিছলো। সিংহ দর্শন করেই আমি সমাধিস্থ হয়ে গেলুম। ঈশ্বরীর বাহনকে দেখে ঈশ্বরীর উদ্দীপন হল – তখন আর অন্য জানোয়ার কে দেখে। সিংহ দেখেই ফিরে এলুম।”

আজও যদি কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় কেউ সিংহের খাঁচার কাছে যান, তা হলে খাঁচার বাঁদিকে বড় বড় হরফে লেখা স্মৃতিফলকে এই কাহিনী পড়ে দেখতে পারেন। বেশ কয়েক বছর আগে চিড়িয়াখানা আধুনিকীকরণের সময় এই ফলক টি বসানো হয়।

 

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

উদ্বোধন পুস্তক ও পত্রিকা –

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ

স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ।

স্বামী বিশ্বনাথানন্দ মহারাজ

স্বামী ভূমানন্দ মহারাজ

শ্রী মহেন্দ্রলাল গুপ্ত

শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নূপূর বন্দ্যোপাধ্যায়

কৃষ্ণ কুমার দাস

নিউজ এইটটিন বাংলা

সংবাদ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *