প্রবন্ধ
শিরোনাম ::—শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর সম্বন্ধে দু চার কথা
কলমে ::—দেবকী নন্দনা আচার্য
বড়জোড়া, বাঁকুড়া ।
শিশু সাহিত্যের কথা উঠলেই “ উপেন্দ্রকিশোরের” নাম সর্বাগ্রে চলে আসে। উপেন্দ্রকিশোর বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ রায় পরিবারে ১৮৬৩ সালের ১১ই মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্যামসুন্দর রায় ও মাতা জয়তারা দেবী । খুব ছোটবেলায় উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদা রঞ্জন রায়। চার পাঁচ বছর বয়সে তার এক দুঃসম্পর্কের কাকা হরি কিশোর রায় চৌধুরী তাকে দত্তক গ্রহণ করার পর তার পদবী পাল্টে হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ,পরে রায় পদবী বলবত হয়। উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র কন্যা সুকুমার রায় ও লীলা বতি। সুকুমারের পুত্রের নাম সত্যজিৎ রায় এভাবেই চলে আসছে ।
ছোটবেলা থেকে তিনি গান গাইতেন, গান রচনা করতেন, বেহালা বাজাতেন ,ছবি আঁকতেন, কবিতাও গল্প লিখতেন। সব থেকে বেশি লিখেছেন শিশু-কিশোরদের জন্য। সেই সব লেখা খুব জনপ্রিয় এবং কালজয়ী । তাঁর সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য নিজের লেখার সাথে নিজের আঁকা ছবি । সেই ছবি আজ পর্যন্ত সমান আদরনীয়।
এখানেই শেষ নয়, তিনি স্ক্রীন অ্যাডজাস্টার আবিষ্কার করেন যার ফলে ক্যামেরার স্ক্রিনকে যান্ত্রিক উপায়ে ক্যামেরার ঠিক জায়গায় ঠিক ভাবে রাখা অনেক সহজ হয়েছে ।এক রঙের আর নানা রঙের ছবি ছাপানো অনেক উন্নতি হয়েছে। ইউরোপে তার আবিষ্কার গুলোর খুব সুখ্যাতি হয়েছিল। পেনরোজ আ্যসুয়াল পত্রিকায় আবিষ্কার গুলোর বিবরণ ছাপা হয়েছিল। তিনি ডুয়োটাইপ আর রে টিল্ট প্রণালীও উদ্ভাবন করেন।
লেখা ছাপানোর অনেক অসুবিধা ছিল উপেন্দ্রকিশোর সেই হাফটোন ব্লকের ছবি পরিষ্কার ও মোলায়েম করে ছাপার উপায় আবিষ্কার করেন।
এবার উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আলোচনায় আসি। মূলত যে যে বিষয়ের উপর তিনি খ্যাতি লাভ করে ছিলেন তা হলো——
১) টুনটুনির বই ( ২৬ টি গল্প আছে )
২) গল্পমালাতে ( ৩৭ টি গল্প আছে )
৩) বিভিন্ন প্রবন্ধ তে ( ৭৭ টি প্রবন্ধ আছে )
৪) ছোটদের রামায়ণের ( ৬ টি কান্ড আছে)
৫) মহাভারতের কথা ( ৫৮ টি গল্প আছে)
৬) পুরানের গল্পে ( ২৬ টি গল্প আছে)
৭) ছেলেদের রামায়ণের ( ৬ টি কান্ড আছে)
৮) ছেলেদের মহাভারতে ( ১৮টি পর্ব আছে)
৯) কবিতা ও গান ( ২০ খানা আছে )
সমস্ত গল্প এক একটি ধরে বিচার-বিশ্লেষণ করে লেখা সম্ভব নয় ।কারণ আয়তনে ছোট পত্রিকায় ও অবানিজ্যিক পত্রিকায় স্থান সংকুলান হওয়া মোটেই সম্ভব নয় ।
গল্পমালাতে ৩৭টি গল্পই সুখ পাঠ্যকর।আমার দৃঢ় বিশ্বাস যদি শিশুদের “সাতমার পালোয়ান”” দুষ্টু দানব “ “ঘ্যাঁঘ্যাসুর” “ঝানু চোর চানু “ ”জোলা আর সাত ভূত” প্রভৃতি গল্পগুলি রশিয়ে বলা হয় তাহলে শিশুরা টিভির কার্টুন ছেড়ে মোবাইল ছেড়ে হাঁ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনবে।
সবথেকে বড় কথা সমস্ত গল্পে যত ছবি আছে সব উপেন্দ্রকিশোরের আঁকা ।
বিবিধ প্রবন্ধ লেখার সময় উপেন্দ্রকিশোর বলেছেন শিশুরা জানোয়ারের গল্প শুনে আমাদ পায়। তাই এই বিবিধ প্রবন্ধে শতাধিক জন্তু জানোয়ার, কিট পতঙ্গের প্রবন্ধ লিখেছেন শিশুদের সাথে পরিচয় ঘটাবার জন্য ।এই বইতে ১৭ টি বড় ছবি আছে যা সম্পূর্ণ মৌলিক ও প্রবন্ধ কারের আঁকা।
সেই প্রবন্ধকার লিখলেন ছোটদের রামায়ণ এতে ছটি কান্ড । সহজ সরল ভাষায় কখনো দ্বিপদী, কখনো ত্রিপদী কখনো মহাপয়ার। নানাভাবে ছন্দকে নিয়ে খেলা করে রচনা করেছেন স্বচ্ছন্দ গতিতে ।
প্রথমেই লিখলেন —-” বাল্মিকির তপোবনে তমসার তীরে/ ছায়া তারা মধুময় বায়ুবহে ধীরে /সুখে পাখি গান গায় গান/ ঠোঁটে কত ফুল /কিবা জল নির্মল/ করে কুল কুল——-”
আদি কাণ্ডে কিছুটা লিখে ছন্দ পরিবর্তন করলেন যেমন :——
“ মনে রাখিলেন নাম বড় ছেলে হলো রাম মাতা হন কৌশল্যা যাহার
কৈকেয়ী রানীর ঘরে জন্ম যে তাহার পরে
ভরত হইল তার নাম —–”
লংকা কান্ডে আবার ছন্দ পরিবর্তন—-
“ তারপর মিলিয়া সকলে
লঙ্কায় চলিল দলে দলে
গনিয়া না হয় শেষ ধুলায় ছাইলো দেশ আকাশ ফাটিল কোলাহলে।
মহাভারতের কথা গদ্যে লিখলেন ।মহাভারতের কাহিনী নয়, এক একটি চরিত্র ঘটনার কথা যা পড়লে খুবই জ্ঞান লাভ হয়।
পুরানের গল্পও তাই গদ্যে, সহজ সরল ভাষায় সংস্কৃত মিশ্রণ বর্জন করে নিজের ধাচে নিজের ঢঙ্গে লিখলেন।এইসব লেখাতেও শিশু মনস্ততার পরিচয় সুস্পষ্ট।এই কাহিনী শুনতে তখন থেকে এখনো পর্যন্ত ছোট বড় সমান আগ্রহী।
ছোট্ট রামায়ণ কবিতার ছলে লিখে মন ভরেনি। তাই তিনি রামায়ণের কাহিনী থেকে ছটি কান্ডে লিখলেন নাম দিলেন ছোটদের রামায়ণ সহজ
সাধু ভাষায় কেবল আসিবেন যাইবেন খাইবেন এইভাবে সাধু ভাষা দিয়ে লিখলেন। এতে কাহিনীর মাধুর্য আরও একটু মাত্রা পেলো।
মহাভারতের কথা মহাভারতের কাহিনী রূপ নয় কিছু চরিত্রের ও ঘটনার রূপ ছিল এই লেখাতে। উপেন্দ্রকিশোর এর মন ভরলো না তাই তিনি মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে খুব সংক্ষেপে সহজ-সরল আটপৌড়ে সাধু ভাষায় ১৮টি পর্বে ছেলেদের মহাভারত লিখলেন
কবিতা ও গান কাহিনী ভিত্তিক। যেমন :-”ঘোড়া চেপে কমলা নাপিত যাচ্ছে তাড়াতাড়ি/ রাত না হতেই কোনমতে ফিরতে হবে বাড়ি/ বন জঙ্গল পেরিয়ে যেতেই সন্ধ্যা হল অতীত, /বনের পাশের গাঁয়ে গিয়ে রাত্রে হল অতিথ —-”( কমলা নাপিত)
সর্বশেষে আমি সর্ব প্রথমের কথা যার নাম টুনটুনির বই পুস্তক মানে বই যে কালেই রচনা হোক না কেন তার সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক, আর্থিক প্রেক্ষাপট একটা থাকেই।
তার ছায়া লেখাতে থাকবেই তাই সে যতটুকুই হোক । আমরা জানি চর্যাপদের কথা। সেই ছোট ছোট কবিতায় যদি সমাজের সংসারের অর্থের কথা ও চিত্রপট থাকে তাহলে এতে তো থাকবেই।
উপেন্দ্রকিশোর গল্পের ছলে কি সুন্দর রচনা শৈলী দ্বারা গল্পের বাঁধুনির দ্বারা সুখ পাঠ্যকর করে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কেবল পাঠক মহলকে খুঁজে নিতে হবে। আমি জানি সবাই খুঁজে নিয়েছেন তবুও যেহেতু আমি উপেন্দ্রকিশোর সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখছি তাই আলোচনা করছি।
“টুনটুনি আর বিড়ালের কথা” পাঠক মহল দেখুনতো ভেবে একজন অসহায় মা তার সন্তানদের দুষ্টু বিড়ালের হাত থেকে কেমন করে রক্ষা করলো। শেষে টুনটুনির ছানারা যখন উড়তে পারলো এবং উড়ে তাল গাছে গিয়ে বসলো বেগুন গাছ ছেড়ে তখন মা টুনটুনি বেড়ালকে আর তোষামোদ নয় এক লাথ দিয়ে উড়ে গেলো।
টুনটুনি বিড়ালের গল্প কি শুধু গল্প এতে কি সমাজচিত্র নেই! অসহায় মানুষেরা কি সবলের দ্বারা শোষিত হচ্ছে না ! বুদ্ধি নিয়ে বাঁচার নামেই জীবন, বেঁচে থাকার নামই জীবন।
আবার “টুনটুনি আর নাপিতের কথা” গল্পে দেখুন ছোট্ট টুনটুনির ফোঁড়া নাপিত কেটে দিলো না ।কারণ সে যে উঁচু মহলের লোক রাজার চুল দাঁড়ি কাটে। টুনটুনি নিরুপায় হয়ে রাজাকে বললো, কাজ হল না। ইন্দুর কে বললো কাজ হলো না । বিড়াল ,লাঠি, আগুন, সাগর সবাইকে বললো কিন্তু কেউ কাজ করে দিলো না। মশা খুবই ক্ষুদ্র জীব সে রাজি হলো। তারা একত্রিত হয়ে হাতিকে বশীভূত করলো। হাতি সাগরকে, সাগর আগুনকে, এইভাবে রাজা হয়ে নাপিত পর্যন্ত পৌঁছালো এবং টুনটুনির ফোঁড়া ছেদন হলো।
আজকাল তো আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল গুলিতে চিকিৎসার হাল। যদি ভালো চিকিৎসা নিতে চাও তাহলে লবি চাই। পার্টির দাদারা বা পরিচিত হাসপাতালের স্টাফ বা উচ্চপদস্থ কেউ। কিন্তু যখন খেতে না পাওয়া জনগণ জাগে শোষিত সর্বহারারা জাগে, ভেঙ্গে গুড়িয়ে তছনছ করে দেয় সব, তখন কাজ হয় । সাধারণ গরিব মানুষ সুস্থ পরিষেবা পায়। আজ থেকে প্রায় ১৬২
বছর আগে এই চিত্র বর্ণনা করে গেছেন যা এখন সর্বদায় সর্বত্র হচ্ছে।
“ টুনটুনি আর রাজার কথা “ এখানেও তাই সবলের দ্বারা দুর্বলরা শোষিত হচ্ছে। “—- এ জগতে হায় সেই বেশি চায়/ আছে যার ভুরি ভুরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত /কাঙালের ধন চুরি—–”।
ক্ষমতাবানদেরও সাজা হয়। এমন সাজা যে– “ —নাক কাটা রাজারে দেখত কেমন সাজারে–”, লোকসমাজে মুখ দেখাতে পারে না, তবুও শোষিত শোষক রাজ চলছে গড্ডলিকা প্রবাহের মতো। সমস্ত গল্পগুলি আরো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি কিন্তু তাতে করে পাতার সংখ্যা বেড়ে যাবে।
নরহরি দাস এতেও একটা নিরীহ ছাগল ধূর্ত শৃগাল ও বাঘকে কেমন করে নাস্তানাবুদ করলো তার কাহিনী। এখানেও বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ। সমস্যায় পড়ে নার্ভাস হলে চলে না মানে মরার আগে মরলে চলবে না ।
“ বাঘ মামা আর শিয়াল ভাগ্নে “বহুবল,পেশিবল থাকলেই সব জয় হয় না। মেধা, বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ এখানে তারই ছাপ আর একবার পেলাম। সমস্ত গল্পে বুদ্ধির জয় ঘটেছে ।
দূরদৃষ্টি সম্পন্ন উপেন্দ্রকিশোর ,শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর, চিত্রকার উপেন্দ্রকিশোর, স্ক্রীন অ্যাডজাস্টার উপেন্দ্রকিশোর, ছাপার অসুবিধা দূর করা উপেন্দ্রকিশোর ১৯১৫ সালের ২০ শে ডিসেম্বর তার সমস্ত সৃষ্টি দান করে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন।
তথ্যসূত্র ::—উপেন্দ্রকিশোর রচনা সমগ্র ।
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice
[…] শিশুর চাবি… বিশ্বনাথ সাহা […]
[…] আরও পড়ুন:-ভ্রমণ পিয়াসী : বিশ্বনাথ সাহা […]