KABYAPOT.COMকাছে পিঠেভ্রমণ কাহিনী

গড়পঞ্চকোট ভ্রমণ ও একদিনের ট্রিপ –<<কলমে রাজকুমার সরকার

Spread the love

গড়পঞ্চকোটে একদিন

*****************

ভ্রমণ গদ্য

রাজকুমার সরকার


 

ছেলের ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।ছেলের দাবি-বাবা,আমার সব বন্ধুরা ঘুরতে যাচ্ছে কেউ মামার বাড়ি, কেউ মাসির বাড়ি, কেউ অন্য কোথাও। তুমি আমাকে ঘোরাতে নিয়ে যাবে না???

একদিন বাদ বাদ বলতেই থাকে।আমি দেখলাম এই প্রখর রৌদ্রে বেশি দূরে যাওয়া কষ্টকর তাই একদিন বললাম- চলো, তাহলে ঘুরে আসি গড়পঞ্চকোট। ছেলে আনন্দে রাজি হয়ে গেল।ওর মা’ও সম্মতি দিল।মার্চ মাসের একদিন সকাল ৬.৪০ এ মোটরসাইকেল স্টার্ট করলাম। বাড়ি [মোকো, বেলিয়াপুর, ধানবাদ] থেকে বের হয়ে দুধিয়া মোড়,শালুকচাপড়া,কেলিয়াশোল হয়ে পাতলাবাড়ি।সেখান থেকে ডানদিকে পুরুলিয়ামুখী রাস্তায় চলতে শুরু করলাম। তিন কিলোমিটার পর পাঞ্চেত ড্যাম পার করে সোজা গিয়ে থামলাম পুয়াপুর-এ।এ প্রসঙ্গে এক কথা জানিয়ে রাখি,পুয়াপুর’কে ঝাড়খণ্ডের লোকেরা বলে থাকে গড়পঞ্চকোটের প্রবেশ দ্বার। সেখানে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুললাম পঞ্চকোট পাহাড়ের। স্থানীয়দের ভাষায় পাঁচুত পাহাড়।সকাল বেলায় সূর্য কিরণে ছবি ঝকঝকে;তকতকে।ডানদিকে পুয়াপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে চলতে লাগলাম। পুয়াপুর গ্রামটা ঠিক শেষ করেই বাঁদিকে একটি রিসর্ট চোখে এলো।তারপরই পর পর আরও দুটো রিসর্ট বাঁদিকে ও ডানদিকে নজরে এলো। কিছুদূর যাওয়ার পর নজরে এলো গড়পঞ্চকোট প্রকৃতি ভ্রমণ কেন্দ্র। বাঁদিকে বন দফতরের একটি রিসর্ট। ডানদিকে আরও একটি রিসর্ট নাম মনে পড়ছে না;ভুলে গেলাম। বাঁদিকে পঞ্চকোট পাহাড়ের ধারে ধারে জঙ্গলের নির্জন রাস্তায় গাড়ি ছুটতে লাগলো।চোখভরে সবুজ দেখতে দেখতে গাড়ি চালাতে লাগলাম।একসময় পৌঁছে গেলাম লক্ষ্মণপুর।সেখানে দেখলাম লক্ষ্মণপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এখানে দামোদর নদের জলকে পরিশুদ্ধ করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সাপ্লাই করা হচ্ছে।রাস্তার ধারে মোটা মোটা পাইপে জল যায়।কিছু কিছু জায়গায় পাইপ ফাটা।জল পড়ছে ছিরছির করে।জলের অপচয়।কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে গেছে।সেটা দেখা আমাদের কাজ নয়।আমরা তারিয়ে তারিয়ে সবুজ দেখতে দেখতে ছুটে চলেছি।এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখছি যদি গাড়ি খারাপ হয়ে এই রাস্তায় তাহলে মহাসমস্যা।এখানে ধারে কাছে কোন গাড়ি সার্ভিসিং এর দোকান বা মিস্ত্রী পাওয়া যাবে না বা নেই। তাই মনে মনে অদৃশ্যমান ঠাকুরকে স্মরণ করতে করতেই এগিয়ে যাওয়া……

রামপুর,পাহাড়গোড়া,কচবেল কি সুন্দর সুন্দর নাম ছোট ছোট জনপদগুলির….

যেতে যেতে ডানদিকে একটি ছোট্ট ছিমছাম রিসর্ট দেখতে পেলাম। দেখে মনটা ভালো লাগলো খুব।

 

অদূরেই ডানদিকে একটি রিসর্ট নজরে এলো।বিশাল এলাকাজুড়ে।খুব সুন্দর। রিসর্টের ঠিক ডানদিকে বসে থাকা একটি বিরাট বড় নীল রঙের শিবঠাকুর দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল।পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য এই অভিনব উদ্যোগ নিয়েছেন রিসর্ট কর্তৃপক্ষ সহজেই বোঝা যায়।তারপর যেতে যেতে একসময় পৌঁছে গেলাম নিতুরিয়া ব্লক অফিস। ব্লক অফিসের পাশেই সেল্ফি পয়েন্ট নজরে এলো।ছেলের নজর তীক্ষ্ণ।বাবা,দাঁড়াও।

কি হোলো?

থেমে দেখি সুন্দর একটি সেল্ফি পয়েন্ট ডানদিকে।সেখানে থেমে ও গাড়ি থেকে নেমে ঝিকঝাক ঝিকঝাক।নজরে এলো ছবির মত একটি থাকার ঠিকানা- “অরণ্যের দিনরাত্রি” ।এখানে পর্যটকরা থাকতে পারেন। অবশেষে গোবাগ পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে আটটা।ছেলে বললো,বাবা কচরি খাব।সেখানে কচরি,চা ইত্যাদি খেতে খেতেই দোকানদার সাধন মিত্রের কাছে জেনে নিলাম গড়পঞ্চকোট যাওয়ার শটকার্ট রুট।

 

তারপর ওখান থেকে তিন কিলোমিটার পথ গড়পঞ্চকোট।বলে রাখি-পুরুলিয়া জেলার নিতুড়িয়া থানার অন্তর্গত জনার্দনডি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গড়পঞ্চকোট।গড়পঞ্চকোট বা পাঁচুত পাহাড় পুরাণে শিখর পর্বত নামে বর্ণিত।গড়পঞ্চকোট শিখর রাজবংশের রাজধানী।যেতে যেতে রাস্তার ধারে অজস্র ছোট ছোট পুকুর ও ঝাঁড়ি বাঁশ[কাঁটা বাঁশ] রয়েছে পথ নির্দেশ চিহ্ন। অসুবিধা কিছুই হোলো না।পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সরাসরি একটি মন্দিরের কাছে পৌঁছে গেলাম। হ্যাঁ।রাধাকৃষ্ণ মন্দির। স্থানীয়দের কাছে খবর নিয়ে জানলাম প্রতিদিন এই মন্দিরে পুজো হয়।সকাল বেলায় প্রতিদিন ব্রাহ্মণ এসে পুজো করেন।রাজার আমলের ঐতিহাসিক মন্দির। সামনে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে-এখানে গাড়ি রাখবেন না।গাড়ি একটি সামনে দোকানের কাছে রেখে দিলাম তারপর ঐতিহাসিক স্থল অবগাহন মানে ঘুরতে থাকলাম চতুর্দিকে। এদিকে সেদিকে রাজার আমলের নানান ভগ্নাবশেষ নজরে এলো।গড়পঞ্চকোটের এদিকে সেদিকে ইতিহাসের ভগ্ন খণ্ড চিত্র দেখতে পেলাম। রানীমহল,জোড় বাংলা মন্দির,রঘুনাথ মন্দির,কালিমন্দির ইত্যাদি।স্থানীয় এক দোকানদার বললেন, পেছনদিকে ঘুরে আসুন ওখানে রয়েছে হনুমানের মূর্তি।হনুমানটিকে নাকি মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে।ঘুরে দেখলাম। দেখছি বিরাট বড় একটি হনুমান মূর্তি।মাটির ভেতরে ছিল ওটাকে খুঁড়ে বের করা হয়েছে।ছবি তুললাম।তবে সত্যি কথা বলতে কি চরম দৈণ্য দশায়, অবহেলার মধ্যেই মন্দিরগুলি রয়েছে।সংস্কার ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী।একটি মন্দির দেখার মত দেখলাম যে মন্দিরে প্রতিদিন পুজো হয়।ব্রাহ্মণ এসে পুজো করে যায়।বাকী রাজাদের যাবতীয় সবকিছুই ভগ্নাবশেষ। ঘুরতে ঘুরতে একটু পাহাড়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো একটি সরকারী আবাসন নাম চারুলতা।বেশ সাজানো গোছানো যদিও ভেতরে ঢুকলাম না তবুও বাইরের থেকেই অনুমান করলাম আবাসনটির বিশালত্ব।ফুল গাছ দিয়ে ঘেরা, একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে দেখলাম। অজস্র পর্যটক ঘোরাফেরা করছেন। অনেকেই ওয়াচ টাওয়ার উঠে পাহাড় ও পার্শ্ববর্তী দৃশ্যপট মোবাইল ক্যামেরায় ধরে রাখছেন উঠতি যুবক যুবতীরা মগ্ন সেল্ফিতে।রাস্তায় পরিচয় হোলো এক বনকর্মীর সাথে।গল্প করতে করতে জানা গেল বনকর্মীটি আমার ভগ্নীপতির পরিচিত। উল্লেখ্য আমার ভগ্নীপতি বন দফতরে কাজ করে।তিনি আমাদের জানালেন পাহাড়ে একটু উঠলেই দুর্গা মন্দির রয়েছে।তিনি একটু এগিয়ে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। বললেন যান ঘুরে আসুন আমি এখানেই রয়েছি।আমরা ঘুরে এলাম মন্দির। মন্দিরের জীর্ণ দশা দেখে মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।তবুও রাজার আমলের পুরোনো মন্দির দেখে মন ভালোই লাগলো।রাজার আমলে ১১০টি জলাশয় নির্মাণ করা হয়েছিল জানিনা বর্তমানে কতগুলি রয়েছে তবে অজস্র ছোট বড় পুকুর দেখতে পেলাম।

পর্যটকদের সুবিধার জন্য কিছু তথ্য দিয়ে রাখছি—–

কলকাতা থেকে গড়পঞ্চকোটের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার।

আসানসোল থেকে ৩৪ কিলোমিটার

আদ্রা থেকে ২২ কিলোমিটার

রঘুনাথপুর থেকে ১৭ কিলোমিটার

বরাকর থেকে ১৪ কিলোমিটার

রামকানালী রেলস্টেশন থেকে ৪ কিলোমিটার

গোবাগ থেকে ৩ কিলোমিটার

 

*গড়পঞ্চকোটের ধারে কাছে যে পর্যটন স্থলগুলি রয়েছে তা হোলো মাইথন ড্যাম,কল্যাণেশ্বরী মন্দির,পাঞ্চেত ড্যাম,বিরিঞ্চিধাম,জয়চণ্ডীপাহাড় ও বড়ন্তি।

প্রশ্ন: গড়পঞ্চকোট কোথায় অবস্থিত?

উত্তর: গড়পঞ্চকোট পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার নিতুরিয়া ব্লকের অন্তর্গত একটি পাহাড়ি অঞ্চল, যা ইতিহাস ও প্রকৃতির মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ।

****************

প্রশ্ন: গড়পঞ্চকোটে কী কী দর্শনীয় স্থান আছে?

উত্তর: গড়পঞ্চকোটে রাধাকৃষ্ণ মন্দির, রানীমহল, জোড় বাংলা মন্দির, হনুমান মূর্তি সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

প্রশ্ন: গড়পঞ্চকোট কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: গড়পঞ্চকোট পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার নিতুরিয়া ব্লকের অন্তর্গত একটি পাহাড়ি অঞ্চল, যা ইতিহাস ও প্রকৃতির মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ।

প্রশ্ন: গড়পঞ্চকোটে কী কী দর্শনীয় স্থান আছে?
উত্তর: গড়পঞ্চকোটে রাধাকৃষ্ণ মন্দির, রানীমহল, জোড় বাংলা মন্দির, হনুমান মূর্তি সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে।

লেখক: রাজকুমার সরকার

সুতপা পত্রিকা সম্পাদক

ঝাড়খণ্ড ,ভারত

আরও পড়ুন:

ভ্রমণ কাহিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *