Spread the love

মঙ্গল
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

****************

নিরঞ্জন বাবু তাঁর দীর্ঘ অধ্যাপনার জীবনে কখনো পান, বিড়ি, সিগারেট, চা, কফি, নস্যি, খৈনী, কোনো কিছুই স্পর্শ করেননি। প্রতিদিন কৃষ্ণনগর থেকে কোলকাতায় ট্রেনে পাঁচ ঘন্টা আপ ডাউন করে বঙ্গবাসী কলেজে তাঁর কর্ম জীবন কাটিয়েছেন। সবাই বোলতো প্রফেসর সেনের মতো এমন কর্মঠ, সংযমী ও নেশাহীন মানুষের দেহে কোন দিনও কোন রোগ বাসা বাঁধতে পারবে না। কিন্তু, সব ভবিষ্যদ্বাণী নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেন এবং একটা মেজর অপারেশন করাতে বাধ্য হলেন।
মাস ছয়েকের মধ্যে তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে তাঁর উপর কঠোর নির্দেশ ডাক্তার বাবুর–তাঁকে সব সময় আনন্দের মধ্যে থাকতে হবে, স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আমেরিকা প্রবাসী তাঁর এক অনুজ প্রতিম প্রবীণ ছাত্র মলয়, মলয় নাগ ও তাঁর স্ত্রী মালা নাগ কোলকাতায় এসেছেন একটা সেমিনারে যোগ দিতে। সেই অবকাশে তাঁরা অশীতিপর বৃদ্ধ স্যারকে দেখতে এসেছেন: সঙ্গে ছেলে অর্চি ও ভাইপো প্রবুদ্ধকেও এনেছেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পার্কে ওঁর বাড়ীতে যখন ওঁরা পৌঁছালেন, তখন সকাল সাড়ে দশটা। আর এখন বেলা সোয়া দুটো। মিসেস সেন গল্প করতে করতে বললেন– বলে বলে আর মানুষটাকে পারি না ভাই। শরীর বলে তো একটা জিনিষ আছে। দেখো না, কত বেলা হোল, তবু এখনো ওঁর পাত্তা নেই।
মুখের কথা শেষ হতে না হতেই নিরঞ্জন বাবু ঘরে ঢুকলেন–
অমনি উঠেই চারজনে স্যারকে প্রণাম করলেন।
–ফুটফুটে এই শ্বেতপদ্ম দুটি নিশ্চয়ই আমার জ্যেঠুসোনা।
–হ্যাঁ স্যার। এই হোল অর্চিস্মান, আমার ছেলে; আর এই হোল আমার ভাইপো, মেজদার ছেলে, প্রবুদ্ধ।
দু’জনকে আদরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে স্যার বললেন– আমি তোমাদের কি দেবো জ্যেঠুসোনা–
আশীর্বাদ করি তোমরা দু’জনে জ্ঞানে ও সম্মানে তোমাদের এই বাবা ও কাকাকে হারিয়ে দাও।
তাই যেন ওরা পারে স্যার–
মলয় ও মালা একসাথে বললো।
এরপর মধ্যাহ্ন ভোজপর্ব। খেতে খেতে কত গল্প। কত স্মৃতি রোমন্থন।
দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো। মলয়দের এবার ফেরার পালা।
–স্যার, যাবার আগে একটা অনুরোধ করে যাবো আপনাকে। রাখতে হবে কিন্তু।
–হ্যাঁ স্যার, আমি আপনার ছোট বোন; আমিও বলছি, কথাটা রাখবেন কিন্তু।
–নিশ্চয়ই বোন, রাখবো।
— Promise জ্যেঠুমনি?
— Promise, Promise, Promise, my sweet hearts! বলো ভাই মলয়। কি কথা তোমার, কি Collective decision আমার মিষ্টি জ্যেঠুসোনাদের ও আমার ছোট্ট বোনটির।
–স্যার, আপনার অবদানের কথা আপনার অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্বীকার করেনা। কিন্তু, আমি করি, মালাকে, আমার ছেলে, ভাইপো, বন্ধুবান্ধব, সবাইকে বলি যে আমার যদি কোন খ্যাতি বা সম্মান অর্জন হয়ে থাকে, তাহলে তার সব কৃতিত্বই স্যারের, স্যারের guidance -এর।
একটু থেমে মলয় বলেন, কিন্তু স্যার, আজ এই বিদায় কালে, আমি বা আমরা আপনাকে একটা ছোট্ট guidance দিয়ে যাবো, সেটা আপনাকে মেনে চলতে হবে।
–আরে নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। নিঃসংকোচে বলে ফেলো তুমি।
–স্যার, বৌদির মুখে শুনেছি আপনার উপর ডাক্তার বাবুর Advice-এর কথা, আপনাকে সব সময় আনন্দের মধ্যে থাকতে হবে, স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু কোনটাই স্যার আপনি মানছেন না। আজই তো দুপুর রোদে দুটোর পরে ঘরে ফিরলেন। এই বয়সে কি এতো অনিয়ম শরীর নিতে পারে স্যার? আপনার প্রয়োজন তো আজও এই পৃথিবীতে রয়েছে স্যার।
–মলয়, ঠিকই বলেছো ভাই তুমি। আমার প্রয়োজন আজও এ দুনিয়ায় রয়েছে। কিন্তু, চলে তো একদিন যেতেই হবে। তবে হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে বাঁচতে হবে, আনন্দের মধ্যে বাঁচতে হবে। আমি তো ভাই সেটাই করছি। আমার কাছে আনন্দের খোরাক হোল পরের মঙ্গল। এই পরের মঙ্গলের জন্যই আমি রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছু না মেনেই দিন রাত কাজ করি। এর মধ্য দিয়েই আমি পরম আনন্দ পাই। স্বাস্থ্য ও ঠিক থাকে।
সামনে থাকা জলের গ্লাসটা থেকে এক ঢোক খেয়ে তিনি বলে চললেন–
দেখো ভাই মলয়, আমি Natural Science-এর শিক্ষক। তোমাদেরকে Physics পড়াতাম: কখনো কখনো Chemistry. কিন্তু, জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে বলছি, Human Science ছাড়া Natural Science অসম্পূর্ণ, অর্থহীন। এই Human Science -এর মূল্যবোধের নিরীখে আমার স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখছি।
–তার মানে স্যার?
–তার মানে হোল, পরের মঙ্গল সাধন মোটেও কর্তব্য না; এটা হোল আনন্দময় জীবন লাভের একমাত্র উপায়: বলতে পারো একমাত্র Tonic। এর কোনো বিকল্পই নেই। আর এই আনন্দ যার জীবনে আছে, তার স্বাস্থ্যের উন্নতি তো হবেই। মোট কথা নিজের সুস্থ আনন্দময় জীবনের জন্য সবাইকে পরের মঙ্গল করতে হবে।
নিজের স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন– জিজ্ঞেস করো তোমার সাথী বৌদিকে; শুনে দেখো, ডাক্তার বাবু আমায় Prescribe করেছেন কিনা যে সব সময় আমায় আনন্দের মধ্যে থাকতে হবে, আর স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকে নজর রাখতে হবে?
মিসেস সেন মাথা নাড়লেন।
–আমি তো ভাই সেই কারণেই তোমার বৌদির হাতে সংসারের ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সাধ্যমতো পরের মঙ্গলের চেষ্টা করি; রাত দিন এই নিয়েই পড়ে থাকি; এই দেখো না, আজ ব্রেকফাস্টের পর ম্যাথোর পাড়ায় গিয়েছিলাম যারা গৃহহীন, একটা NGO কে দিয়ে তাদের জন্য গোটা কুড়ি ঘরের ব্যবস্থা করতে। ভোটবাবুদের দাদাগিরি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গরীব মানুষগুলোর জয় হয়েছে। এর মধ্যেই আমি পরম আনন্দ পাই: আমার শরীর স্বাস্থ্য-মন এতেই ভালো থাকে, এতেই আশাতীত উন্নতি হচ্ছে আমার দেহ মনের, গোটা সত্তার।
কথা বলতে বলতে সূর্য্য ডুবে গেছে। স্যারকে প্রণাম করে মলয়-মালা-অর্চি প্রবুদ্ধরা ওদের গাড়ীতে ওঠে। পাশের রাজ বাড়ির মাঠ থেকে তখন ভেসে আসছে ওদের কানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে–
আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণ ধূলার তলে,
সকল অহংকার এ আমার
ডোবাও চোখেরও জলে।

লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *