বর্তমান রাজনীতি: এক বিশাল মেগা সিরিয়াল
বর্তমান রাজনীতি: এক বিশাল মেগা সিরিয়াল
শ্যামল মণ্ডল
ভূমিকা
রাজনীতি এক সময় ছিল আদর্শ, ত্যাগ ও নেতৃত্বের প্রতীক। এখন সেটা হয়ে উঠেছে এক নিরবচ্ছিন্ন বিনোদনের উৎস। তফাৎ শুধু একটাই—এই ‘মেগা সিরিয়াল’-এ বিজ্ঞাপন নেই, বিরতিও নেই। ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচারিত এই ধারাবাহিক আমাদের জীবনের প্রতিটি কোণে ঢুকে পড়েছে। এখন আমরা কফি খাওয়ার সময়, চায়ের আড্ডায়, ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও এই মেগা সিরিয়ালের সংলাপ আওড়ে ফেলছি।
অধ্যায় ১: চরিত্রের হ্যাংলামো ও নাটকীয় রূপান্তর
একজন রাজনীতিবিদের চরিত্রে স্থায়িত্ব এখন অতীত। আজ তিনি প্রতিবাদী, কালই তিনি শাসকের পাশে—হাসিমুখে ছবি তোলেন। নাটকের চরিত্র যেমন পঞ্চম পর্বে গর্ভবতী হয়ে পড়ে আর সপ্তম পর্বে ভুলে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের নেতারাও আজ একদল, কাল আরেকদল।
একটা কল্পনা করো—একটা চ্যানেলে চলছে “রাজনীতির মোড়লবাবু”, সেখানে নেতাজি কাঁদছেন জনগণের জন্য, পরের সপ্তাহেই সেই নেতাজিই বিদেশে বেড়াতে গিয়ে বলছেন, “দেশ এখন আমার হাতে নিরাপদ!” ভাবো, কী পরিস্কার সংলাপ! ক্যামেরা প্যান করে গিয়ে ধরা হয় তার দামি ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস, আর পেছনে গোল্ডেন রিসোর্ট।
অধ্যায় ২: প্লট টুইস্ট ও দলবদলের ভেল্কি
রাজনীতির এই মেগা সিরিয়ালে সবচেয়ে জনপ্রিয় দৃশ্য—“দলবদল পর্ব”।
এ যেন সত্যিকারের ট্রান্সফর্মার মুভি—মাত্র ৩০ সেকেন্ডে নেতার মুখভঙ্গি বদলে যায়, আদর্শ বদলে যায়, এমনকি ভগবানও বদলে যায়! গত সপ্তাহেও যে বলছিলেন, “এই দল দেশের সর্বনাশ করেছে”, এই সপ্তাহে সেই তিনিই বলছেন, “আমি বরাবরই এই দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত”।
নেতারা নিজেরাই মাঝে মাঝে মনে রাখেন না গতকাল কী বলেছিলেন। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। টিভির পর্দায় বড় করে লেখা হয়—”এক্সক্লুসিভ: মেগা জয়েনিং!” তারপর বাজতে থাকে বিজয় সংগীত। ক্যামেরা ক্লোজআপে নেতার মুখ, পিছনে পুষ্পবৃষ্টি। এই দৃশ্যটা এখন এত পরিচিত, যে আমাদের ৮ বছরের ছেলেমেয়েরাও এই ডায়ালগ মুখস্থ করে ফেলেছে।
অধ্যায় ৩: বিরোধী দল ও ‘সিরিয়াল ভিলেন’ স্টাইল
মেগা সিরিয়ালে যেমন একটা ‘বিপজ্জনক ভিলেন’ থাকতেই হয়, তেমনি রাজনীতিতেও প্রয়োজন একটা ‘বিরোধী’। তারা সরকারকে যা-ই করুক, সেটার ভুল দিক দেখানোই তাঁদের কাজ।
দ্রব্যমূল্য বেড়েছে?—”এই সরকারের চক্রান্ত।”
জল আসছে না?—”এই সরকারের অবহেলা।”
জল বেশি আসছে?—”এই সরকারের ষড়যন্ত্র।”
ভোটের আগে বিরোধীরা হঠাৎ করে গ্রামের মাঠে গিয়ে ছেঁড়া গামছা পরে কচুপাতা খাচ্ছেন, আর বলছেন, “আমি গরিবের পাশে আছি।” ক্যামেরা ধরে রেখেছে, আর পেছনে বাজছে আবেগি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দর্শক ভাবছে, “উফ, কী মানবিক!” পরে জানা গেল, সেই গামছা ছিল ডিজাইনার, আর কচুপাতার পেছনে ছিল ফাইভ-স্টার লাঞ্চ।
অধ্যায় ৪: ভোট মানে মেগা ফিনালে
একটা সত্যি কথা মানতেই হবে—ভোট হল এই সিরিয়ালের ক্লাইম্যাক্স পর্ব। এটা হল যখন চরিত্ররা একে অপরকে ধাক্কা দেয়, ছুরি চালায় (প্রচলিত অর্থে), গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেয়, আর ভোটারদের পা ধুয়ে জল পান করে ফেলে।
ভোট মানেই আর্টিস্টিক প্রচার—নেতারা হঠাৎ করে কবি হয়ে যান, কেউ কেউ আবার গায়ক হয়ে গান গেয়ে ফেলেন, কেউ থিয়েটার করে “আমাকে বাঁচাও, আমি তোমার সেবক” বলে হাঁটু গেড়ে বসেন।
আর তারপর? ফলাফল ঘোষণার পর পরই শুরু হয় ‘পরবর্তী পর্বের’ প্রস্তুতি—পরাজিতরা বলেন, “জনগণ আমাদের ভুল বুঝেছে।” বিজয়ীরা বলেন, “জনগণ আমাদের আশীর্বাদ দিয়েছে।” তবে কেউই বলেন না, “আমরা ভুল করেছি।”
অধ্যায় ৫: সোশ্যাল মিডিয়ার কাটপিস এবং প্রোমো
আগে সিরিয়ালের প্রোমো টিভিতে হত, এখন রাজনীতির প্রোমো হয় ফেসবুক-ইউটিউব-টুইটারে। সেখানে নেতারা নিজেরাই এডিট করে ভিডিও বানান—ব্যাকগ্রাউন্ডে নাটকীয় সাউন্ড ইফেক্ট, আর মাঝে মাঝে ধোঁয়া ওঠা দৃশ্য।
আর ট্রোল? সেই তো সিরিয়ালের ভিলেন-ভিলেন খেলা। এক দলের সমর্থক অন্য দলের নেতার ছবি এডিট করে বানাচ্ছে মিম, অন্যপক্ষ বানাচ্ছে রিলস। সত্য-মিথ্যার বালাই নেই—এই খেলায় শুধু ‘কীভাবে ভাইরাল করা যায়’ সেটাই মূল কথা।
অধ্যায় ৬: জনগণ—এই নাটকের চিরকালীন দর্শক
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এই ধারাবাহিক নাটকে জনগণ সব জানে, তবুও দেখতেই থাকে।
হাসে, রাগ করে, আবার পরদিন খবর দেখে বলে, “এবার আর বোকা হব না!” কিন্তু তার পরদিনই আবার সেই পুরনো আবেগে জড়িয়ে পড়ে।
যে রিকশাওয়ালা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাড়ি ফেরে, সেও রাতে খবর দেখে বলে, “এইবার ঠিক বিচার হবে।” বৃদ্ধ মানুষ ভোট দিতে যায় লাঠি নিয়ে, হৃদয়ে আশার আলো নিয়ে। অথচ যাঁদের ওপর বিশ্বাস করে ভোট দেন, তারা পরদিনই নিজেদের উন্নয়নের নামে বিলাসে মত্ত হয়।
উপসংহার
এই বর্তমান রাজনীতি একটি অনন্ত মেগা সিরিয়াল, যার কোনও শেষ নেই। এখানে চরিত্র বদলায়, দল বদলায়, নাটকীয়তা বদলায়, কিন্তু দর্শকের প্রতিক্রিয়া একই থেকে যায়—একটু ক্ষোভ, একটু আশা, আর অনেক বেশি নিরবতা।
তবুও এই সিরিয়াল চলতেই থাকবে। কারণ, যতদিন মানুষ আশাবাদী থাকবে, ততদিন এই নাটক দেখার দর্শক থাকবে।
আর যতদিন দর্শক থাকবে, ততদিন রাজনীতিবিদেরা সিরিয়াল লিখে যাবেন, প্রযোজনা করবেন, আর মাঝেমধ্যে অভিনয়ও করবেন।
—
আরও পড়ুন:
মালদা জেলার ইতিহাস শুধু গৌড় আর আমে সীমাবদ্ধ নয়। জানুন ৫টি অজানা তথ্য, যা আপনাকে চমকে দেবে।
মন্তব্য ও শেয়ার করে নিয়মিত যুক্ত থাকুন