KABYAPOT.COMনিবন্ধ

ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে লাভজনক দেশি মুরগি পালন

Spread the love

ত্রিপুরার পাহাড়ে দেশি মুরগি পালন: একটি লাভজনক সম্ভাবনা

কলমে -<<শ্যামল মণ্ডল

প্রস্তাবনা

 

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য। এখানকার পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি, গ্রামীণ জীবনধারা এবং জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশের জীবন-জীবিকা এখনো কৃষি ও পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল। এই প্রেক্ষাপটে দেশি মুরগি পালন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প জীবিকা হিসেবে উঠে আসছে। কম পুঁজি, সহজ রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর কারণে এটি শুধু একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা নয়, বরং এটি হতে পারে একটি টেকসই এবং লাভজনক খাত।

 

এই নিবন্ধে আমি বিশ্লেষণ করেছি কিভাবে ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে দেশি মুরগি পালন লাভজনকভাবে পরিচালনা করা যায়, এর পেছনের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত যুক্তিগুলি কী, এবং ভবিষ্যতে এই খাত কতটা প্রসার লাভ করতে পারে।

 

১. ত্রিপুরার ভৌগোলিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট

 

ত্রিপুরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি রাজ্য, যার মোট এলাকা প্রায় ১০,৪৯১ বর্গ কিমি। রাজ্যের প্রায় ৬০-৭০% এলাকা পাহাড় ও বনভূমি দ্বারা আবৃত। এখানকার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র, যা দেশি মুরগি পালনের জন্য অনুকূল।

 

ত্রিপুরার প্রধান উপজাতিগুলির মধ্যে রয়েছে টিপরা, রিয়াং, চাকমা, হালাম প্রভৃতি। তারা প্রথাগতভাবে ঝুম চাষ ও পশুপালনের সঙ্গে যুক্ত। অনেক গ্রামেই বিদ্যুৎ, পানীয় জল বা আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির অভাব থাকলেও, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো আত্মনির্ভর হতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে দেশি মুরগি পালন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে শুরু করেছে।

 

 

 

২. দেশি মুরগির বৈশিষ্ট্য ও জনপ্রিয় জাতসমূহ

 

দেশি মুরগি বলতে সাধারণত স্থানীয় জাতের সেই সব মুরগিকে বোঝানো হয় যেগুলো খোলা পরিবেশে বড় হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এদের বিশেষত্ব হলো:

 

স্বাভাবিকভাবেই ঘাস, কীটপতঙ্গ খেয়ে টিকে থাকতে পারে

 

অল্প যত্নে উৎপাদনক্ষম

 

দেশি ডিম ও মাংসের পুষ্টিমান বেশি

 

রোগ কম হয়, ফলে ওষুধ খরচ কম

 

 

ত্রিপুরায় কিছু জনপ্রিয় দেশি মুরগি জাত:

 

নাগা জাত

 

আসমি জাত

 

কাদাকনাথ (বহিরাগত হলেও উপযোগী)

 

গ্রাম প্রিয়া (ICAR কর্তৃক উন্নতজাত)

 

রংদানী/বনরাজ (উন্নত হাইব্রিড দেশি জাত)

 

৩. পাহাড়ি অঞ্চলে দেশি মুরগি পালনের সুবিধা

৩.১. প্রাকৃতিক খাদ্যের প্রাচুর্য

পাহাড়ি অঞ্চলে মুরগির জন্য প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ, ঘাস ও শস্য সহজলভ্য, ফলে খাদ্য খরচ অনেক কমে যায়।

৩.২. কম পরিকাঠামো প্রয়োজন

দেশি মুরগির জন্য ব্যয়বহুল খাঁচা বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন হয় না।

৩.৩. স্থানীয় চাহিদা

দেশি মুরগির ডিম ও মাংসের প্রতি মানুষের স্বাস্থ্যগত বিশ্বাস থেকে বাজারে চাহিদা অনেক বেশি।

৩.৪. নারীদের সম্পৃক্ততা

এটি গ্রামীণ নারীদের জন্য একটি আয়বর্ধক কার্যক্রম, ফলে নারীর ক্ষমতায়নও ঘটে।

৪. খামারের ধরণ ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি

৪.১. মুক্ত চারণ পদ্ধতি (Free-range)

মুরগিকে মুক্তভাবে চলাফেরার সুযোগ দিয়ে প্রাকৃতিক খাদ্যে বড় করার পদ্ধতি।

৪.২. আধা-মুক্ত পদ্ধতি (Semi-intensive)

আংশিক ঘরবন্দি এবং আংশিক মুক্তভাবে পালন করা হয়। এটি বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

৪.৩. ইনটেনসিভ পদ্ধতি

বদ্ধ পরিবেশে কৃত্রিম খাদ্যে বড় করা হয়। তবে এটি দেশি মুরগির জন্য ততটা উপযুক্ত নয়।

৪.৪. খামার গঠনের পরিকল্পনা

ঘর: বাতাস চলাচলের সুযোগসহ ঝড়/বৃষ্টি প্রতিরোধী ঘর

পানি: প্রতিদিন পরিস্কার পানির ব্যবস্থা

খাদ্য ট্রে ও দানাদার খাবার

৫. খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও পুষ্টি পর্যালোচনা

দেশি মুরগির খাদ্য পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ, তবে পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হবে:

প্রথম ৪ সপ্তাহ: ব্রুডার স্টেজ – প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োজন

৫-৮ সপ্তাহ: শস্য, চালের কুড়া, ভাঙা ভুট্টা

প্রাপ্তবয়স্ক মুরগি: গম, ভুট্টা, খৈল, খোল, ছোট মাছ

পুষ্টি উপাদানসমূহ:

প্রোটিন: ১৬-২২%

ক্যালসিয়াম: ডিমের খোলের জন্য

মিনারেল ও ভিটামিন

৬. রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

সাধারণ রোগ:

নিউক্যাসল ডিজিজ (Ranikhet)

ইনফেকশাস ব্রনকাইটিস

ফাউল পক্স

ককসিডিওসিস

ক্রোনিক রেসপিরেটরি ডিজিজ

প্রতিকার ও প্রতিরোধ:

সময়মতো ভ্যাকসিন

পরিষ্কার খামার

টাটকা খাবার ও পানি

ভ্যাকসিন সময়সূচি (উদাহরণ):

বয়স (দিন) ভ্যাকসিন রোগের নাম

5-7 F1 রাণিখেত

14 IBD গাম্বোরো

21 F1 Booster রাণিখেত

28 Pox ফাউল পক্স

৭. উৎপাদন ব্যয় ও লাভ বিশ্লেষণ

উদাহরণ: ১০০টি দেশি মুরগি নিয়ে খামার

খরচের খাত পরিমাণ (টাকা)

মুরগির বাচ্চা (প্রতি ৩০ টাকা) ৩,০০০

খাদ্য (৩ মাস) ৬,০০০

ওষুধ ও ভ্যাকসিন ১,০০০

ঘর তৈরি ও সরঞ্জাম ৫,০০০

মোট ১৫,০০০

আয়:

প্রতিটি মুরগি বিক্রি ২৫০ টাকা = ২৫,০০০ টাকা

ডিম বিক্রি (প্রতি মুরগি ৬০টি x ১০০ = ৬,০০০ ডিম x ৬ টাকা) = ৩৬,০০০ টাকা

মোট আয়: ৬১,০০০ টাকা

লাভ: ৬১,০০০ – ১৫,০০০ = ৪৬,০০০ টাকা (প্রায় ৩০০% রিটার্ন)

৮. বাজার সংযোগ ও বিপণন কৌশল

স্থানীয় বাজার

সাপ্তাহিক হাট বা নিকটবর্তী শহর

স্থানীয় হোটেল, ক্যাফে

আধুনিক পদ্ধতি

WhatsApp বা Facebook এর মাধ্যমে সরাসরি বিক্রি

গ্রুপ তৈরি করে অর্ডার নেওয়া

গ্রামীণ সমবায় গঠন

প্রসেসিং ইউনিট

ডিম থেকে চিক বের করা

প্রি-প্যাকaged দেশি মাংস সরবরাহ

৯. সরকারী ও বেসরকারি সহায়তা

সরকারী স্কিম:

RKVY (Rashtriya Krishi Vikas Yojana)

NBM (National Livestock Mission)

Tripura Livestock Development Agency (TLDA)

মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যে ভর্তুকি

প্রশিক্ষণ কর্মশালা

NGO ও SHG উদ্যোগ:

বেসরকারি সংস্থা মুরগি বিতরণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ করে

নারী স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHG) মাধ্যমে মুরগি পালন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে

১০. পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব

পরিবেশগত:

কৃত্রিম খামারের তুলনায় পরিবেশ বান্ধব

কম বর্জ্য ও জৈব সার তৈরি

সামাজিক:

নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা

দরিদ্র পরিবারে আয় বৃদ্ধি

শিশুদের পুষ্টি উন্নয়ন (ডিম খাওয়ার সুযোগ)

১১. সাফল্যের গল্প: বাস্তব উদাহরণ

কাহিনী ১: আমলিঘরী গ্রামের মিনা দেবী

২০১৯ সালে মাত্র ৫০টি দেশি মুরগি নিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। ২০২৪ সালে তার খামারে ৬০০ মুরগি রয়েছে এবং বার্ষিক আয় ৩ লক্ষ টাকার বেশি।

কাহিনী ২: লাংতাই গ্রামের যুব সংঘ

ছয়জন যুবক মিলে সমবায় খামার গঠন করে, বর্তমানে তারা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২,০০০ ডিম বিক্রি করে এবং নিয়মিত চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়।

১২. চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

চ্যালেঞ্জ:

প্রশিক্ষণের অভাব

পরিশোধযোগ্য ঋণ প্রাপ্তিতে সমস্যা

রোগ প্রতিরোধে অবহেলা

করণীয়:

ব্লক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন

সরকারি সহায়তার সহজ প্রাপ্তি

বাজার সংযোগে ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার

গবেষণা সংস্থা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়

উপসংহার

ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে দেশি মুরগি পালন শুধুমাত্র একটি পারিবারিক জীবিকাসূত্র নয়, এটি একটি সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র উদ্যোগ, যা স্থানীয় জনগণকে আত্মনির্ভরশীল করতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব, তেমনি সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন, পুষ্টির উন্নতি ও পরিবেশ সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যায়।

সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা, প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ এবং বাজার সংযোগের ব্যবস্থাপনা থাকলে ত্রিপুরার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলিও আগামীদিনে দেশি মুরগি উৎপাদনে অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

Q1: ত্রিপুরার পাহাড়ে দেশি মুরগি পালন কি লাভজনক?

A: হ্যাঁ, কম খরচে উচ্চ চাহিদার দেশি ডিম ও মাংস বিক্রির মাধ্যমে এটি অত্যন্ত লাভজনক হতে পারে।

Q2: দেশি মুরগি পালনে সরকার কি সহায়তা দেয়?

A: হ্যাঁ, ট্রেনিং, বাচ্চা সরবরাহ, ও ভর্তুকি সহায়তা দেওয়া হয় NLM ও TLDA প্রকল্পের মাধ্যমে।

Q3: দেশি মুরগির ডিম ও মাংসের দাম কেমন?

A: ডিম ৬–১০ টাকা এবং মুরগি ২০০–৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে।

Q4: দেশি মুরগির কোন জাতগুলো ত্রিপুরায় ভালো হয়?

A: বনরাজ, গ্রাম প্রিয়া, কাদাকনাথ জাত এবং স্থানীয় দেশি জাত ভালো ফলন দেয়।

Tripura Livestock Development Agency (TLDA)

https://ardd.tripura.gov.in/tlda

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *