প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (দ্বিতীয় পর্ব) ✍️ শৌভিক
প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (দ্বিতীয় পর্ব)
✍️ শৌভিক
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর –
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে রামকৃষ্ণ দেবের মাস মাইনে ছিল ৫ টাকা। বেশ কিছু দিন পুজো পাঠ করার পর দেবীর চিন্ময়ী রূপের দেখা না পেয়ে শ্রী শ্রী ঠাকুর একদিন মন্দিরের দেওয়ালে রাখা খাঁড়াটি হাতে তুলে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে উদ্যত হন এবং তখনই জগৎ জননী মা ভবতারিণীর আলোক ময় অলৌকিক রূপ দর্শন হয়েছিল তাঁর প্রথম বার। এক বিশাল আশ্চর্য আলোর জ্যোতি বৃত্যের মাঝে জগৎজননী কে দেখে অভিভূত ঠাকুর সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। নিজের চোখে সেই প্রথম মৃন্ময়ী পাথুরে মূর্তির মা তাঁর সামনে চিন্ময়ী রূপে বিরাজমান হয়েছিলেন। এর পর দক্ষিনেশ্বরে গঙ্গার ঘাট ছুঁয়ে কত অনন্ত জলরাশি বয়ে গেল আর পরমহংস দেবের চিরন্তন লীলা ক্ষেত্র হিসাবে চিরকালে জন্য সংযুক্ত হয়ে গেল দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দির৷
একদিন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে দেবীর পূজা করছেন ঠাকুর। সয়ং রানি রাসমণি মন্দিরে বসে পুজো দেখছেন। পুজো থামিয়ে হঠাৎ রানির গালে সপাটে চড় মেরে ঠাকুর বললেন, ‘‘কেবল ওই চিন্তা ! এখানেও ওই চিন্তা !’’ ঠাকুরের এই আচরণে সকলেই রেগে আগুন তখন এবং রানি রাসমণির সোজো জামাই
মথুর বাবু তো রাগে অগ্নিশর্মা এই ঘটনায়, তখন রানি নিজেই লজ্জিত মুখে স্বীকার করলেন, তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মা ভবতারিণীর মূর্তির সামনে বসেও তিনি দেবীর আরাধনায় মন দিতে পারছিলেন না, মামলা মোকদ্দমা সংক্রান্ত বিষয়ের চিন্তায় ! সে দিন রানি রাসমণি বুঝেছিলেন ঠাকুর কত গভীর অন্তর্যামী।
দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দিরে যাওয়ার আগে যে রাধমাধবের মন্দির টি আছে, সেই মন্দিরের মূর্তির গহনা চুরি হয়েছিল একবার। মথুর বাবু পাইক বরকন্দাজ এনে খানা তল্লাশির ব্যবস্থা করলে খুব শোরগোল পড়ে যায় সেখানে। ঠাকুর তখন মথুর বাবুর থেকে ঘটনার খোঁজ খবর নিয়ে হেসে বলেছিলেন, ” সে যে এত অস্থির হয়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছে এখানে, সে কী ভেবে দেখেছে, রাধামাধবের কাছে ওই কটি সোনার হার বালার কী মূল্য আছে ? সয়ং দেবী লক্ষী যার অর্ধাঙ্গিনী, দেবী লক্ষ্মী যাঁর পদ সেবা করেন, তাঁর কী এসে যায় ওই কটি গহনা গেল কী থাকল তা নিয়ে ? ”
একবার ঠাকুরের সাথে ধর্ম-চর্চায় কথার খৈ হারিয়ে ফেলে এক সাধু ভীষণ রেগে চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমি ত্রিশ বছর সাধনা করে এখন হেঁটে নদী পার হতে পারি। আপনি কী পারেন?” তখন ঠাকুর একটু হেসে বললেন, ”যেখানে এক পয়সা দিলেই মাঝি আমাকে নদী পার করে দেয় সেখানে এর জন্য ত্রিশ বছর নষ্ট করার অর্থ হয় না।”
মথুর বাবু একবার রামকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলেন যে, তিনিও ঠাকুরের মত ভাব-সমাধির অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান। ঠাকুর মথুর বাবুকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করার পরও মথুরবাবুর জেদ যে তিনি সমাধিস্থ অবস্থায় যেতে চান। শেষে ঠাকুর বাধ্য হয়ে বলেন, ‘‘ঠিক আছে, মা-কে বলব, তিনি যা করার করবেন।’’ এর কয়েকদিন পরেই সমাধিস্থ অবস্থা প্রাপ্তি লাভ করেছিলেন মথুরবাবু। তাঁর চোখ থেকে তখন কেবল জলের ধারা। সেই অবস্থায় ঠাকুরকে দেখে তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়েন মথুর। গভীর শ্রদ্ধা মিশ্রিত স্বরে বলেঋিলেন, ‘‘এ কী করলে ঠাকুর ! আমার যে জমিদারির কাজে আর কিছুতেই মন বসে না ! আমাকে মুক্তি দাও এ থেকে।’’ ঠাকুর হেসে বলেছিলেন, ‘‘আগেই বলেছিলেম, ভাবসমাধি সকলের সয় না।’’
একবার ঠাকুরের কাকার ছেলে অর্থাৎ কাকা তো ভাই হলধারী কোনও বিষয়ে রাগে কুপিত হয়ে ঠাকুরকে অভিশাপ দেন, ‘‘তোর মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।’’ তার কয়েকদিন পরে সত্যিই ঠাকুরের মুখ থেকে রক্তপাত শুরু হল ! আসলে হঠযোগ সাধনার চুড়ান্ত পর্যায়ে জড় সমাধিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেব এই অবস্থায় মুখ দিয়ে রক্ত পাত হয়ে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসেন, না হলে ঠাকুরের জড় সমাধি হয়তো আর অবসানই হত না।
ভক্তি যোগ ও শাস্ত্রবিধির বিরোধে শ্রীরামকৃষ্ণদেব মথুরকে যা বলেছিলেন, প্রতিমা বিসর্জনের বিষয়ে, তা চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মথুর শ্রী রামকৃষ্ণ দেবকে জানিয়েছিলেন যে, জীবন থাকতে তিনি দুর্গা মূর্তি বিসর্জন দিতে পারবেন না। শুনে হাসতে হাসতে ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, “আচ্ছা, এই তোমার ভয় ? মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবে কে বলেছে ? আর বিসর্জন দিলেই বা তিনি যাবেন কোথায় ? ছেলেকে ছেড়ে মা কি কখনো একলা থাকতে পারেন ? তিন দিন মা বাইরের দালানে বসে তোমার পুজাে নিয়েছেন, আজ থেকে তোমার আরও কাছে থেকে সবসময় তোমার হৃদয়ে বসে পুজাে নেবেন। মা কে কোথায় বিসর্জন দেবে ? বিসর্জন তো দেবে নিজের হৃদয়ে।”
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
উদ্বোধন পুস্তক ও পত্রিকা –
স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ
স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ।
স্বামী বিশ্বনাথানন্দ মহারাজ
স্বামী ভূমানন্দ মহারাজ
শ্রী মহেন্দ্রলাল গুপ্ত
শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
নূপূর বন্দ্যোপাধ্যায়
কৃষ্ণ কুমার দাস
নিউজ এইটটিন বাংলা
সংবাদ প্রতিদিন