KABYAPOT.COMধারাবাহিকপ্রবন্ধ

প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (চতুর্থ পর্ব) ✍️ শৌভিক

Spread the love

প্রবন্ধ – ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ (চতুর্থ পর্ব)

 

✍️ শৌভিক

 

মাস্টারমহাশয় ও ঠাকুর –

 

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব গৃহ ত্যাগী সন্ন্যাসীদের জন্য যত টা ছিলেন তার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না তাঁর গৃহী সংসারী ভক্ত দের জন্য। সংসারের সকল কাজের ব্যস্ততার মাঝেও ঈশ্বরে মন টুকু রেখে দেওয়ার কথা তিনি বারবার বলে গেছেন। কথামৃতের লেখক শ্রীমর সাথে পরমহংসদেবের প্রথম সাক্ষাৎকারটি ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত সময়ের। সেদিন তিনি ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখন সন্ধ্যা করবেন, তবে এখন আমরা আসি ?” তখন পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য ডুবেছে গঙ্গার তীরে। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, “না সন্ধ্যা, তা এমন কিছু নয়।” এই সহজ সরল কথাতেই স্নিগ্ধ শীতলতায় ভরে উঠেছিল শ্রীম তথা মাস্টার মহাশয়ের মন৷ দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের দিন ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কি বিবাহ হয়েছে ?” মাস্টার জবাব দিলন, “আজ্ঞে হ্যাঁ।” মাস্টার দেখলেন ঠাকুর যেন একটু স্তব্ধ হলেন আর বলে উঠলেন, “ওরে রামলাল, যাঃ বিয়ে করে ফেলেছে !” মাস্টারমশায় তখন ভাবছেন, বিয়ে করা কি এত দোষের ? ঠাকুরের পরের প্রশ্ন, “তোমার কি ছেলেপিলে হয়েছে ?” মাস্টার লজ্জিতস্বরে বললেন, “আজ্ঞে, ছেলে হয়েছে ।” ঠাকুর যেন কেমন আক্ষেপের সুরে বললেন, “যাঃ ছেলে হয়ে গেছে !” পরবর্তীতে ঠাকুর সস্নেহে বলেছিলেন, “সব কাজ করবে কিন্তু মন ঈশ্বরেতে রাখবে। স্ত্রী, পুত্র, বাপ, মা সকলকে নিয়ে থাকবে, সেবা করবে। যেন কত আপনার লোক। কিন্তু মনে জানবে যে তারা তোমার কেউ নয়। তুমি যেন বড় মানুষের বাড়ির দাসী।বড় মানুষের বাড়ির দাসী সব কাজ করছে, কিন্তু দেশে নিজের বাড়ির দিকে মন পড়ে আছে। আবার সে মনিবের ছেলেদের আপনার ছেলের মতো মানুষ করে। বলে ‘আমার রাম, আমার হরি’। কিন্তু মনে বেশ জানে এরা আমার কেউ নায়।” তিনি আরো বলেছেন, “কচ্ছপ জলে চরে বেড়ায়। কিন্তু তার মন কোথায় পড়ে আছে জান ? আড়ায় পড়ে আছে। যেখানে তার ডিমগুলি আছে। সংসারের সব কর্ম করবে কিন্তু ঈশ্বরে মন ফেলে রাখবে। ঈশ্বরে ভক্তিলাভ না করে যদি সংসার করতে যাও তাহলে আরো জড়িয়ে পড়বে। বিপদ, শোক, তাপ এসবে অধৈর্য হয়ে যাবে। আর যত বিষয় চিন্তা করবে ততই আসক্তি বাড়বে। তেল হাতে মেখে তবে কাঁঠাল ভাঙতে হয়। তা নাহলে হাতে আঠা জড়িয়ে যায়। ঈশ্বরে ভক্তিরূপ তেল লাভ করে তবে সংসারের কাজে হাত দিতে হয়। কিন্তু এই ভক্তি লাভ করতে হলে নির্জন হওয়া চাই। মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয়। দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না। তারপর নির্জনে বসে সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয়। তবে মাখন তোলা যায়। সংসারে কেবল কামিনী-কাঞ্চন চিন্তা। সংসার জল আর মনটি যেন দুধ। যদি জলে ফেলে রাখ, তাহলে দুধে-জলে মিশে এক হয়ে যায়, খাঁটি দুধ খুঁজে পাওয়া যায় না। দুধকে দই পেতে মাখন তুলে যদি জলে ফেলে রাখা যায়, তাহলে ভাসে। তাই নির্জনে সাধন দ্বারা আগে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন লাভ করবে। সেই মাখন সংসার-জলে ফেলে রাখলেও মিশবে না, ভেসে থাকবে। সংসারে ঢুকেই যখন পড়েছ, তখন তো আর উপায় নেই। সে তোমার প্রারব্ধ কিন্তু সব ঠিক থাকবে যদি বিচারটি ঠিক থাকে। কি সেই বিচার? কামিনী-কাঞ্চন অনিত্য। ঈশ্বরই একমাত্র বস্তু। টাকায় কি হয়? ভাত হয়, ডাল হয়, কাপড় হয়, থাকবার জায়গা হয়, এই পর্যন্ত। কিন্তু এতে ভগবান লাভ হয় না। তাই টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। এর নামই বিচার, বুঝেছ ?” শ্রীম বললেন, “আজ্ঞে হাঁ, প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক আমি সম্প্রতি পড়েছি, তাতে আছে বস্তুবিচার ।” ঠাকুর বলছেন, “হ্যাঁ, বস্তুবিচার। এই দেখ টাকাতেই বা কি আছে, সুন্দর দেহেই বা কি আছে ! বিচার কর, সুন্দরীর দেহতেও কেবল হাড়, মাংস, চর্বি, মল, মূত্র – এইসব বস্তুতে মানুষ ঈশ্বরকে ছেড়ে কেন মন দেয় ? কেন ঈশ্বরকে ভুলে যায় ?” ঠাকুরের কথার মুগ্ধতায় পরবর্তীতে তাঁর প্রতি অপার শ্রদ্ধা ভক্তির সাগরে ডুব দিয়েছিলেন মাস্টার মশায়, তা আমর জানি সকলেই।

 

তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি – একবার এক গৃহী ভক্ত এসে ঠাকুরকে বলেছেন যে তার বড় দুঃখ কষ্ট জীবনে। ঠাকুর শুনে বললেন, “বাবা সুখের চাইতে দুঃখ ভাল। প্রবৃত্তির চাইতে নিবৃত্তি ভাল। এতে মন তাঁর দিকে থাকে।” একবার কামারপুকুর থেকে এক মহিলা এসেছেন ঠাকুরের সাথে দেখা করতে। ওই মহিলা ঠাকুরকে বললেন যে সংসারে তার আপন বলতে আর কেউ নেই তাই মনে অশান্তি । এই কথা শুনেই ঠাকুর আনন্দে দু হাত তুলে নাচ শুরু করলেন আর আপন মনে গাইতে থাকলেন, “যার কেউ নাই তার হরি আছে ।” মহিলাটির, ঠাকুরের গান শুনে আর আপার আশীর্বাদ লাভের পর অনুভব হয় – মনে আর কোনো অশান্তির ছায়ামাত্রও নেই – চারিদিকে আপার শান্তি শুধু। শ্রীম এক জায়গায় লিখেছেন যে তিনি ঠাকুরের মুখে শুনেছিলেন – “ঈশ্বরের দুটো ডিপার্টমেন্ট আছে, বিদ্যা-মায়া আর অবিদ্যা-মায়া। অবিদ্যা-মায়াতেই হয় টাকা কড়ি, বাড়িঘর, মানসম্ভ্রম, ইন্দ্রিয়সুখ। এতে ঈশ্বরের থেকে মানুষকে দূরে করে দেয়। আর দয়াটয়া, সাধুসঙ্গ, তীর্থ, তপস্যা, শাস্ত্রপাঠ এসব হল বিদ্যা-মায়ার কাজ। এর দ্বারাই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।” ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এমন কত কথা আর কাহিনি বর্নিত আছে শ্রীম লিখিত অমৃতের ভান্ডার – শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত বইয়ে।

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

 

উদ্বোধন পুস্তক ও পত্রিকা –

স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ মহারাজ

স্বামী জয়ানন্দ মহারাজ।

স্বামী বিশ্বনাথানন্দ মহারাজ

স্বামী ভূমানন্দ মহারাজ

শ্রী মহেন্দ্রলাল গুপ্ত

শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

নূপূর বন্দ্যোপাধ্যায়

কৃষ্ণ কুমার দাস

নিউজ এইটটিন বাংলা

সংবাদ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *