নরসিংডাঙ্গার জমি
✍️ শ্যামল মণ্ডল
আমার গ্রামের নাম আহিল। আহিল মানে মাটির গন্ধ, ধানের গাছের ফিসফিসানি, আর শৈশবের মেঠো হাওয়া। আহিলের দক্ষিণদিকে বাঁশঝাড় পেরিয়ে যে কাঁচা রাস্তা গেছে, তার অপর প্রান্তে একটা ছোট গ্রাম—নরসিংডাঙ্গা।
ছোটবেলায় সেই পথ ধরে কতবার যে গেছি, হিসেব নেই। মাটির রাস্তার দু’ধারে সারিসারি তালগাছ, মহুয়া গাছ, বাঁশঝাড় তারপরেই দিগন্তজোড়া সবুজ ধানক্ষেত। হাওয়ায় ঘুরে বেড়াত মহুয়ার ফুলের গন্ধ, আর দূরে কোথাও ঢেঁকিতে ধান কোটার টুংটাং শব্দ ভেসে আসত।
নরসিংডাঙ্গা হল আদিবাসীদের গ্রাম। ওদের হাসিতে শিশুর মতো সরলতা লেগেইথাকে, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল দারিদ্র্য, অবহেলা আর অজানা যন্ত্রণা। কৈশোরে আমি ওদের ঘরে ঘরে যেতাম, একসঙ্গে খেলতাম, খেতাম, গল্প করতাম। বাঙালি ছেলেরা অনেকেই ওদের সঙ্গে মেশাতে কুণ্ঠা বোধ করত, কিন্তু আমি করতাম না। আমার কাছে ওরা ছিল সমান মানুষ।
আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল একজনের সঙ্গে — নাম বড়কু, ডাকনাম কুড়িও । নামটা উচ্চারণে কেমন যেন তালমিশ্রিত সাঁওতালি সুর। কুড়িওর পদবীটা আজও ঠিক মনে নেই — হেমব্রম না সরেন, হয়তো হাঁসদা। ছোটখাটো গড়ন, কাঁধে সবসময় একটা পুরনো গামছা ঝোলানো, চোখে মাটির মতো নিষ্পাপ আলো।
ওদের ঘর ছিল মাটির দেয়ালে, খড়ের ছাউনি দিয়ে ঢেকে রাখা। ঘরের কোণে একটা পুরনো ঢেঁকি, আর উঠোনে শুকোত রাঙা আলু। কুড়িওর মা প্রতিদিন সকালে গাছতলা থেকে কঞ্চি কুড়িয়ে আনতেন, আর বাবা ক্ষেতের মজুরি করতেন।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা — ওদের পরিবারসহ নরসিংডাঙ্গার প্রায় সব আদিবাসীরই বিশ বিঘা বা তারও বেশি জমি ছিল। শুনে অবাক হতাম। এত জমি, অথচ তারা ক্ষেতমজুর!
একদিন কুড়িওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
— “কাকা, তোমাদের এত জমি, চাষ করো না কেন?”
লোকটা একটু চুপ করে থেকে বললেন,
— “চাষ করব কী দিয়ে ? জমি তো গেছে। বন্ধক দিয়েছিলাম। এখন বাঙালিরা চাষ করে।”
আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে একদিন কুড়িও বলল,
— “দাদা, এক বোতল দেশি মদ দিলে জমি যায়। আমাদের লোকেরা সই করে দেয়। কে বুঝবে টিপসই মানে কী?”
আমি তখন কেবল দশম শ্রেণির ছাত্র, কিন্তু মনে হলো — এই অন্যায় ঠিক নয়।
তখন চারপাশে বাম শাসনের গৌরব, লাল পতাকা ও মিটিং-মিছিলের যুগ। আমি নিজেও রক্তে লাল রাজনীতির তেজ নিয়ে ঘুরি। মনের মধ্যে ন্যায়ের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে প্রতিদিন।
আমি কুড়িওকে বলতাম,
— “তোরা কেন চুপ করে থাকিস? জমি তোদের, কেউ কেড়ে নিতে পারে না।”
ও বলত,
— “কাগজ তো ওদের কাছে, দাদা। জমি ওরা চাষ করে, আমরা দেখি।”
আমি বলতাম,
— “কাগজ মিথ্যে। মাটি তোদের। মাটির গন্ধে তোদেরই নাম লেখা আছে।”
ও হাসত, একটু লজ্জা পেত, বলত,
— “তুমি বই পড়ো দাদা, আমরা তো কেবল মাঠ চিনি।”
তবু কথাগুলো ওর মনে গেঁথে গিয়েছিল — সেটা পরে বুঝেছি।
বছর গড়িয়ে গেল। আমি স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলাম, তারপর শহরে চাকরি।
আহিল থেকে দূরে, নরসিংডাঙ্গা থেকে আরও দূরে।
জীবন তখন রোজগার, সংসার, আর শহরের কংক্রিটের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে গেল।
কিন্তু কোথাও এক কোণে নরসিংডাঙ্গার সেই মাঠ, সেই মানুষগুলোর মুখ থেকে চোখ সরাতে পারিনি।
কখনও রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হতো — কুড়িও এখন কেমন আছে? ওরা কি এখনো অন্যের জমিতে মজুরি করছে?
তারপর একদিন, অনেক বছর পর, হঠাৎই আহিলে যাওয়া হলো।
কারণ বড় কিছু নয় — পৈতৃক ভিটেতে একটা পুরনো আমগাছ পড়ে গিয়েছিল, খবর পেয়ে ছুটে গেলাম।
গিয়ে দেখি, গ্রামটা আগের মতো নেই। কাঁচা রাস্তা এখন আধপাকা, দোকানে মোবাইল রিচার্জ হয়, আর পাড়ার ছেলেরা গেম খেলছে। তবু হাওয়ায় সেই চেনা ধানের গন্ধ।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে হাঁটতে বেরোলাম নরসিংডাঙ্গার দিকে।
বাঁশঝাড় পেরোতেই দেখি, গ্রামের চেহারা একেবারে পালটে গেছে। অনেক ঘরে টিনের ছাদ, কেউ কেউ পাকা ঘর তুলেছে। উঠোনে গরু বাঁধা, কাঁচা চুলায় ভাত ফুটছে। কোথাও ঢোল-মাদলের শব্দ, কোথাও শিশুদের হাসি।
আমি অবাক। এ তো সেই নরসিংডাঙ্গা নয়!
ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা গলা —
— “দাদা! তুমি না?”
পেছনে ফিরতেই চমকে উঠলাম। মাঝবয়সী একজন দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে মোটা গামছা, চোখে তেজ, মুখে হাসি।
চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু মনে পড়ছে না।
— “চিনতে পারছো না দাদা? আমি কুড়িও!”
আমি হতবাক।
— “তুই! কুড়িও! এ কী অবস্থা! তুই তো এখন গ্রামের নেতা দেখছি!”
ও হাসল,
— “তুমি একদিন বলেছিলে না দাদা, মাটির গন্ধই কাগজের চেয়ে বড়? সেই কথাটা মনে রেখেছিলাম।”
আমি হাঁ করে শুনলাম ওর গল্প।
বছর ছয়েক আগে ওরা নিজেদের জমির খোঁজ শুরু করে।
পুরনো দলিল, বন্ধকপত্র, কাগজ—সবকিছু একত্র করতে লাগল।
কেউ গ্রামের বাঙালি দখলদারদের কাছে গিয়ে কথা বলল, কেউ ব্লক অফিসে দরখাস্ত দিল।
কেউ পুলিশের কাছে গেলেও প্রথমে লাভ হয়নি। কিন্তু কুড়িও থামেনি।
একদিন ওর বাবার বন্ধক দেওয়া এক বিঘা জমি চাষ করতে শুরু করে ও নিজেই।
বাঙালি মালিক এসে গালাগালি করে, ভয় দেখায়। কিন্তু ওর গায়ে হাত দিতে পারেনি, কারণ গ্রামের প্রায় পঞ্চাশজন সাঁওতাল তখন ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
সেই থেকেই শুরু হল আন্দোলন।
পাঁচ বছর ধরে লড়াই। সভা, মিছিল, অভিযোগ, কাগজ, দলিল, গ্রাম সভা—সবকিছুতে কুড়িওর নাম উঠে আসতে লাগল।
অবশেষে ব্লক অফিসে তদন্ত হলো, দেখা গেল বন্ধক দেওয়ার মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু বছর আগেই, কিন্তু জমি ফেরত দেয়নি দখলদাররা।
তখন প্রশাসন নড়ল। ধীরে ধীরে জমি ফিরতে লাগল আদিবাসীদের হাতে।
আজ নরসিংডাঙ্গার সব পরিবার নিজের জমিতে চাষ করে। কেউ মদের বোতল দেখে টিপসই দেয় না। কেউ বন্ধক রাখে না।
কুড়িও বলল,
— “অনেক কষ্ট হয়েছে দাদা। কেউ বিশ্বাস করত না। গ্রামেরই কিছু লোক বলত, এইসব কিছু হবে না। কিন্তু আমি জানতাম, অন্যায়ের শেষ আছে।”
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। ওর চোখে তখন আলোর ঝলক, কণ্ঠে দৃঢ়তা।
আমি বললাম,
— “তুই তো পুরো বদলে গেছিস কুড়িও। এখন তুইই তো নেতা।”
ও হেসে বলল,
— “নেতা না দাদা, আমরা সবাই মিলে মানুষ হয়েছি।”
ওর সেই বাক্যটা আমার বুকের মধ্যে যেন বেজে উঠল—
‘মানুষ হয়েছি’।
সন্ধে নামছিল। মাঠে ধানের গাছের ফাঁকে হালকা বাতাস বইছিল, তার গন্ধে মিশে ছিল কুড়িওদের পরিশ্রমের ঘাম।
আমি বললাম,
— “তুই তো সত্যিই এক আশ্চর্য কাজ করেছিস রে। তোরই জন্য নরসিংডাঙ্গা আজ স্বাধীন।”
ও একটু চুপ করে থেকে বলল,
— “তবু দাদা, সব ঠিক নেই। এখন যাদের হাতে ক্ষমতা, তারাও আমাদের মতো করে শোষণ করছে। শুধু রঙ বদলেছে।”
আমি বললাম,
— “বাম আমলেও কি এমন ছিল?”
ওর চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণতা।
বলল,
— “ছিল দাদা। সবাই যদি চোর হয়, তাহলে চোর ধরবে কে?”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
এই এক কথার মধ্যে যেন গোটা সময়ের চিত্র লুকিয়ে।
ওর মুখে তখন কোনো রাগ নেই, কেবল অভিজ্ঞতার ঠান্ডা আলো।
আমি বুঝলাম — বঞ্চনা বদলায় না, শুধু মালিকের নাম বদলায়।
কখনও সে জমিদার, কখনও নেতা, কখনও সরকার।
আর নরসিংডাঙ্গার মানুষ বারবার নতুন করে শিখে নেয়, কীভাবে মাটি আঁকড়ে থাকতে হয়।
সেই রাতে আমি আহিলের বাড়িতে ফিরে ঘুমোতে পারিনি।
চোখ বন্ধ করলে কুড়িওর মুখ ভেসে উঠছিল।
আমার কৈশোরের সেই বন্ধুটি, যাকে একদিন আমি উস্কে দিয়েছিলাম — আজ সে ইতিহাস তৈরি করেছে।
কিন্তু মনের গভীরে একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল।
তখনকার আমি তো শুধু কথায় আগুন জ্বেলেছিলাম, পাশে দাঁড়াইনি। ওরা যখন লড়ছিল, আমি ছিলাম শহরে—কমফোর্টের মধ্যে, নিরাপদে।
আমার বিশ্বাস, কুড়িওর মধ্যে আমি নিজের এক হারানো অংশ দেখতে পাই।
যে অংশটা একসময় সমাজ বদলাতে চেয়েছিল, কিন্তু পরে সংসারের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল।
সকালে সূর্য উঠতেই আবার নরসিংডাঙ্গায় গেলাম।
কুড়িও তখন মাঠে হাল দিচ্ছে।
গরুর জোয়ালে ঝুলছে ঘণ্টা, তার শব্দে হাওয়া কাঁপছে।
ও আমাকে দেখে হাসল,
— “এসো দাদা। দেখো, এই মাঠে এখন ধান ফলবে।”
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ধানের চারা গাছের ফাঁকে সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে, যেন মাটির বুক থেকে নতুন ইতিহাসের অঙ্কুর গজাচ্ছে।
আমি বললাম,
— “তুই জানিস, তোর এই গল্প একদিন আমি লিখব।”
ও হাসল,
— “লিখো দাদা। যাতে মানুষ জানে, মাটি কখনো হারায় না।”
আজ বহু বছর কেটে গেছে।
আমি এখন শহরে থাকি, কিন্তু প্রায়ই মনে পড়ে নরসিংডাঙ্গার নাম।
যখন খবরের কাগজে জমি দখল, শোষণ, বা কৃষকের আত্মহত্যার খবর পড়ি, তখন মনে হয়—সেই কুড়িওদের কথাই আজকের দেশটাকে শেখাতে পারত কীভাবে মাটিকে ভালোবাসতে হয়।
নরসিংডাঙ্গা এখন অনেক এগিয়েছে।
ওখানে স্কুল হয়েছে, সরকারি অফিস হয়েছে, রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। কিন্তু আমি জানি, সেই আলোর শিকড়ে আছে কুড়িওর মতো এক মানুষের পরিশ্রম, সাহস আর অটল বিশ্বাস।
যেদিন শেষবার গিয়েছিলাম, ওর সঙ্গে বসে দুপুরের ভাত খেয়েছিলাম।
ধানের গন্ধে ভরা ভাত, আলু ভর্তা আর লাল মরিচ—সেই সরল খাবারের মধ্যে এমন এক স্বাদ ছিল যা কোনো শহরের হোটেলে পাব না।
খেতে খেতে ও বলল,
— “দাদা, তুমি শহরে থাকো, বড় বড় লেখাপড়া করেছো, কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—আমাদের মতো মানুষদের হাসিতে দেশটা টিকে আছে।”
আমি তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে।
সেই হাসি যেন নরসিংডাঙ্গার মাটির মতোই শান্ত, দৃঢ় আর চিরন্তন।
আজও আমি যখন সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকি, মনে পড়ে যায় কুড়িওর সেই কথা—
“সবাই যদি চোর হয়, তাহলে চোর ধরবে কে?”
কথাটা শুধু একটি গ্রামের নয়, গোটা সমাজের আয়না।
আমরা সবাই একটু করে সেই নরসিংডাঙ্গার মানুষ, যারা কখনও মাটির মালিক, কখনও তার মজুর, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটিই আমাদের আসল পরিচয়।
(সমাপ্ত)
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice
[…] শিশুর চাবি… বিশ্বনাথ সাহা […]
[…] আরও পড়ুন:-ভ্রমণ পিয়াসী : বিশ্বনাথ সাহা […]