Spread the love

#    নাট্যকাব্যঃ—–

# নারী বনাম কানীন

********************

কর্ণ||

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে
মাঝে কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গন,
ও পাশে পান্ডব শিবির,
এ পাশে কৌরবের।
মাঝে আমি একা দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ চারদিক আলোয় আলোময় হয়ে ঝলমল করে উঠল।
এ কী এত আলো কোথা থেকে এল?
চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে যে!
তাকানো যাচ্ছে না।
এ তো কোনও সাধারণ আলো নয়।
এ কী! এ যে যাজ্ঞসেনী!
একাকী দাঁড়িয়ে রণক্ষেত্রে।
এ যে যাজ্ঞসেনীর রূপের ছটা!
চারিদিকে আলোয় আলোময়।
হে পাঞ্চালী, তুমিও কি এসেছ আমার কাছে?
আমার মায়ের মতো!
পঞ্চ পান্ডবকে রক্ষা করতে রণক্ষেত্রে?
তোমার পঞ্চ স্বামীর জন্য?
না কি…………………
আমায় প্রেম নিবেদন করতে?
যে প্রেম অধরা ছিল এতদিন………
তোমার স্বয়ম্বর সভা গৃহ থেকে!
,শুধুমাত্র সূতপুত্র হবার অপরাধে?
ভাগ্য আমার সাথে সারাজীবন পাশার চাল চেলেছে,
আর আমি বরাবর পরাজিত হয়েছি।
কিন্তু নাথবতী তুমি কি আমার থেকে সেটা পেতে না?
যা তুমি পঞ্চ পান্ডবের থেকে পেতে চেয়েছিলে!
কুন্তী গর্ভে জন্ম আমার,
সূর্যদেবের ঔরসে।
আমি যুধিষ্ঠিরের ন্যায় ধার্মিক,
ভীমের ন্যায় শক্তিশালী,
অর্জুনের ন্যায় সাহসী বীর,
নকুলের ন্যায় অপরূপ,
সহদেবের ন্যায় বুদ্ধিমান।
তবুও তুমি কেন এইসকল গুণ
পাঁচজনের মধ্যে খুঁজতে গেলে?
চাইলে তো একজনের মধ্যেই পেতে পারতে!
পঞ্চ নাথবতী হয়েও কি তুমি অনাথ নও?
পেরেছে কি তোমার স্বামীরা তোমায় রক্ষা করতে?
সম্মান দিতে?
স্বামীর দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে?
তাহলে কেন পাঞ্চালী কেন?


দ্রৌপদী।।

হে কর্ণ,আমি তোমার কাছে এসেছি
কোনও আবেদন নিয়ে নয়।
এসেছি তোমার অধিকার ফেরত দিতে।
তোমার প্রাপ্য অধিকার কেউ দেবে না,
না পান্ডব,না কৌরব।
কৌরব তো তোমার শৌর্য, বীর্য কে শুধু ব্যবহার করেছে,
তোমায় সম্মান দেয় নি।
এই মহাভারতে আমরাই দুজন,
যারা নিজেদের মেধা দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছি।
সম্পুর্ণ ভাবে,নির্দোষ,নির্লোভ ভাবে।
তবুও বারেবারে ভাগ্যদেবীর প্রসন্ন দৃষ্টি হতে বঞ্চিত।
ভাগ্য বারেবারে আমাদের রিক্ত করেছে।
কৌরব পান্ডবদের এই যুদ্ধ তো তাদের সম্পত্তি লালসার ফল,
তাদের ভোগদখলের অভিলাষ।
তবুও বারেবারে কেন আমাকেই দায়ী করা হচ্ছে, রাধেয়?
কেন যুদ্ধ বাধানোর সব দায় আমার ওপর বর্তাচ্ছে?
ইতিহাস কি আমায় মনে রাখবে
বংশের ধ্বংসকারী নারী হিসেবে?


কর্ণ ||

হে পাঞ্চালী, আমি স্তম্ভিত।
একদিন যার নারীত্বের অধিকার হরণ করার চেষ্টা করেছি,
আজ সেই নারী এসেছে আমায় অধিকার ফিরিয়ে দিতে?
ক্ষমা করো হে সুন্দরী, হে প্রিয়ে,
যদি কারুর প্রতি কোনও অন্যায় জীবনে করে থাকি,
সে হলে তুমি।
তোমাকে এককালে পতিতা বলেছিলাম,
আজ অনুতপ্ত হৃদয়ে নিঃস্বার্থভাবে ক্ষমা চাইছি,
পারবে কি আমায় ক্ষমা করতে?


দ্রৌপদী ||

হে রাধেয়, হে জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়,
সেদিনের তোমার জিহ্বার ধার চিনতে আমার ভুল হয় নি,
সে তো তোমার ব্যর্থ প্রেমের নিস্ফল আস্ফালন।


কর্ণ ||

হে কৃষ্ণা, তুমি মানবী? না দেবী?
না কি অন্তর্যামী?
কি করে বুঝলে সে আমার ব্যর্থ প্রেম?
সত্যি ই যে তাই………..
আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে
আমার স্বীকার করতে কোনও কুন্ঠা নেই
আমি যে শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি।


দ্রৌপদী ||

হে জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়,
ভুল যে আমিও করেছি,
ক্ষমা করো,
পারবে কি করতে?
সূতপুত্র ভেবে ভুল করেছি তোমায়!
তোমার শৌর্য বীর্য কে সম্মান না করে!


কর্ণ ||

যাজ্ঞসেনী,আমাদের পরস্পরের ভুলই তো
তৈরি করেছে মহাভারত।
আমার অধিকারের কথা ভেবো না পাঞ্চালী,
আমি দানবীর মহারথী কর্ণ।
জন্ম থেকে দানকেই আমি জীবনের প্রধান কাজ
হিসেবে জেনে এসেছি।
মাতৃস্নেহও দান করেছি পান্ডবদের।
আজ এখানে দাঁড়িয়ে তাদের বিজয়পথ রচনা করতে চলেছি।
আমার জীবন দানের মাধ্যমে তৈরি  হবে তাদের বিজয়রথ।
বৃথা ভয় পেও না কৃষ্ণা,
যুদ্ধ কেন হচ্ছে সে উত্তর দেবে ইতিহাস।
তার দায় বা দায়িত্ব তোমার বা আমার ওপর নয়।
তুমি হবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে নারীত্বের প্রতীক,
জগতের সব নারীর প্রতিনিধি।
হাজার হাজার বছর পরও হয়তো ভারতবর্ষ থাকবে,
থাকবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।
তখনও হয়তো নারীই হবে
প্রতিশোধের একমাত্র বিষয়,একমাত্র স্থান,
পৌরুষ প্রদানের স্থান।
সব কৃষ্ণার পাশে কিন্তু কৃষ্ণ থাকবেনা কৃষ্ণাসখা হয়ে।
সব কৃষ্ণাকে বস্ত্র জোগানোর দায়
হয়তো কোনও কৃষ্ণ নেবে না।
সব কৃষ্ণা কৃষ্ণ কে পাবে না বস্ত্র হরণের সময়।
তুমিই হবে সব কৃষ্ণার জ্বলন্ত উদাহরণ।
তোমার জীবনকে পাথেয় রেখে
পরবর্তী যুগের কৃষ্ণারা নিজের জীবনে লড়াই করবে,
নিজেদের অধিকার আদায় করবে
দুর্যোধন, দুঃশাসন এর বিরুদ্ধে।


দ্রৌপদী ||

আর তুমি?  কর্ণ?


কর্ণ ||

আমি হব আপামর ভারতবাসীর প্রকৃত চিত্র,
আমিই হলাম সর্বহারা।
হাজার হাজার বছর পরও সূর্যদেবেরা নিজেদের দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে চলবেন,
হাজার হাজার বছর পরেও মা কুন্তীর মতো
আরও অসংখ্য মা থাকবেন,
যাঁরা সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে
বাধ্য হবেন তাদের কর্ণকে ত্যাগ করতে,বিসর্জন দিতে,
সেই সব কর্ণের পরিচয় গোপন করতে।
আমিই হব সেই পিতৃ-মাতৃহীন কর্ণ দের প্রতিনিধি।
তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে তাদের মনে বেঁচে থাকব।
তারাও আমার মতই প্রমাণ করে দেখাবে যে
জন্ম নয়,কর্মই হল মানুষের আসল পরিচয়।
তারাও প্রমাণ করে দেবে যে
সবলের ক্ষমতা প্রদর্শন দিয়ে
মেধাকে চেপে রাখা সম্ভব নয়,
সত্যের প্রকাশ হবেই।
প্রখর সূর্যকিরণের ন্যায় ছড়িয়ে পড়বে
এইসব নামগোত্রহীন, কৌলীন্য, বংশপরিচয় হীন
প্রকৃত মেধার ঔজ্জ্বল্য নিয়ে
হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কর্ণ’রা।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *