জগন্নাথদেবের রথযাত্রা :ইতিহাস ও তাৎপর্য
অভিজিৎ দত্ত (জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ)
রথযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত হিন্দুদের একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ভারতের ওড়িশায়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। যদিও ভারতবর্ষের মধ্যে রথযাত্রা বিখ্যাত ওড়িশার পুরীতে।এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা,কোলকাতার ইস্কনের রথযাত্রা বা বাংলাদেশের ধামরাহা রথযাত্রা বিখ্যাত। ২০২৫ সালে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ২৭শে জুন শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে।প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা শুরু হয়।এই রথযাত্রায় ভগবান জগন্নাথদেবের সঙ্গে থাকেন ভাই বলভদ্র ও বোন সুভদ্রা। এই তিনটি রথ একসঙ্গে বের হয়।কথিত আছে বোন সুভদ্রা দাদা শ্রীকৃষ্ণকে বাইরে বেরাতে যাবার বায়না করলে শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রা ও বড় ভাই বলরামকে রথে করে নিয়ে মাসির বাড়ি যান। সেখানে সাতদিন থেকে আবার ফিরে আসেন।এই যাওয়াকে সোজা রথ ও ফিরে আসাকে উল্টোরথ বলে। ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় রথগুলোকে বিশেষভাবে সাজানো হয়। ভগবান জগন্নাথদেবের রথের নাম নন্দিঘোষ। রথটি লাল ও হলুদ রঙের হয়।উচ্চতা প্রায় ৪৫ফুট। এটি শুধুমাত্র নিমকাঠ দিয়ে তৈরী হয়।অক্ষয় তৃতীয়া থেকে এর প্রস্তুতি শুরু হয়।রথটিতে ১৬টি চাকা রয়েছে।বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। যার উচ্চতা প্রায় ১২,৯ মিটার। সুভদ্রার রথের নাম দেবদলন। এর উচ্চতাও প্রায় ১২,৯ মিটার। ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে ওড়িশার পুরীতে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়।এই উপলক্ষ্যে পুরীতে প্রতিবছর প্রচুর মানুষের বা ভক্তদের সমাগম হয়।টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়।রশি দিয়ে রথগুলোকে চালানো হয়।কথিত আছে এই রশি দিয়ে রথ টানলে মানুষ মোক্ষ লাভ করে।ভগবান জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে ভক্তদের দুঃখ, কষ্ট দূর হয়।আরেকটা ধারণা আছে রথযাত্রায় দান করলে অক্ষয় ফল লাভ হয়।কেউ বলেন রথযাত্রায় বেরালে ভক্তদের ইচ্ছাপূরণ হয়।যাইহোক রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর মানুষ বা ভক্তদের যেমন সমাগম হয় তেমনি এই উৎসব উপলক্ষ্যে অনেক জায়গাই মেলা বা অনুষ্ঠান হয়।জগন্নাথকে বলা হচ্ছে জগতের নাথ বা প্রভু।জগন্নাথদেবের মূর্তি নির্মাণ নিয়েও কাহিনী আছে।শ্রীকৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুকে স্বপ্নাদেশ দেন যে সমুদ্রে যে কাষ্ঠখন্ডটি ভেসে আসছে সেটি থেকে যেন তার মূর্তি নির্মাণ করা হয়।রাজা কাষ্ঠখন্ডটি পেলেও মুর্তি নির্মাণের জন্য রাজা কাউকে না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন তখন এক বৃদ্ধ শিল্পী রাজার সঙ্গে দেখা করেন ও ঐ কাষ্ঠ থেকে মূর্তি নির্মাণ করতে রাজী হন। তবে শর্ত দেন যতদিন মূর্তি নির্মাণ না হচ্ছে ততদিন মন্দিরের অভ্যন্তরে নির্জনে কাজ করবেন ।কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না।দিন সাতেক পর রাজা তার স্ত্রীর কথায় মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করলে শিল্পী অদৃশ্য হন।তিনি ছিলেন দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা।মূর্তি অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় ছিল। অর্থাৎ মূর্তির হাত ও পা নির্মাণ বাকী ছিল। রাজা যখন অনুশোচনা করতে থাকেন তখন দেবর্ষি নারদ আবির্ভূত হন ও রাজাকে বলেন এটাই পরমেশ্বরের ইচ্ছা ছিল। এই হচ্ছে জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নির্মাণের ইতিহাস।আসলে শ্রীকৃষ্ণ কলিযুগে জগন্নাথ হয়ে এসেছেন আমাদের উদ্ধার করতে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ আছে।রথ হচ্ছে আমাদের শরীর বা ইন্দ্রিয়। বিগ্রহ হচ্ছে মন।রশি বা দড়ি হচ্ছে বিবেক। এই বিবেক যদি জগন্নাথ হয় তাহলেই সংসারের মঙ্গল। কিন্ত বিবেক যদি আসুরিক প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয় তাহলেই হবে সমাজ বা সংসারের অমঙ্গল। আর কলিযুগে এই আসুরিক প্রবৃত্তি এতই বেড়ে গেছে যে সমাজ ও সংসারে অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় তার কাছে একটাই প্রার্থনা তার আর্শীবাদে মানুষের মধ্যে যেন প্রকৃত মনুষ্যত্ব ফিরে আসে।মানুষ যেন রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারে।এটা যেন নিছক আনন্দ বা চিত্ত বিনোদনের অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়।তবেই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা হবে সার্থক। জয় জগন্নাথ।
#রথযাত্রা #জগন্নাথদেব #পুরীর_রথযাত্রা #হিন্দুধর্ম #ভারতীয়_উৎসব #ইতিহাস #ধর্মীয়_উৎসব #রথযাত্রার_তথ্য #বিশ্বকর্মা #সুভদ্রা #বলরাম #জয়_জগন্নাথ #রথযাত্রা_২০২৫