তবু চাঁদ নজরে –<< খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
তবু চাঁদ নজরে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
সংরক্ষণের প্রশ্ন নিয়ে গোটা কলেজ চত্বর ছাত্র বিক্ষোভে উত্তাল। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। খবর পেয়ে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে SDPO জিয়াউর রহমান, Additional SP দীপক বর্মন,ও DSP গৌতম ঘটক এসেছেন কলেজ গেটে। কিন্তু অধ্যক্ষ ডঃ নির্মাল্য বাগচী কলেজে পুলিশের ঢোকার অনুমতি দেননি। তাঁর বক্তব্য পুলিশ ঢুকলে অবস্থা আরও ঘোরালো হবে। কার মাথায় লাঠি পড়বে ঠিক নেই। সেটা নিয়ে ধর্ম ভিত্তিক ও জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির আগুন দাবালনের মতো আরও বহুদূর ছড়িয়ে পড়বে। তাই তিনি নিজে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সহকর্মীদেরকে নিয়ে এবং দলমত নির্বিশেষে কলেজের ছাত্র সংগঠনগুলির সক্রিয় সভ্যদের নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করছেন। টেলিফোনে শিক্ষাদপ্তরের কর্তাদেরকেও জানিয়েছেন ও ঘটনাস্থলে তাঁদেরকেও আসতে অনুরোধ করেছেন।
কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। ছাত্রছাত্রীরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেছে। একদল বলছে (১) ধর্ম বা জাতপাত দেখে নয়, অর্থনৈতিক ভিত্তিতে হরিজন–ব্রাহ্মণ–শেখ–সৈয়দ–গাজী–কাজী–মুখার্জী–চ্যাটার্জী–গায়েন–বর্মন নির্বিশেষে সব গরীব ছাত্রছাত্রীদেরকে সমহারে পড়াশুনার জন্য আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। তাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো, “আমরা স্যার কোন জাতপাত, বা ধর্ম বুঝি না, কোন টাইটেল বুঝি না, আমরা বুঝি আমরা যারা বঙ্কিমের হাসিম শেখ–রামাকৈবর্ত্য–রামধনপোদ–শরৎচন্দ্রের গফুর শেখ–আমিনা–কাঙালীচরণ–তারাশঙ্করের “অগ্রদানী” পূণ্য চক্রবর্তী–মুন্সী প্রেমচাঁদের সদ্গতির দুঃখী, জসিমুদ্দিনের নক্সিকাঁথার মাঠের সাজু–রূপাই কিংবা রবীন্দ্রনীথের আব্দুল মাঝি–রহমত কাবুলি–উপেন–কেষ্টাদের উত্তরসূরী ,তারাই পাবে সংরক্ষণের বিশেষ সুযোগ, আর্থিক সহায়তা, পড়াশুনা, চাকরি বাকরি, পদোন্নতি সব ক্ষেত্রে। গলায় সোনার চেন খাটিয়ে, জাতপাতের দোহাই পেড়ে আলালের ঘরের দুলালদের একটি পয়সাও,একটিও বিশেষ সুযোগ নিতে দেবো না।”
—-একদম ঠিক কথা বলেছিস করিম।
তার চার পাশ থেকে আওয়াজ উঠলো।
(২) অন্যদিকে আর একদল ছাত্রছাত্রী চীৎকার করে বলছে যে অর্থনৈতিক ভিত্তি কোন ভিত্তিই নয়। “বাবা সাহেব” আম্বেদকর বহু লড়াই করে গান্ধীজী — আজাদ –রাধাকৃষ্ণান–ভি. ভি. গিরি–জাকির হোসেন– সোমনাথ লাহিড়ী–পি. সি. যোশী–মোজাফ্ফর আহমেদ–কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের বিরোধীতাকে উপেক্ষা করে SC/ST দের জন্য অর্থাৎ আমাদের জন্য যে জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণের সুযোগ শিক্ষা–চাকরি–পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে করেছেন, তা আমরা চাই’ই। একচুলও নড়বো না এর থেকে।
পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে লাগলো। অপর পক্ষ থেকে উত্তর এলো কোন “বাবা সাহেব, কাকা সাহেব বুঝি না,” কোন ব্রাহ্মণ্যবাদ বা কৌলিন্যবাদ বুঝি না, তেমনি কোন ধর্মবাদ বা জাতপাত বাদও বুঝি না। এদেশ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, মুসলিম, বৌদ্ধ, জৈন খৃশ্চান সবার। অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে বিশেষ সুযোগ চাই। কোন বর্ণ ভিত্তিক সুযোগ, বড় লোকের দুলাল হয়েও, গলায় সোনার হার, হাতে হীরের আংটি পরে কাউকে আর সুযোগ নিতে আমরা দেব না। বা ধর্ম ভিত্তিক সুযোগ ও না।
–সুযোগ নিতে দিবি না মানে? এটা আমাদের সংবিধানিক অধিকার।
–সেটা জানি। তাই তো এই লড়াই সব গরীব মানুষদের ছেলে মেয়েদের।
–তোরা শালা সব বর্ণ হিন্দু, বর্ণ মুসলমানের ব্যাটা! তাই তোদের এত জ্বালা।
–না বৎস। আমরা কেহ তাহা নহি। আমরা সবাই মানুষ, গরীব মানুষের বাচ্চা, গফুর শেখ, রামধন পোদ, পূণ্য চক্রবর্তী, কাঙালী চরণ, দুঃখী, উপেনদের বাচ্চা। তোরা যারা ঐ “বাবা”র দোহাই পেড়ে বেকুবের মতো সোনার অর্নামেন্ট পরে জাত ভিত্তিক সংরক্ষণের কোটায় সরকারী অর্থ তুলে মাল খাস, তাদের পাছায় লাথি দিতে আমরা পথে নেমেছি। তোদের জন্যই তো দিকে দিকে বর্ণহিন্দু দের মধ্যে এবং মুসলিমদের মধ্যে সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। ভেবে দেখেছিস যে দেশটা আজ কোথায় চলে যাচ্ছে?আমাদের মধ্যে দেখ তো চেয়ে কোন গরীব মানুষের ঘরের বামুন– কায়েত–মুচি–মেথর–বেনে–মুসলিম–খৃশ্চান নির্বিশেষে পেটে ভাত না থাকা ছেলে মেয়েরা নেই? তোরা হারামজাদারা সমাজের বড়লোক ঘরের গোটা কতক মালখোর জাতপাতের নামে কায়েমী স্বার্থের দালাল। তোরা তো সংখ্যালঘু। আমরাই, এই গরীবের ব্যাটারাই তো majority। তোদেরকে আর জাতপাতের নামে মধু চুষতে দেবো না।
পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে অথচ অধ্যক্ষ তাঁদেরকে কলেজের মধ্যে ঢুকতে দিচ্ছেন না দেখে এবার পুলিশ কর্তৃপক্ষ সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে, কলেজ ঘিরে ফেলে, লাঠি ও বন্দুক প্রস্তুত করে মাইক ধরলেন–
আমি Additional SP দীপক বর্মন বলছি: আপনারা শান্ত হোন। দয়া করে আমার, আমাদের DSP সাহেব মিস্টার গৌতম ঘটকের ও SDPO সাহেব মিস্টার জিয়াউল রহমানের আবেদনটা একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুন। আমার টাইটেল শুনেই বুঝতে পারছেন আমি একজন তথাকথিত SC ঘরের সন্তান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। আমি ,কিন্তু সংরক্ষণের জোরে এই পদে আসিনি। বাবা মাছ ধরে আমাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি বরাবর জাতপাত ও ধর্মভিত্তিক সংরক্ষণকে ঘৃণা করতাম এবং আজও করি। আমি ধর্ণশোষণ, লিঙ্গগত শোষণ, গায়ের রংগত শোষণ, ধর্মগত শোষণ, সব শোষণকেই ঘৃণা করি। আমি আম্বেদকরও পড়েছি, গান্ধীজীও পড়েছি, ডঃ রাধাকৃষ্ণানও পড়েছি, আবার পি. সি. যোশী, সোমনাথ লাহিড়ী, মুজাফ্ফার আহমেদও পড়েছি, পড়েছি মহারাষ্ট্রের কিম্বদন্তী সমাজ সংস্কারক জ্যোতিরাদিত্য ফুলে–সাবিত্রী বাঈ ফুলে–ফতেমা শেখ–এঁদের সবার চিন্তা ভাবনা পড়েছি। সবাই, একমাত্র আম্বেদকর ছাড়া, নিজ নিজ ভঙ্গিতে ন্যায় বিচার বা সবার কল্যাণের কথা বলেছেন । রাধাকৃষ্ণান, আজাদও তাই। কমিউনিস্ট নেতা যোশী–লাহিড়ী–আহমেদরা,কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, নাজিম হিকমত শ্রেনীহীন শোষণহীন সমাজের কথা বলেছেন । ফুলে দম্পতি ও ফতেমা শেখ জাতপাতগত বৈষম্যের অবসান চেয়েছেন ও সবার সমানাধিকার চেয়েছেন, এঁরা কেউ কিন্তু জাতপাত বা ধর্মগত সংরক্ষণের কথা বলেননি। একমাত্র আম্বেদকর বর্ণগত শোষণের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জাতপাতগত সংরক্ষণের কথা বলেছেন ধনী নির্ধন নির্বিশেষে। কার্যতঃ
তিনি আর এক বর্ণগত শোষণের সূত্রপাত করেছেন।
শরৎচন্দ্র–বঙ্কিমচন্দ্রের গফুর শেখ–হাচিম শেখরা উচ্চবর্ণের মুসলিম হবার জন্য কিংবা তারাশঙ্করের অগ্রদানী পূণ্য চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ হবার জন্য তাদের সন্তানরা কোন সংরক্ষণের সুযোগ পাবে না তাঁর তত্ত্ব অনুযায়ী।অথচ সোনার গহনা পরা বড় লোকের ছেলেমেয়েরা তথাকথিত SC সম্প্রদায়ে জন্মের সুবাদে সেই সুযোগ পাবে তাঁর বিধানে ।এটা অনৈতিক, অমানবিক ও অবৈজ্ঞানিক। আর একটা কথা। সংবিধানে অনেক কথা লেখা থাকে। কিন্তু মানুষের লড়াই আন্দোলনের ফলে তার সংশোধন হয়। আমাদের দেশের সংবিধানের মধ্যেই সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার ছিল। এদেশের জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল গরীব মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলে মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে সেটি বাদ গেছে। সুতরাং সবই সম্ভব। সংবিধানের মধ্যে যে জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা আছে, তাকেও সংশোধন করা সম্ভব।করা দরকারও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণে, দেশের ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনে।আজকের এই বিক্ষোভ তারই পূর্বাভাষ। অর্থনৈতিক ভিত্তিক সংরক্ষণ হলে আপত্তি কেন? অসুবিধা কোথায়? আসলে আপত্তি তথা কথিত নিম্নবর্ণভুক্ত কিছু উচ্চ বিত্তবান লোকদের থেকে । অসুবিধা ওই মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর লোকদের । অর্থনৈতিক ভিত্তিক সুরক্ষা মূলক বৈষম্য বা protective discrimination হলে তো হিন্দু–মুসলিম–ব্রাহ্মণ–হরিজন সব গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরাই জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমান সুযোগ পায় এবং আলালের ঘরের দুলালগুলো বাদ পড়ে। তাদেরকে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হবে কোন যুক্তিতে? আজকের এই শিল্পায়ণ ও নগরায়ণের যুগে মধ্যযুগীয় জাতপাতের ধারণার কোন প্রাসঙ্গিকতা আর আছে কি? এখন তো গরীবশ্রেনী আর ধনীক শ্রেনীর মুখোমুখি সংঘর্ষের যুগ। গরীব শ্রেনীই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের একটাই জাত,তারা শ্রমজীবি,তারা শোষিত।কাজেই তাদের স্বার্থেই ধর্ম বা জাতপাত ভিত্তিক নয়, অর্থনীতি ভিত্তিক সংরক্ষণ করতে হবে।
Additional SP র এই বক্তৃতার পর অন্য দুই আধিকারিকও এক লাইনে বলে দিলেন যে “আমাদেরও ঐ একই কথা।”
মাইক বন্ধ হোল। যাদুমন্ত্রের মতো কলেজ চত্বর শান্ত হয়ে গেল।
কলেজ গেটের অদূরে রিক্সাওয়ালা বৃদ্ধ কাসেম শেখ রিক্সায় বসে এতক্ষণ অফিসারদের বক্তৃতা শুনছিল। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়ার সন্ধানে গাড়ীটা ঘুরিয়ে আপন মনে বললো সাহসী মায়ের বেটা বটে! তাই তো কথায় বলে আকাশে জমাট মেঘ ,তবু চাঁদ নজরে।
Campus ফাঁকা হতে লাগলো। পাশের উত্তম সেনের জেরক্সের দোকানে তখন শুরু হয়েছে পল রবসনের ইংরেজী ভাষায় মূল গান “Old Man River”,এর পাশাপাশি ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে ঐগানেনের ই কথা ভেসে আসছে ছাত্র সংসদের অফিস থেকে
——-বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও
নিঃশব্দে নীরবে
ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত