Spread the love

বর বদল

বাবুর আলী। মিনাখা, উত্তর ২৪ পরগণা।

 গ্রামের পশ্চিমদিকে ধেনো জমির মাঠ। ধান কাটার পরে সারা বছর সেখানে আর কোনো রকম চায় হয় না। রোদে জলে ধানের গোড়াগুলি শুকিয়ে নুইয়ে পড়ে, তারপর জল পেলে, কচি কচি সবুজ ঘাস জন্মায়।

তখন মনে হয় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ গালিচা কারা বিছিয়ে রেখেছে। তখন গ্রামের সব বাড়িতে গোরু বাছুর থাকতো। সকালে গোরু গুলোকে মাঠে ছেড়ে রাখা হতো। সন্ধ্যাবেলা রাখাল গোরুগুলিকে তাড়িয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনত। সারাদিন গোরু ছাগল ঘাসে চড়ে বেড়াত। সন্ধ্যাবেলা গাঁয়ের লোকেরা সবুজ ঘাসের উপরে বসে গল্পগুজব করেতা গরমের দিনে দখিণা হাওয়া গায়ে গালাত। গরিব ঘরের মেয়েরা গোবর কুড়িয়ে ঝুড়িতে বোঝাই করতো। কোথাও কোথাও ছেলেরা দলবেঁধে খেলাধূলা করতো। বড়রা বসে তাদের খেলা দেখত। 

তিনজন কিশোর কিশোরী দলবেঁধে একসাথে প্রতিদিন মাঠে খেলা করতো। ছোটো ছোটো ঘাসের রঙিন ফুল তোলা তা নিয়ে ঝগড়া করা আবার ভাব করা এই ছিল নিত্যদিনের কাজ। সন্ধ্যা হলে যে যার ঘরে ফিরে আসতো। ওরা, আব্দুল, গফুর ও লুৎফা। তিনজন প্রায় সমবয়সি। আব্দুল ধনী চাষী পরিবারের ছেলে। গফুর গরিব চাষি পরিবারের লুৎফাও গরিব পরিবারের মেয়ে। আব্দুল স্কুলে পড়ে সন্ধ্যাবেলা গৃহশিক্ষক এসে পড়ান। গফুর ইস্কুলে যায় কিন্তু গৃহশিক্ষক রাখার পয়সা তার বাবার ছিল না। লুৎফা মায়ের কাছে আরবি পড়ে।

আরবি বর্ণ পরিচয়কে কায়দা বলে। লুৎফা কায়দা শেষ করে কোরান পড়া শিখেছে। রান্নাবান্না সেলাই মায়ের হাতের সব কাজ সে শিখে নিয়েছে।

আব্দুল এর বাবা গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি। গ্রামের মাতব্বর সবাই খোদাবক্স মিয়াকে ভক্তি করে ভয় করে। চলনে বলনে তার আভিজাত্য প্রকাশ পায়।

গফুর ও লুৎফার বাবারা অতি সাধারণ গরিব চাষী পরিবারের লোক। দুই পরিবারের মিত্রতা সবার জানা। দুই পরিবার তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে চলে। দুই বাড়ির যাতায়াত অবাধ। ছোটরা ধনী-দরিদ্র্যের বিভেদ বোঝেনা। আব্দুল গফুর ও লুৎফার শিশুমনের বন্ধুত্ব অটুট। তিনবন্ধু প্রতিদিন সময় পেলেই মাঠে খেলতে বেরিয়ে পড়ে কেউ তাদের মানা করেনি। সময় এগিয়ে চলে। আব্দুল স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে। পোশাকে আশাকে ধনীর দুলাল এর বহিঃপ্রকাশ। চুলের বাহার কথাবার্তায় আধুনিকতার ছাপ।

গফুর পড়া ছেড়ে বাবার চাষের কাজে সাহায্য করে। হল বল লাঙ্গল জোঁয়াল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সে গ্রামের সবাইকে কিছু কিছু সাহায্য করে। কোন মৃত বাড়ি সে বাঁশ কাটা থেকে কবর খোঁড়া সব কাজে আগে ছুটে যায়। কারও অসুখ বিসুখ হলে হাসপাতালে যাওয়া তার কাজ। কাজের বাড়িতে সে পরিবেশক সবাই তাকে ডেকে নেয়।

লুৎফা এতদিনে বুঝে গেছে যে সে আর ছোটো নেই। মা তাকে শাড়ি পরা ধরিয়েছে যখন তখন বাইরে যেতে নিষেধ করেন। আব্দুল গফুরের বিষয়ে আলাদা বাড়িতে তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রাস্তায় বা মাঠে যাওয়া মানা। মা তাকে বারবার মাথায় কাপড় দিয়ে রাখতে ধমক দেন। দেখতে দেখতে সে খুব সুন্দরী হয়ে উঠেছে, এর রাশ রূপ যেন তার চোখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে। বাবা তাকে একজোড়া করে শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ কিনে দিয়েছিলেন। আব্দুল গফুররা নিয়মিত আসে বারান্দায় বসে গল্প গুজব করে, আব্দুল অনেক গল্প জানে তার কলেজের গল্প বন্ধু-বান্ধবীদের গল্প, সিনেমা দেখে এসে সব গল্প বলে। লুৎফা গফুর খুব মন দিয়ে সে সবকিছু শোনে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে মা তাড়া দেন, তাদের আসর ভেঙ্গে যায়। একদিন গফুর কথার মাঝে বলে উঠলো তুই খুব সুন্দর হয়েছে আমার খুব ভালো লাগে তোকে। লুৎফা বিব্রত হয়ে পড়ল একটু সামলে নিয়ে বললো তোর কলেজের সুন্দরী মেয়ে নেই তাদের কাউকে ভালো লাগে না। 

লাগে কিন্তু তোকে ভালোলাগাটা অন্য রকম। লুৎফা বলল আসলে আমরা সবাই সবাইকে ভালোবাসি। সারাদিন চাষের কাজের খাটুনির পর গফুর ভাই সময় পেলেই ছুটে আসে, আমাদের ভালো না বাসলে আসতো? গফুর বললো লুৎফার বিয়ে হয়ে গেলে আর আমাদের সঙ্গে দেখা হবে না ওর বর আমাদের সঙ্গে কথাই বলতে দেবে না। লুৎফা লজ্জিত হয় আবার মনের কোথায় যেন একটা ব্যথা অনুভব করে।

এমনি ভাবেই চলছিল, গ্রামে কিছু কঠিন লোক থাকে গল্পের ছলে তারা অন্যের কিছু দুর্নাম করতে ভালোবাসে। একজন বৃদ্ধ মহিলা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির খবর সে বাড়ি নিয়ে যায় তার নাম ঝড়ি। সে লুৎফার মাকে বলল। বহু কেমন আছো মা উত্তর দিলেন এই আছি এরকম তুমি ভালো আছো। এ কথা সে কথায় ঝড়ি বলল একটা কথা বলব দিদি তোমার মেয়ের বয়স দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে অতো মেলামেশা করা ভালো নয় ওই আব্দুল ছেলেটার মতি গতি ভালো নয় সে সিনেমা দেখে কলেজে যায় কলেজের ছেলে গুলো ভালো নয় তুমি একটু সাবধান হও দিদি পাড়ার লোকে ৫ কথা বলছে। লুৎফার মা বলল না ঝড়ি ওরা সব আমার ছেলে মেয়ের মতো ছোটবেলাতে একসঙ্গে মানুষ ওসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। ঝড়ি গজ গজ করতে করতে চলে গেল। 

সেদিন রাতে লুৎফার মা তার স্বামীকে বললেন, আমাদের লুৎফার বয়স হয়েছে ও দেখতেও সুন্দর হয়েছে ওর এবার একটা বিয়ে-শাদির কথা ভাবো আমাদের ঘরে বেশি বয়স হলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া খুব অসুবিধা হয়। লতিফ মিঞা বললেন, ভাবছি তো ভেবে রেখেছি তোমাকে বলা হয়নি আমি একটা ছেলে ঠিক করে রেখেছি। মা আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলেন কি ঠিক করে রেখেছো আমাকে বলবে না? আমি কি লুৎফার মা-না সব দায়িত্ব কি তোমার একার। বাবা বলেন বলছি বলছি সব বলছি তুমি কিছু মনে কোরো না ছেলে আমাদের ঘরেই আছে। গফুরের বাবা আমার ছোটবেলার বন্ধু অনেকদিন ধরে আমাদের ঠিক আছে আমরা কুটুম্বিতা করব। গফুর আমাদের ছেলে ও খুবই ভালো। ভাবছি কথাটা তাকে এবার বলতে হবে। আমি কালই ঘটক পাঠিয়ে দেবো। পরদিন থেকে বাড়িতে বিয়ের আলাপ আলোচনা শুরু হলো। ও বাড়ির সম্মতি পেয়ে এ বাড়ির মুরুব্বিরা দলবেঁধে ছেলে দেখতে গেল। লুৎফা মনে মনে হাসে আর ভাবে দেখা ছেলে আবার দেখতে হবে কেন সে মনে মনে খুব খুশী হয়। ছেলে দেখা শেষ করে সবাই ফিরে এসেছেন এবং ও বাড়ির লোকদেরও আসতে নিমন্ত্রণ করেছেন। এ দিকে লুৎফার ছেলেবেলার দুই খেলার সাথী খবর শুনে এদিকে কেউ আর আসে না। সেটা লুৎফার মনে খুব খারাপ লাগে। গফুর না হয় লজ্জায় এদিকে আসতে পারছে না, আব্দুলের কি হলো, সেকি মনে ব্যথ্যা পেয়েছে? লুৎফার মনে আব্দুলের জন্য মায়াও কম নয়। লুৎফা দুজনেরই পথ চেয়ে থাকে। নির্দিষ্ট দিন ও বাড়ির মরুব্বীরা দলবেঁধে মেয়ে দেখতে এলেন। অনেক মিষ্টি মিঠাই নিয়ে এসেছেন গফুরের দুলাভাই। তিনি খুব সুন্দর দেখতে শিক্ষিত সুপুরুষও বটে। সবাই হাত পা ধুয়ে পাতা আসনের উপর বসে পড়লেন। পাশের বাড়ির ভাবি এসে লুৎফাকে সাজিয়ে সবার সামনে ঘোমটা দিয়ে বসিয়ে দিলেন, দুলাভাই প্রশ্ন করতে লাগলেন, তোমার নাম কি কতদূর পড়েছ তোমার নানার বাড়ি কোথায় তোমার দাদুর নাম কি এই সব। শুধুমাত্র মিষ্টি লুৎফার হাতে দিয়ে বলল তুমি এবার ঘরের ভিতরে যাও। লুৎফা পালিয়ে বাঁচল। মিষ্টি, ফল, পান ইত্যাদি পরিবেশন করা হলো। তারপর সবাই মিলে পঞ্জিকা দেখে একটা বিয়ের দিন স্থির করলো সবাই। উভয় পক্ষ বিয়ের আয়োজন করতে সময় লাগবে সে কারণে একমাস পরে একমাস পরে বিয়ের দিন ধার্য করলেন। বিয়ের আগে কিছু আনন্দের উৎসব থাকে, কিছু নাচ গান, মেয়েকে আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো ইত্যাদি। বাড়িতে একটা উৎসবের আবহ চলতে লাগলো। কয়েকজন গিয়ে মিষ্টি ও পান সুপারি দিয়ে পানপাত্র করে এলেন, আসলে এটা বরপক্ষকে নিমন্ত্রণ করা হয়। সবাই শুভ দিনের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

লুৎফার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগলো। অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন তাদের তিন বন্ধুর মনের মধ্যে প্রাচীর তুলে দিয়েছে। কারো সঙ্গে কারোওর আর দেখা হয় না। লুৎফা মন মরা হয়ে থাকে সব সময় আব্দুলের কথা মনে হয়। এতদিনের বন্ধু তারা একজন জীবনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কিন্তু অপরজনকে দূর করে দেওয়া কি অত সহজ। তার মন আব্দুলের দিকে পড়ে রইল মন তাকে খুঁজে বেড়ায়। 

একদিন ঝড়ি এলো। সে গোপনে ঝড়ি পিসিকে ডেকে বলল আব্দুলের কোনো খোঁজ তুমি রাখ? ঝড়ি বলল রাখি, সে রোজ মাঠে বসে সাদা বিড়ি টানে। বোধহয় তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে। লুৎফা বললো তাকে একদিন ডেকে দিতে পারো পিসি? ঝড়ি রাজি হয়ে গেল। দু’দিন পরে তুমি পরের বাড়ি যাবে মা, তোমার কাজটা না করে দিতে পারলে আমার মরণ হবে না। ঝড়ি চলে গেল, লুৎফার মনে ঝড় বইতে লাগলো, আব্দুল কি আসবে? তাকে সে কি বলবে, গফুর শুনলেই বা কি মনে করবে, ভুল বুঝবে না তো? কুমারী মনের চঞ্চলতায় সে দুলতে লাগলো। ঝড়ির পথ পানে চেয়ে রয়। এতদিনে সে বুঝতে পারেনি আব্দুল তার মনের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া খুব কষ্টকর। গফুর কে সে ফেলতে পারে না, আব্দুলকে আবার ভুলতে পারে না। আব্দুল চিরকাল তাদের বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না? আব্দুলের খবর পাওয়া গেল সে বাড়িতে আসতে রাজি নয় চিরকাল যেখানে তারা খেলেছ, সেই মাঠে সে তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। সেখানে গেলেই তো আব্দুলের সঙ্গে দেখা হবে। ঝড়িকে বিদায় দিয়ে লুৎফা ভাবতে লাগলো, সে মাঠে যাবে কি-না।

বিকাল হলে তার মন তাকে মাঠের দিকে টেনে নিয়ে চলল। দূর থেকে দেখা গেল আব্দুল ডুবন্ত সূর্যের দিকে মুখ করে বসে আছে, লুৎফা ধীরে ধীরে তার পিছনে এসে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ডাকলো আব্দুল ভাই। আব্দুল চমকে মুখ ফিরেয়ে দেখল। শুষ্ক মুখ রুক্ষ্ম চুল বিধ্বস্ত চেহারার একটা মানুষ। আব্দুলের এমন চেহারা সে কোনোদিন দেখেনি। তোর চোখে জল এসে গেল। প্রতিদিনের মতো ছেলেরা খেলছে গোরু বাছুর চরছে, হাওয়া বইছে, সূর্য পশ্চিম দিকে অস্ত যাচ্ছে শুধু আব্দুল কেমন যেন বদলে গেছে। আব্দুল উঠে দাঁড়িয়ে তার হাত চেপে ধরলো আমি জানতাম তুমি আসবে। লুৎফা নিরব হয়ে রইলো কতদিনই তো খেলার ছলে তার হাত সে ধরেছে কিন্তু আজকে এত শিহরণ কেন জাগছে। আব্দুলকে সে কি তাহলে ভালোবাসে তা আগে কেন বুঝতে পারেনি।

আব্দুল বললো লুৎফা মনে হচ্ছে কত কাল তোমার দেখিনি তুমি এত সুন্দর হয়েছো তা আগে দেখতে পাইনি, তোমাকে আমি এত ভালোবাসি তা আগে বুঝিনি যখন তোমার বিয়ের কথা শুনলাম তখন মনে হল আমি সব হারাতে বসেছি তুমি ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না তুমি ও বিয়ে ভেঙে দিতে বল। লুৎফা তুমি একবার বলো আমাকে ভালোবাস। লুৎফা বলল মনের কথা মন দিয়ে বুঝতে হবে আব্দুল ভাই মুখে বলা যায় না। কিন্তু আমি এখন কি করি বলোতো সমাজে সবাই বসে আমার বিয়ে ঠিক করেছে সে বিয়ে না হলে আমার বাবা সমাজে এক ঘরে হবেন। আমি তার মেয়ে হয়ে তাকে এত অপমান কীভাবে করব বলতো? আব্দুল বলল তা আমি জানি না ভালোবাসা কখনও সমাজের নিয়ম মেনে চলে না ভালোবাসা ভালোবাসার প্রতিদান চায় সে সমাজ, ধর্ম, কাউকে পরোয়া করে না। আব্দুল আরও ঘনিষ্ঠ হল লুৎফা তার কাছে সঁপে দিল দুটি প্রাণ এক হয়ে গেল সবার অজান্তে। গোধূলি বেলায় সে পরিণয় এর সাক্ষী থাকলো খোলা আকাশ দিকদিগন্তবিস্তৃত মাঠে আকাশের তারা আর সবুজ ঘাসের গালিচা। লুৎফা মনে প্রাণে আব্দুলের হয়ে গেল।

সংবাদটি জানাজানি হতে সময় লাগলো না। মর্মাহত বাবা তাকে গৃহবন্দী করে রাখলেন। আব্দুল এর বাবা দিদার বক্স সে ছেলে অন্তপ্রাণ সব শুনে বললেন ছেলের পছন্দ আমার পছন্দ। সে যখন পছন্দ করে সে যেভাবেই হোক এ বিয়ে আমি দিয়েই তবে ছাড়বো। যত টাকা খরচ হয় হউক। ধুমধাম করে আমি ছেলের বিয়ে দেবো। লতিফ মিয়া ভালো মানুষ তিনি আমার কথা ফেলবেন না আমি কালই তার কাছে লোক পাঠাবো। আমার এত সহায় সম্পত্তি দু’দিন পরে আব্দুল তার মালিক হবে, এ বিয়েতে তিনি নারাজ হতে পারবেন না।

পরদিনই দিদার মিয়া তার অনুচর খিজিরকে পাঠালেন আব্দুল লুৎফার বিয়ের ঘটক হিসাবে। খিরিজ লতিফ মিঞাকে সব কথা বললেন, বললেন আপনার মেয়ের বিয়েতে কোন খরচ লাগবে না। মেয়েকে সোনাইমুড়ী এ নিয়ে যাওয়া হবে, এমনকী দু’পক্ষের খানাপিনার সব খরচ বরপক্ষ করবে। আপনি রাজি হয়ে যান। লতিফ মিঞা টাকার গরম মেশানো এ প্রস্তাবে রাজী হতে পারলেন না। লতিফ মিঞা বিনয়ের সঙ্গে বললেন। আমার মেয়ের সামাজিক নিয়মে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এখন আর কিছু করা যায় না। খোদা বক্স মিঞা সম্মানী লোক তাকে বুঝিয়ে বলবেন আমরা গরীব মানুষ গরিব মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ করাই ভালো মনে করি। কতো বড়ো পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে মন চায় না।

ঘটক ফিরে এলো, খোদা বক্স মিঞা সব শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। বললেন আমিও দেখবো কীভাবে বিয়ে হয় প্রয়োজনে বিয়ের আসর থেকে কন্যাকে তুলে এনে বিয়ে দেবো আমার ছেলের সঙ্গে। তার জন্য যত মাথা ফাটাফাটি হয় হোক। আব্দুল ও নিজের প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য বাবার অনুগত হয়ে উঠলো। ভুলে গেল গফুর তার ছোটবেলার বন্ধু। 

এদিকে গফুরের পরিবার ও লতিফের পরিবারের ছেলে মেয়েরা একযোগে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন লাঠালাঠি হয় হবে কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা যাবে না। গ্রামে দুইি শিবিরে পরিণত হল। কেউ ও পক্ষে কেউ এ পক্ষে। বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে গ্রামবাসীদের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। গ্রামের ইমাম দুই পক্ষের কাছে শান্তির বার্তা নিয়ে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। কেউ তার আবেদন শুনলেন না।

এদিকে লুৎফা চোখের জলে ভাসে সেভাবে আমার জন্যই গ্রামে এতো বিবাদ কারও প্রাণ গেলে সে পাপ আমাকে সুখী হতে দেবে না। তার করার কিছু ছিল না সব সময় সে কাঁদে। কেউ নেই যার কাছে মনের কথা বলে হালকা হবে। সবাই তাকে দোষ দিচ্ছে। 

গফুর খুব বিমর্ষ ভাবে থাকে। বিয়ে নিয়ে কোনো উৎসাহ যেন তার নেই। তার মনের ভাব কিছু প্রকাশ পায় না সব সময় সে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোনো তাপ উত্তাপ যেন তাকে স্পর্শ করে না। বিয়ের দিন সকাল শতাধিক লোক সেজেগুজে বর নিয়ে কন্যা পক্ষের বড়ির দিকে রওনা দিল। অপরদিকে খোদাবক্স মিঞা তার দলবল পাঠালেন বিয়ে ভাঙতে আব্দুল চুপি চুপি সে দলে ভিড়ে গেল, দলের সর্দার খিজির, সে আব্দুল কে আগলে রাখার চেষ্টা করলো। বিয়ে বাড়িতে দুই পক্ষের লোক মুখোমুখি হাজির, বিয়ে শুরুর কাছাকাছি সময় খিজির হুংকার দিলেন এ বিয়ে বন্ধ করো আমাদের কর্তার হুকুম।

কনের বাবা লতিফ মিঞা ও ধমকে উঠলেন আমার মেয়ের বিয়ে আমি দেবো তোমাদের কর্তার হুকুম এখানে চলবে না। খিজির বললো তাহলে আমরা কোনেকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যাব আমাদের সঙ্গে বর এসেছে সে তার বউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে কোন অমর্যাদা হবে না। শুরু হলো হাতাহাতি, বৃদ্ধ ইমাম সাহেব দু পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। কেউ হাতের লাঠি দিয়ে কেউ তালপাখা দিয়ে মারামারি শুরু করে দিল।

হঠাৎ কেউ আব্দুলের মাথায় সজোরে আঘাত হানল মাথা ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো। সহসা ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। বরবেশী গফুর ঝাপিয়ে পড়ল। চিৎকার করে বলে উঠলো কে মেরেছে আমার বন্ধু আব্দুল কে, সবাই মারামারি বন্ধ করুন। আব্দুল আমার ছোটবেলার বন্ধু তাকে যে আঘাত করেছে আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি না। গফুর এগিয়ে আব্দুলের হাত ধরে তার পাশেই বসালো, সযত্নে রুমাল দিয়ে তার মাথার কাটা অংশ বেঁধে দিল। নিজের জরির পোশাক টুপি খুলে আব্দুলের শরীরে পরিয়ে দিল। সবাইকে ডেকে বলল আব্দুল লুৎফা আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি ওরা আমার বন্ধু, ওদের বিয়ে হলে ওরা যদি সুখি হয় তাহলে আমার মতে সুখী আর কেউ হবে না। আমি অনুরোধ করছি আব্দুল এর সঙ্গে লুৎফার বিয়ে দেওয়া হোক। আব্দুল যদি তার মনের কথা একবার বলতো বন্ধু ভেবে ঘটনা এরকম হতো না। ইমাম সাহেব আপনি আব্দুল ও লুৎফার বিয়ে পড়িয়ে দিল। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। অগত্যা আব্দুল লুৎফার বিয়ে বর-কনের মতামত নিয়ে সমাধা করা হলো।

তারপর ভোজ সভা যারা এতক্ষণ মারামারি করছিল তারা এখন খেতে বসে ভুরিভোজ করল। খিজির মিঞার ভোজন একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল তাকে হাত ধরে তুলে দিতে হলো। এবার কনে বিদায়ের পালা, নববধূর সাজে সজ্জিতা লুৎফা মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাঁদছে পালকিতে উঠতে চাইছিল না। লুৎফা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল সে কিছুতেই পালকিতে উঠতে চাচ্ছিল না। সবাই তাড়া দিতে লাগল সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সন্ধ্যার আগে নতুন বউকে ঘরে নিয়ে যেতে হয়, লুৎফার কান্না থামেনা।

মা বুঝলেন মেয়ের মনের কথা, তিনি কাকে যেন ডেকে বললেন একবার গফুরকে ডেকে নিয়ে এসো তো। গফুর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, তাকে কোনরূপ বিচলিত হতে দেখা গেল না। লুৎফা গফুরের পায়ে লুটিয়ে পড়লো, তার চোখের জলে গফুরের পা ভিজে গেল। সবাই তাকে জোর করে তুলে দাঁড় করালো। গফুর কে জড়িয়ে ধরল। বলল আব্দুল আমরা ছোটবেলা থেকে বন্ধু ছিলাম, সে বন্ধুর বজায় রাখতে পারি না? আব্দুল বললো আমি কথা দিলাম গফুর ভাই আজীবন আমরা বন্ধু হয়ে থাকবো। বেহারারা সুরে তুলে নিয়ে আব্দুল ও লুৎফাকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে চলল। গফুর অশ্রু ভেজা চোখে তাদের শুভেচ্ছা জানালো। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *