Spread the love

ফেয়ারওয়েল

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

১৯৭৭ সালের ২৩শে মার্চ থেকে দীপেনবাবু নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে। এখানকার মানুষজন, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সবাই অত্যন্ত ভালো। ভালো সাধারণ মানুষজনও। কিন্তু সমস্যা দুটো: (১) ওঁর বাড়ী টাকী শহরের কাছে এক গ্রামে। বহুদূর। (২) মাস মাহিনা মাত্র ২৫০ টাকা। তাও অনিয়মিত। বাড়ীতে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, বিধবা মা, বেকার ছোটভাই, স্বল্প রোজগারের দাদা-বৌদি-ভাইপো-ভাইঝি।

কাজেই হৃদয়ের টান চৈতন্যদেবের মাটির প্রতি গভীর হলেও, দূরত্ব এবং আর্থিক অনটনের কারণে  C S C দিয়ে উনি চলে যাচ্ছেন কোলকাতার সাউথ সিটি কলেজে। সাত বছর ছিলেন তিনি বিদ্যাসাগর কলেজটিতে। এরই মধ্যে তিনি ছাত্র-শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী সবারই খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তাই আজ তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা সভাতে ভীড় উপছে পড়েছে। গেট দিয়ে যখন তিনি বেরিয়ে আসছেন, তখন সবার চোখেই জল। হাতে ফুল, ফুলের মালা। কেউ বা এনেছে আবির, আতর, কস্তুরি।

বেলা গড়িয়ে গেছে। সন্ধে হলো বলে। ঠিক এমন সময় বেরোনোর মুখে স্টাফরুমের শিক্ষাকর্মী, যার কাজ হোল ঘন্টা দেওয়া, স্যার দেরকে খাতাপত্তর দেওয়া, জল দেওয়া, ইত্যাদি, সেই ষাট ছুঁই ছুঁই রবিদা এসে হাজির।

–আর একটু হলে আপনার সঙ্গে দেখা হতো না স্যার। ভিজে গলায় রবিদা বললেন।

–ঠিক তাই রবিদা!

–আসলে স্যার, সবই মহাপ্রভুর ইচ্ছা। আপনি আমায় ভীষণ ভালোবাসেন কিনা! তাই, আমার সঙ্গে দেখা না করে আপনার যাওয়া হবে না–প্রভু সেকারণ নানা অছিলায় আপনাকে দেরী করিয়ে দিয়েছেন।

–কি জানি রবিদা। হয়তো তাই হবে। কিন্তু আপনি আজ অসময়ে?

–ট্রেন অবরোধ। ধাত্রীগ্রামে আটকে ছিলাম গাড়ীতে। এই একটু আগে অবরোধ উঠলো। আমাদের কলেজের অনেকেই ছিলেন। ওখান থেকেই ফিরতি ট্রেনে তাঁরা চলে গেছেন।

–আপনি ও দাদা বৃদ্ধ মানুষ। ওখান থেকেই ফিরে যেতে পারতেন। কষ্ট করে এই অবেলায় আসার কি দরকার ছিল? এমনিতেই তো লালদাগ পড়ে গেছে।

–তা ঠিক স্যার। অন্য সময় হলে তাই করতাম। “কিন্তু আজ . . . ” রবিদা থেমে গেলেন। তাঁর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। গলাটা ভারী হয়ে গেল।

–দীপেনবাবুর বয়েস ত্রিশ ক্রস করেছে সবে। অর্থাৎ উনি রবিদার ছেলের বয়সের। তবু, শিক্ষা ও পদমর্যাদার দিকে তাকিয়ে রবিদা ওনাকে “স্যার” বলেই সম্বোধন করেন। প্রতিষ্ঠিত সেই শিষ্ঠাচারে রবিদা বলে চললেন,–কলেজে জয়েন করার অল্পদিনের মধ্যেই আপনি টীচার্স কাউনসিলের সেক্রেটারী হলেন; এখনো সেইপদে আছেন; আড়াই বছরের মাথায় জি. বি. র মেম্বার হলেন। কতকাছ থেকে আপনাকে দেখেছি; কত কাছে থেকে আপনার সাথে কাজ করেছি। আপনি চলে যাচ্ছেন। আমারও বয়েস হয়েছে। চারমাস বাদে আমার রিটারমেন্ট। কালনা থেকে গিয়ে কোলকাতায় আপনার নতুন কর্মস্থলে আপনার সাথে গিয়ে দেখা করা হয়তো এজীবনে আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই বেলা গড়িয়ে গেলেও এলাম। ভাবলাম, কলেজে দেখা না হলেও যদি মেসেও দেখা হয়; যদি সুদূর টাকীতে যাবার জন্যে বিকেলে বেরুনোর ঝুঁকি না নিয়ে, রাতটুকু মেসে থেকে কাল খুব ভোরে বেরুনোর সিদ্ধান্ত করেন, তাহলে তো একবার দেখা হতে পারে। এইসব ভেবে সোজা চলে এলাম।

সঙ্গীসাথীরা সহ দীপেন বাবু শুনে থ হয়ে গেলেন।

–কিন্তু, আপনার তো ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে রবিদা!

–হ্যাঁ, তা একটু হবে স্যার। কিন্তু আসতে আমাকে হতোই। কারণ, আজ শুধু আপনার বদলি হবার দিন নয়। আজ আরো একটা বিষয়ের দিন স্যার।

–কি সেটা রবিদা?

হাতের লায়লনের থলের মধ্যে থেকে একটা টিনের টিফিন কটো বার করে রবিদা বললেন–

–এইটার দিন স্যার!

–তার মানে? বিস্ময়ের সুর দীপুবাবুর গলায়।

–তার মানে হোল বড়দের হাতে পায়েসে মিষ্টি মুখ করার দিন।

রবিদার কথার হেঁয়ালি ঠিক বুঝতে না পেরে দীপেন বাবু ও তাঁর সহকর্মীরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকেন। সমস্ত ধোঁয়াসা কাটিয়ে দিয়ে রবিদা বললেন–সাতটি বছর ধরে ছায়ার মতো লেগে থেকে স্যারের সাথে কাজ করেছি। শিক্ষা, পদের মর্যাদা, সব দূরে সরিয়ে রেখে এই বুড়ো বেয়ারাটিকে স্যার নিজের দাদার মতো আপন করে নিয়েছিলেন। তাই এই সুযোগে ওনার জন্ম তারিখটাও আমি জানি। আজ স্যারের জন্মদিন। উনি এখন বেরিয়ে যখন বাড়ী পৌঁছোবেন, তখন মাসীমা, দাদা, বৌদি এমনকি নতুন বৌঠানও হয়তো ঘুমিয়ে পড়বেন। ওঁকে গিয়ে ওঁদের জাগাতে হবে। স্যারের বাড়ীতে তো ফোন নেই। কেউ জানেন না, যে উনি আজ অবশ্যই ফিরছেন। উনি পৌঁছানোর সময় মধ্যরাত্রি গড়িয়ে যাবে: ইংরেজীতে পড়ে যাবে পরের দিন। তাই ওনার জন্মদিনে বৌকে দিয়ে একটু পায়েস রান্না করে এনেছি; আর সঙ্গে এনেছি একটু আলুপোস্তর তরকারী। বর্ধমানের আলুপোস্ত স্যারের খুব প্রিয়। প্রায় রোজদিনই টিফিনে ওঁকে আমার কোটো থেকে ভাগদিতে হতো আলুপোস্তর। কাল থেকে আর আমার আলু পোস্তর ভাগ নেবার কেউ রইবে না। 

রবিদার দু’চোখে জল। শিশুর মতো রুমালে মুখ ঢেকে কাঁদছেন দীপেন বাবু। অশ্রুভেজা এই পরিবেশ কাটিয়ে দীপেন বাবুর সহযাত্রী ও সহচর, ছাত্র নিতাই রবিদার হাত থেকে পায়েস ও পোস্তর কোটো দুটো নিয়ে দীপেনবাবুর হাতে দিল–

আমার ব্যাগে ভরে নিলাম রবিদা। কৃষ্ণনগরে গিয়ে ট্রেনে উঠে খাবো। আর বৌদিকে বলবেন–তাঁর এই কোটো দুটো আমার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকবে। ফেরৎ দিলাম না। রবিদাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করে এবং সমবেত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী সবার দিকে হাত জোড় করে নমস্কার করে দীপেন বাবু নিতাইকে নিয়ে গাড়ীতে উঠলেন। মারুতি এগিয়ে চলল বড়ালঘাটের দিকে। ঠিক সেই সময়েই পাশের একটি ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছে নজরুলগীতি–

 আমার যাবার সময় হোল, 

দাও বিদায়।

 তারা সুন্দরী গার্লস স্কুল পেরিয়ে গাড়ির ড্রাইভার ক্যাসেট ছাড়লো 

–যাও গো এবার যাবার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।

রবীন্দ্রসংগীতটা শুনতে শুনতে আবেগে দীপেন বাবুর চোখদিয়ে দুগালে জল গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবতে থাকেন–কি আর রাঙিয়ে দিলাম আমি? বরং বিদ্যাসাগর কলেজ, আমার ছাত্রছাত্রীরা, আমার শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী সহকর্মীরা, সর্বোপরি আমার সাতবছরের নিত্যসহচর রবিদা, সবাই তো যাবার আগে আমায় ভরিয়ে দিলেন, রাঙিয়ে দিলেন।

নিজের মনেই জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন-সিটি কলেজে গেলে অনেক সুবিধা: ট্রাস্ট কলেজ, নিয়মিত মাস মাহিনা, ডেলি প্যাসেঞ্জারী, রোজ বাড়িতে নব পরীণীতা স্ত্রী সাথীর কাছে ফিরে আসা, বৃদ্ধা মায়ের প্রতিদিন সেবার সুযোগ পাওয়া, যৌথ পরিবারের সুখ দুঃখ দাদা বৌদি, ছোট ভাই হারু, ভাইপো-ভাইঝি পুকু, চন্দনের সাথে ভাগ করে নেওয়া। এর স্বাদই একটা আলাদা। তবু আজ নবদ্বীপ ছেড়ে চলে যাবার সময় বার বার মনে হচ্ছে–

আমি তারই সনে

হাজার বাঁধনে

বাঁধা যে গিঁটাতে গিঁটাতে।

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *