বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতা (১৮২০-১৮৯১)
অভিজিৎ দত্ত (শিক্ষক ও লেখক)
2020 সালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হয়েছিল।আজ শুক্রবার (26/09/25) বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ২০৫তম জন্মদিন সর্বত্র পালিত হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের জন্ম ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,মাতা ভগবতী দেবী।একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা কি অনুভব করতে পারবো-উনবিংশ শতকে যে সমস্ত মহাপুরুষ এই বঙ্গ দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও সমাজ সংস্কার করতে গিয়েছিলেন তারা কি নিদারুণ প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন?সমাজসংস্কার করতে গিয়ে তাদের কি বিরূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল?লড়াইটা কিন্ত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে নয়,আমাদের দেশীয় কুসংস্কার, কু-প্রথা ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে।বিদ্যাসাগর মহাশয়কে চেনা,জানা এত সহজ ব্যাপার নয় ।একজন মনীষীকে জানতে হলে ভাল করে তার কর্মকান্ডের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ভাল করে পাঠ্যপুস্তক পর্যন্ত পড়ে না,তারা রেফারেন্স বই কি পড়বে?অথচ এইসব মনীষীদের সম্পর্কে জানা খুবই দরকার। নিজেদের দেশের সভ্যতা,সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাল করে না জানলে প্রকৃত দেশবাসী হয়ে উঠা যায় কী?এর জন্যই দরকার মনীষীদের নিয়ে আলোচনা।এক কথায় মনীষীচর্চা। মনীষীদের নিয়ে যত চর্চা হবে তত তাঁদের জীবন কাহিনী ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আমরা পরিচিত হতে পারবো ততোই দেশের প্রতি প্রগাড় প্রেম ও শ্রদ্ধার জন্ম নেবে।জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম গড়ে উঠবে।মনীষীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়।কী নিদারুণ প্রতিকূলতা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগর হয়েছিলেন কজন জানে?বিশিষ্ট শিক্ষক, লেখক, ব্যবসায়ী, সমাজসংস্কারক,মানবপ্রেমী, বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক, কত পরিচয় ছিল তার।ঘরে,
,ঘরে যে বর্ণপরিচয় ছাড়া আমাদের অক্ষর জ্ঞান হয় না,তার স্রষ্টা বিদ্যাসাগর মহাশয়।শুধু তাই নয় ,ইংরেজ আমলেও কি করে কি করে মাথা উঁচু করে চলা যায় তাও বিদ্যাসাগর দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ। শিক্ষা বিস্তারই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না,তিনি বিধবা মেয়েদের দুঃখ, যন্ত্রণা গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি ধর্ম বা ভগবান বিশ্বাস করতেন না কিন্ত বিধবাবিবাহের প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে চর্চা করেছিলেন। পরাশর সংহিতার, সাহায্যে তৎকালীন ধর্মপ্রচারক ও সমাজপতিদের বিরুদ্ধে লড়ে বিধবাবিবাহ প্রর্বতন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে গিয়ে তাঁকে কি পরিমান চাপ বা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল তা এ প্রজন্ম অনুভব করতে পারবে না।এই কাজের জন্য তাঁর প্রাণ সংশয় পর্যন্ত ঘটতে চলেছিল। কিন্ত তিনি এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে শেষ না দেখে ছাড়তেন না ।বিদ্যাসাগর একটা জায়গাই বলেছিলেন বিধবা বিবাহ প্রর্বতন তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ।বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন-প্রাচীন ঋষির ন্যায় প্রতিভা ও প্রজ্ঞা,একজন ইংরেজ এর মত কর্মশক্তি, আর হৃদয় হচ্ছে বাঙালি মা এর অনুরূপ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছিলেন, অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ছোট জিনিসকে বড় দেখায় কিন্ত বিদ্যাসাগরের জীবন চরিত বাদ দিয়ে অন্যদের কর্মকান্ড যদি বিচার করা হয় তাহলে তা শুধুই ছোট দেখাবে।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন-দয়া নহে,বিদ্যা নহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষ্যত্বের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই মন্তব্য যথার্থ ও ঐতিহাসিক। জীবনের মূল্য আয়ুতে নহে, কল্যাণময় কর্মে – শাস্ত্রের এই কথাটি যে কতটা সত্য বিদ্যাসাগরের জীবনে তা প্রতীয়মান হয়।অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয় এর শেষ জীবন খুব কষ্টে কেটেছিল। তার মত মানুষের সঙ্গে যে অন্যদের মিল হবে না সেটাই স্বাভাবিক। এমনকি শেষ জীবনে তার স্ত্রী,ছেলে,বাবা,মায়ের সাথে বনিবনা হতো না।তিনি নিজের ছেলেকে তাজ্যপুত্র ঘোষণা করেছিলেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর তীব্র মতবিরোধ হয় ও তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।তার নিজের জামাই সূর্যকুমার অধিকারীকে (যিনি মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন) কলেজ ফান্ডের তিন বা চার হাজার টাকা গরমিলের জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেন ও বরখাস্ত করেন।বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনে এমন বহু ঘটনা আছে।এই মহৎ চরিত্রের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে ঘরে ও বাইরে সংগ্রাম করতে হয়।তিনি বলেছিলেন-এদেশের উদ্ধার হতে বহু বিলম্ব আছে। নতুন মানুষের চাষ করতে পারলে তবে এদেশের ভাল হবে।উক্তিটি যথার্থ। তাই বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্ম বার্ষিকীতে তার জীবন ও কর্মকান্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও দেশবাসীর জন্য কিছু ভাল কাজ করতে পারলে,তার আদর্শে চলতে পারলে, সেটাই হবে তার প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।ধন্য সেই পিতা-মাতা যারা বিদ্যাসাগরের মত রত্নের জন্ম দিয়ে সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন বিদ্যাসাগর চর্চা শুধু হিন্দুত্ব বা বাঙালি চর্চা নয়,অপার মনুষ্যত্বের চর্চা।কাজেই বিদ্যাসাগর চর্চার মাধ্যমে যদি আমাদের মধ্যে যদি সামান্য মনুষ্যত্বের উদ্ভব হয় তবে সেটাই হবে বড় পাওয়া।তাকে শ্রদ্ধা জানানোর সঠিক কাজ।
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice
[…] শিশুর চাবি… বিশ্বনাথ সাহা […]
[…] আরও পড়ুন:-ভ্রমণ পিয়াসী : বিশ্বনাথ সাহা […]