টেলিভিশনের শব্দে ঢাকা নিঃসঙ্গ মৃত্যু: আধুনিক মানুষের একাকীত্বের প্রতিচ্ছবি
লেখা: শ্যামল মণ্ডল

টেলিভিশনের পর্দায় যখন ঝাপসা আলো নাচছে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কোনো পুরনো সিনেমার সংলাপ— তখনও ঘরের কোণে পড়ে আছে এক নারী, নিঃশব্দ, প্রাণহীন। তার নাম জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট। একসময় তিনি ছিলেন হাসিখুশি, সুরভিত, জীবনের প্রতি আগ্রহে ভরা একজন মানুষ। কিন্তু ২০০৩ সালের কোনো এক শীতল ডিসেম্বরের রাতে, উত্তর লন্ডনের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে চিরতরে নিভে গেল তাঁর জীবন। এবং সেই মৃত্যু, অদ্ভুতভাবে, কেউ জানলো না— তিন বছর ধরে।
এক শহরের অদৃশ্য মানুষ
২০০৬ সালের জানুয়ারির এক সকালে, বাড়িওয়ালা ভাড়া না পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ যখন দরজা ভাঙল, তখনই ধরা পড়ল আধুনিক সভ্যতার এক শীতল বাস্তবতা। দরজার ওপাশে, টেলিভিশন তখনও চলছিল, বাতাসে মিলছিল পুরনো কার্পেটের গন্ধ, ক্রিসমাসের মোড়ানো উপহারগুলো পড়ে ছিল যেমন তিন বছর আগেও ছিল। কেবল মানুষটি ছিল না। সে কঙ্কাল হয়ে গেছে।
তিন বছর ধরে একটি প্রাণহীন শরীর একা পড়ে থাকে, অথচ শহরের কেউ তা টের পায় না— এই ঘটনাটি শুধু একটি নারীর মৃত্যু নয়, বরং আমাদের সভ্যতার আত্মার মৃত্যু।
একবিংশ শতাব্দীর শহরগুলো আলোয় ভরা, কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা যেন নিভে গেছে। মানুষ এখন পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, জানেও না। জানলেও দরজায় কড়া নাড়ার সাহস রাখে না।
প্রযুক্তির যুগে নিঃসঙ্গতা
যে যুগে আমরা ২৪ ঘণ্টা অনলাইনে, সেই যুগেই মানুষ সবচেয়ে অফলাইন হয়ে যাচ্ছে জীবনের কাছ থেকে।
স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, চ্যাট— সব কিছু যেন সম্পর্কের প্রতিস্থাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এখন চোখে চোখ না রেখে স্ক্রিনে চোখ রাখে।
জয়েসের জীবনও ছিল সেই আধুনিক ছন্দে বাঁধা। কর্পোরেট চাকরি, ব্যস্ততা, একাকী জীবনযাপন। ব্যাংকের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তার ভাড়ার টাকা দিত, বিল পরিশোধ করত। ফলে কেউ জানত না, সে বেঁচে আছে না নেই। প্রযুক্তি তাকে কার্যত ‘জীবিত’ রেখেছিল, অথচ মানুষ হিসেবে সে বহু আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল।
বিচ্ছিন্নতার জটিল মানচিত্র
আজকের শহরে মানুষ অসংখ্য ভিড়ের মধ্যে থেকেও একা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিস, যানজট, বাজার, আর শেষে নিঃশব্দ ফ্ল্যাটে ফেরা— এই হলো নগরজীবনের সংজ্ঞা। প্রতিবেশী হয়তো পাশের ঘরে মারা গেলেও কেউ জানে না, কারণ সবার দরজাই এখন বন্ধ, হৃদয়ও বন্ধ।
এই ঘটনাটি একক কোনো দেশ বা সমাজের নয়। কলকাতার গলিতেও এমন নিঃসঙ্গ মৃত্যু ঘটে— বৃদ্ধা একা থাকেন, হঠাৎ একদিন দরজার নিচে থেকে গন্ধ বেরোয়, তারপরই খবর হয়। মানুষ বুঝে যায়— এই শহরও লন্ডনের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।
মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতার কারণ
মানুষ সম্পর্ক চায়, কিন্তু ভয় পায় সম্পর্কের ভার। একসময় পরিবার মানে ছিল আশ্রয়; এখন তা বোঝা। বন্ধুত্ব মানে এখন ইনবক্স, ভালোবাসা মানে মেসেজের রিপ্লাই।
এই সামাজিক বদলের পেছনে আছে ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতা, এবং এক ধরনের অস্তিত্বভয়— কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না, কেউ কারও জন্য সময় রাখে না।
জয়েসের মৃত্যু যেন এক সতর্ক সংকেত—
যেখানে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশে প্রবেশ করেছে, কিন্তু হৃদয়ে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
নগরের ভয়াবহ নীরবতা
কেউ কেউ বলে, আধুনিক শহর নাকি কখনও ঘুমায় না। কিন্তু সত্য হলো— শহর জেগে থাকে, মানুষ ঘুমিয়ে যায়।
এই জেগে থাকা শহর এক অদ্ভুত মরুভূমি, যেখানে শব্দ আছে, কিন্তু সংলাপ নেই। ট্রাফিক সিগন্যালের আলোয় থেমে থাকে গাড়ি, কিন্তু মানুষের চোখে কোনো আলোর ঝিলিক থাকে না।
এই শহরে জয়েসের মৃত্যু শুধু দুঃখজনক নয়, তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে প্রশ্ন করে—
আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি, নাকি কেবল চলাফেরা করছি এক যান্ত্রিক জীবনের ভেতর?
সামাজিক সংযোগের ভাঙন
একটা সময় পরিবার মানে ছিল একসঙ্গে খাওয়া, গল্প করা, ঝগড়া করা— তবু সংযোগ থাকা। আজকের পরিবারে সবাই নিজের ঘরে, নিজের মোবাইলে।
বন্ধুরা একে অপরের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানায়— কিন্তু কেউই বোঝে না, কে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়ছে।
আমাদের এই বিচ্ছিন্নতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও।
মানুষ এখন তথ্যের যুগে আছে, কিন্তু অনুভূতির অভাবে ভুগছে।
জয়েসের কাহিনি— এক প্রতীক
জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট যেন এক প্রতীক— এমন এক নারী, যিনি প্রযুক্তির যুগে থেকেও মানবিক যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তার মৃত্যু আমাদের শেখায়, আধুনিক সমাজের বিপুল যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যেও আমরা আসলে কতটা একা।
একজন নারী তিন বছর ধরে মারা পড়ে আছেন, অথচ কেউ দরজা ঠেলে দেখল না— এটি শুধু এক মর্মান্তিক ঘটনা নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক ব্যর্থতা।
বাঙালি বাস্তবতায় প্রতিধ্বনি
আমাদের সমাজেও এই বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে।
বৃদ্ধ বাবা-মা একা থাকেন গ্রামে, সন্তান শহরে চাকরি করে; ফোনে খবর নেওয়া হয়, কিন্তু উপস্থিতি থাকে না।
অসংখ্য ফেসবুক বন্ধু থাকা সত্ত্বেও, কেউই গভীর রাতের বিষণ্ণতায় পাশে থাকে না।
অতএব, জয়েসের গল্প লন্ডনের নয়, আমাদেরও গল্প— প্রতিটি নিঃশব্দ ঘরের গল্প।
মানুষের হারিয়ে যাওয়া মানবতা
আজকের মানুষ হয়তো সভ্যতার চূড়ায়, কিন্তু মানবতার তলানিতে।
আমরা জানি নতুন মডেলের ফোন কবে বেরোবে, কিন্তু জানি না পাশের বাসার বৃদ্ধা আজ কেমন আছেন।
আমরা শেয়ার করি লাইক, কিন্তু ভাগ করি না অনুভূতি।
এই উদাসীনতা একদিন আমাদেরকেই খাবে— একা, নিঃশব্দে, কোনো এক ঘরের ভেতরে।
শেষ প্রশ্ন
জয়েসের মৃত্যুর পর তার টেলিভিশন চলছিল— যেন পৃথিবীর শেষ সাক্ষী।
এই টেলিভিশন, যা বিনোদনের উৎস ছিল, হয়ে গেল মৃত্যুর প্রহরী।
তার অচেতন শরীরের পাশে যে স্ক্রিন আলো দিচ্ছিল, তা যেন প্রতীক—
আমরা আলোর যুগে থেকেও কেমন করে অন্ধকারে বাস করছি।
আমাদের প্রত্যেকের ঘরে এখন টেলিভিশন আছে, মোবাইল আছে, ইন্টারনেট আছে—
কিন্তু আছে কি সত্যিকারের মানুষিকতা?
আমরা কি জানি আমাদের বন্ধু কেমন আছে?
আমরা কি জানি, পাশের দরজার মানুষটি এখনো বেঁচে আছেন কিনা?
উপসংহার
জয়েস ক্যারল ভিনসেন্ট মারা গেছেন তিন বছর অজানায় থেকে।
কিন্তু তার গল্প আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
মানুষ যতই আধুনিক হোক, যতই প্রযুক্তি নির্ভর হোক, শেষ পর্যন্ত তার প্রয়োজন মানুষকেই।
কারণ কোনো যন্ত্র, কোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, কোনো সোশ্যাল মিডিয়া—
কখনোই একজন মানুষের স্পর্শের উষ্ণতা দিতে পারে না।
এই নিঃসঙ্গতার গল্প আমাদের সকলের জন্য এক সতর্কবার্তা।
যদি আজ আমরা একে অপরের দিকে না ফিরি, একদিন হয়তো আমরাও টেলিভিশনের শব্দে ঢাকা পড়ে যাব—
কেউ জানবেও না, আমরা কবে হারিয়ে গেছি।
—
️ লেখা: শ্যামল মণ্ডল
ছবি: সংগৃহীত
Kabyapot.com
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice
[…] শিশুর চাবি… বিশ্বনাথ সাহা […]
[…] আরও পড়ুন:-ভ্রমণ পিয়াসী : বিশ্বনাথ সাহা […]