ঝটিকা সফরে মধুপুর;অদূরেই পাথরোল কালিমন্দির
রাজকুমার সরকার
—————————————
১০ই জুন,২০২৫ মঙ্গলবার,ঘড়ির কাঁটায় তখন এগারোটা বেজে পনেরো।আমি তখন মধুপুর রেলস্টেশনে নেমে টোটো নিয়ে পাথরোল এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মনে মনে ভাবছি মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে না তো…
দুশো টাকায় মন্দির যাওয়া আসা চুক্তি পাকাপোক্ত করে বীভৎস গরমে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।স্টেশন থেকে খানিকটা দূরে গিয়ে চোখ চলে গেল এক সাইনবোর্ডে।লেখা রয়েছে ডালমিয়া কুপ মানে কুয়ো।আর ইতিহাস ঘাঁটতে গেলাম না।দেখছি ডালমিয়া কুয়োটি সম্পূর্ণ মার্বেল দিয়ে বাঁধানো।অনেকগুলো পুলিশ বসে আছেন।তারপর রাস্তাটি বেঁকে গিয়ে সোজা চলে গেছে ‘সারঠ’।এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয় পাথরোল।রাস্তাটির নাম লর্ড সিনহা রোড।কনিরাম পেট্রোল পাম্প,পটেল কাঠ মিল, সিংহানিয়া রাইস মিল ।মধুপুর থেকে পাথরোল এর দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার।
লালগড়,বাহাদুরপুর দুটি জনপদ পেরিয়েই পাথরোল।
অন্য সাধারণ গ্রামের মতই পাথরোল’ও একটি গ্রাম তবে এখন অনেককিছুই গড়ে উঠেছে মা কালির জন্য। ডানদিকের মূখ্য রাস্তাটি চলে গেছে ‘সারঠ’ এর দিকে।’সারঠ’ এখান থেকে ২৩ কিলোমিটার।রাজ্য সরকারের পথনির্মাণবিভাগের মস্ত বড় সাইনবোর্ড। লেখা রয়েছে মা কালি মন্দির পাথরোল মে আপকা স্বাগত হ্যায়………
এখান থেকে জায়গাগুলির দূরত্ব লেখা রয়েছে।পথরড্ডা ৯ কিলোমিটার,সিকটিয়া ১৬ কিলোমিটার, বাভনগামা ১৯ কিলোমিটার এবং সারঠ ২৩ কিলোমিটার। পাথরোলে ঢুকতেই ডানদিকে একটি বড় পুকুর নজরে এলো।সানবাঁধা সারি সারি মাছ এর দোকান। জীবন্ত মাছ।দেখি যত্রতত্র দোকান। বেশিরভাগ পুজোসামগ্রীর দোকান। ফলমূলের দোকান, তেলেভাজার দোকান, ফাস্ট ফুড এর দোকান, মোবাইলের দোকান আরও কত কি।বিশাল গেট।হিন্দিতে লেখা রয়েছে-মা কালি দ্বার পাথরোল।
এটি প্রথম প্রবেশপথ।এখানে এলেই আর মন্দির বেশিদূর নয়।টোটোদাদাকে বললাম – একদম মন্দিরের কাছে নিয়ে চলুন।আমার কথামত উনি হাজির করালেন একদম মন্দিরের আসল দরজায়।লেখা রয়েছে ডানদিকে-মা পাথরোলেশ্বরী দক্ষিণা কালীমন্দির।পাথরোল (মধুপুর) জেলা-দেওঘর। একটু এগিয়ে গাড়িটি নিয়ে গেলেন কাদের ভাই। বললেন, আমি এখানেই আপনার অপেক্ষা করছি আপনি পুজো করে আসুন। আমি ঠিক মন্দিরসংলগ্ন দোকানটিতে গিয়ে দাঁড়াতেই দোকানদার অরূপ আচার্য বললেন এখানেই জুতো খুলে রাখুন। চামড়ার বেল্ট থাকলে খুলে দিন।ভাগ্যিস আমার বেল্ট’টি রেক্সিনের না হলে ঘোরতর সমস্যা হোত।ব্যাগটা রেখে দিন দোকানে চিন্তামুক্ত হয়ে।তাই করলাম। ব্যাগ দোকানে রেখে হাতে জল নিলাম। দোকানদার ধরিয়ে দিলেন একটি ডালি।ডালিতে রয়েছে একটি রক্তজবার বড় মালা,একটি নারকেল,বেলপাতা,
ফুল,পাঁচটি পেঁড়া,একটি রঙিন সালু।এক শত কুড়ি।এখানে দাম দর নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে লজ্জা লাগে।ডালি নিয়ে দোকানদার আমাকে মন্দিরে ঢুকিয়ে দিয়ে এক পুরোহিতকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে মন্দিরে ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সোজা মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন।চারদিকটা স্টিলের ফ্রেম দিয়ে ঘেরা। ওখানেও একটি গেট রয়েছে।গেট খুলিয়ে আমাকে ঢোকালেন পুরোহিত। কালো পাথরের মা কালি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একদম মায়ের কাছে হাজির। এত বতর পাব ভাবিনি।মা কালি এবং আমি।আমি বিলম্ব না করে সোজা মায়ের পায়ে আমার মাথাটি রেখে দিলাম মিনিট পাঁচেক।মায়ের চরণে দেবো বলে ঘরের ফুলবাগান থেকে তুলে নিয়ে গেছিলাম তিনটি রক্তজবা ও তিনটি রাণী কালারের জবা।প্রতিটি ফুল মায়ের চরণে রাখলাম। এধরণের পুজো করে আত্মতুষ্টি কোথাও হয়েছে বলে মনে হয় না।জয় মা।জয় মা। জয় মা ।
পাথরোলে পাথরোলেশ্বরী মন্দির চত্বরে রয়েছে অনেকগুলি মন্দির। রাধাকৃষ্ণ মন্দির,মহাদেব মন্দির,মা মনসা মন্দির,গৌরা পার্বতী মন্দির সহ আরও অনেক মন্দির। সত্যি কথা বলতে কি তখন ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বেজে সতেরো।রৌদ্রের তাপে পা পুড়ে যাচ্ছিল।কলকল করে ঘামছি;বীভৎস গরম। হড়বড় করে চোখ ঘুরিয়ে যতটুকু পারলাম একঝলক দেখে নিয়ে মধুপুরের উদ্দেশ্যে চম্পট দিলাম।বললাম মা আবার আসবো…..
একসময় বাঙালিদের হাওয়া বদলের জায়গা ছিল জসিডি, শিমুলতলা,মধুপুর
[ঝাঝা, কিউল সহ]।বাঙালিদের বড় বড় কোঠীবাড়ি (কুঠি)ছিল।এখনও রয়েছে তবে অধিকাংশই ভগ্নাবশেষ।এখন সিকিভাগ রয়েছে।সব বিক্রি করে দিয়েছেন বাঙালিরা।বিখ্যাত বিখ্যাত বাঙালির আসা-যাওয়া ছিল এসব অঞ্চলে।একসময় এখানকার জল যেত ট্রেনে করে কোলকাতার বাঙালিবাবুদের জন্য।এখানকার জল ভালো।এখন সব ইতিহাস।সেই ইতিহাসের তলাশে আজ মধুপুর যাওয়া।
পাথরোল কালিমন্দির থেকে পুজো করে ফিরছিলাম টোটো ড্রাইভার কাদের ভাইকে বললাম একটু দাঁড়ান একটি ছবি তুলবো।
এক ভগ্নাবশেষ।কোনো বাঙালির …..
[বিরাট কোঠী ছিল ছবি দেখেই অনুমান করলাম]
খবর নিয়ে জানতে পারলাম বাড়িটির নাম “মার্বেল হাউস”
রাজা প্রদ্যুম্ন মল্লিকের বাড়ি ছিল। বর্তমানে দেওঘরের ব্যবসায়ী হনুমান সর্রাফের।
ড্রাইভার কাদের ভাই আমাকে নামিয়ে দিলেন মধুপুর কলেজ পেরিয়েই অধ্যাপক ড.আশিস কুমার সিংহ মহাশয়ের বাড়ির দরজায়……..
পাথরোল কালি মন্দির (Maa Pathrol Kali Temple)
—জহরেরখণ্ডের মধুপুর, ডিওঘর জেলার Pathrol এলাকায় অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরটি। মন্দিরটির ভগবতী হচ্ছেন দক্ষিণা কালী। এটি প্রায় ৬–৭ শত বছর আগেই রাজা দিগ্বিজয় সিংহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল ।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ:
অবস্থান: মধুপুর (Madhupur) শহর থেকে প্রায় ৭ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে Pathrol এলাকায় ।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব: রাজা দিগ্বিজয় সিংহ প্রতিষ্ঠিত, এটি মধুপুরের অন্যতম প্রাচীন ও পবিত্র মন্দির ।
উপাসনা পদ্ধতি: প্রতিদিন চক্রীয় পূজা হয়। কালী পুজো ও দুর্গাপূজা মূল উৎসব। কিছু ক্ষেত্রে পশু বলিদান প্রদান করা হয় ।
বার্ষিক মেলা: কার্তিক (অক্টোবর–নভেম্বর) মাসে হাজার হাজার ভক্ত ঐ মেলায় অংশ নেন ।
আর্কিটেকচার্য ও আশেপাশ: মূল মন্দিরের চারিদিকে আরো নয়টি ছোট মন্দির রয়েছে ।
পৌঁছানোর উপায়:
রেলে: মধুপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন থেকে অটো বা ট্যাক্সিতে ৭ কিমি (~১৫–২০ মিনিট) ।
রাস্তায়: নিকটতম বিমানবন্দর– Deoghar Airport, প্রায় ৩১ কিমি দূরে; এর পর ট্যাক্সি বা বাসে Pathrol পৌঁছানো যায় ।
সার্বিক সময়: মন্দির সারাদিন খোলা থাকে; সপ্তাহে সাত দিন পূজা চলে ।
মন্দির ভ্রমণের সেরা সময়:
অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আবহাওয়া মনোরম এবং মণ্ডপ-বিহীন, তাই এই সময় দর্শনার্থীদের জন্য আদর্শ ।
অতিরিক্ত পরামর্শ:
আশেপাশে Budheshwari মন্দির, Usri–Bakulia ঝর্ণা, মধুপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে ।
চলাচলের রাস্তা মাঝেমধ্যে রুক্ষ হতে পারে; তাই যানবাহনে যাবার সময় একটু সতর্কতা অবলম্বন করুন ।