বন্ধু
ভোরের সময়টুকু বরাবর খুব ভাল লাগে। নতুন একটা দিনের প্রথম চোখ মেলে তাকানো। যেন সোনারকাঠির ছোঁয়ায় রাজপুত্র চোখ মেললো।ছোট্ট শহরটা ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে শিশুর মতই জেগে উঠলো, দেখতে আজও ভাল লাগে।আঁধার আকাশটা একটু একটু করে রঙ মাখে। একটু একটু করে আলোর শব্দ ফোটে।দিন হেসে ওঠে,প্রকৃতি নিরুচ্চার সুপ্রভাত বলে,খুব ভাল লাগে অতসীর।
প্রতিটি ভোর একটার থেকে আর একটা একদম আলাদা।প্রতিটি দিনও। রঙ,গন্ধ,সুর সব। আজ পর্যন্ত অবিকল একই রকম দুটো মানুষ দেখেনি অতসী,একই রকম দুটো ভোরও না,দিনও না।গ্রীষ্মের মুখর,বর্ষার কলকল,শরতের সুনীল সুন্দর,হেমন্তের লাজুক,শীতের অলস,বসন্তের চঞ্চল ভোর।ভোরের আবেশ আশ্লেষও আলাদা আলাদা। এই যেমন গতকাল বেশ কুয়াশা ছিল,সবুজ পাতারা আবছা,আদুরে। মেঘলা সাদা তুলোট চাদর গায়ে প্রতিবেশী বাড়িগুলো।ঘাসের পাতায় ফুলে হিমকণা। সহজবাউলের একতারার সুর আর ওই যে দরাজ টান—‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরো মাঝার’,মনটাকে বড় উদাস করেছিল। অতসীর কেবলই মনে হচ্ছিল যদি চলে যাওয়া যেত পিছু পিছু !কিন্তু চলা যায় না,যাওয়াও যায় না। দেখা যায় না কিন্তু সে আছে।কথা-সুর জানান দিয়ে,দুরের ডাক দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া ভোর ছিল কাল। আজ কুয়াশা একটু পাতলা।অমিতাভদা রোজকার মতই রাস্তার সি এফ এল আলোগুলো নিভাতে নিভাতে স্কুল মাঠের দিকে চলেছেন। কী জানি কেন দোয়েল-বৌ এর ভারী গলা সাধার ইচ্ছা হয়েছে আজ। কিন্তু প্রেমিক পাগল দোয়েলের বরের সুর তো তার গলায় নেই। তবু—,ওদিকে শেষ হয়ে হয়েও শিউলির কোল জুড়ে কিছু ঝরে পড়া ফুল,সে ফুল একটু পরে অতসী কুড়িয়ে নিয়ে গুরুদেবের ছবির সামনে রাখবে। কিন্তু গন্ধ তার প্রাণে ছুঁয়ে যাচ্ছে এখনই। এমনি করে প্রতিটি ভোর অতসীর কাছে আলাদা আলাদা স্পর্শে আসে।
দিনের বাকিটুকু বেশ একই রকম।কিছুটা গতানুগতিক।নিজেই নিজের দিন গুলোকে বিভিন্ন ব্যস্ততা দিয়ে সাজায়।
বাচ্চাদের স্কুলের পুলকার গুলো ছোটা শুরু করার আগেই অতসী নেমে আসে ছাদ থেকে।প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরে এই সময়টা প্রবালের চা পানের। একটুকরো ছাদ বাগান। সে বাগানে এখন হিমেল হাওয়া,কুয়াশা আর মরসুমি ফুলগাছের রাজত্ব।মরসুমি ফুলের গাছ গুলোতে এখনও কলি আসেনি।ফুল ধরলে আকাশের নীচে অতসীর ছাদবাগান যেন এক অপ্সরী।
ছোট্ট একরত্তি বাড়ি,একফালি আকাশ আর একচিলতে বাগান,একটুকরো ছাদ।সারাজীবনের তিল তিল সঞ্চয় আর প্রভিডেন্টফান্ডের থেকে নেওয়া ঋণে স্নেহধন্য। মেয়ের লেখাপড়া,তার অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা তারপর বিয়ে।কন্যাদান কর্তব্যের সমাপন,নির্ঝঞ্ঝাট দম্পতি। নিরিবিলি শান্ত এখন ‘নীড়’। অতসী মনে মনে ভাবে নষ্টনীড়। তবু তার নষ্টনীড়কেই কী অসীম মোহে মমতায় আঁকড়ে আছে বুকে!কণায় কণায় মনের ইচ্ছাটুকু দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে এতগুলো বছর ধরে!প্রবাল বড় ভালমানুষ। সাদাসিধে।প্রায় চাহিদাহীন।চা পানের সঙ্গে তার দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ চলে।
ছোট্ট রান্নাঘর,সে ঘর লাগানো ছোট্ট একটুকরো বাগান। ধনেপাতা,মেথিপাতা আকাশি লঙ্কার ডালপালার ওপর বড় নিম গাছটার পাতার ছায়া আর সকালের রোদ্দুর খেলা করে।হঠাৎ করে শৈবালময় সবুজ জলে ছোট্ট ছোট্ট মাছ খেলা করছে মনে হয় অতসীর।পাতাগুলো দুলে দুলে হাসে। ঠিক সেই সময় অমলের ‘সুপ্রভাত’—বার্তাটি আসে। দু’কলি গানের কথা,বা কবিতার লাইন।কখনো সূর্যোদয়ের ছবি,বেশ লাগে। অতসীর রিফু করা সংসার চলতে থাকে। অতসী আপন মনে সাজাতে থাকে। কখনো ঘর,কখনো বাগান,কখনো বারান্দা,কখনো ঠাকুরঘর কখনো নেহাতই খাবারের ডিস্।
‘যে কোন কারণেই হোক তুমি খুব একা। ’
প্রথমদিকের মেসেজটা পড়ে মুচকি হেসেছিল অতসী।বান্ধবীদের জন্য এ খুব পুরোনো কায়দা পুরুষের।‘অবকাশ কোথায় একা-দোকা এসব ভাবার?কাজ থাকলে একাকীত্ব রোগ ভয় পায়।পালায়। ’
‘মানুষের পরিবর্তে ঘরের কাজ?তাই হয় নাকী?আমি সঠিক বলতে পারবো না,তবে আমার মনে হয় তুমি একা,খুব একা। ’
বহুকাল পরে বুকের মধ্যের সঙ্গোপন দীঘির জলে যেন ঢিল পড়লো। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ উঠলো,মিলিয়েও গেল।
‘তুমি সাজো না কেন?সাজলে যে কোনো রমনীকেই আমার খুব সুন্দর লাগে।’
‘আমি তো সাজতে পারি না।’
অমল মানেই ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। অমল বাতাস কম্পন তোলে মনের তারে।সপ্ততন্ত্র বেজে ওঠে।শীতের শেষে বুলবুলিদের নীড় বাঁধার তৎপরতা বাড়ে।
ছোট ছোট সময়ের শূন্যস্থান,দীর্ঘ একটা দিনের শরীরে ক্ষতের মত। সেই ক্ষতের শূন্যতায় প্রলেপ ছিল অতসীর সবকিছু সাজানোর শখ। আজকাল হাঁপিয়ে পড়ে।সবকিছু সাজিয়ে সে নিজে দেখতে থাকে।আর একজন যে আছে তার যেন দেখার চোখ নেই,ইচ্ছে নেই।অতসী নিজে সাজে না।তাকে কে দেখবে?প্রবাল এসব সাতপাঁচ ভাবে না।ডাল ভাত কাগজ আর সামান্য আড্ডা এতেই খুশি।ঘরের সাজানো গাছ,পুজোর পাঞ্জাবীর সুন্দর সূচীকাজ সে খেয়াল করে না।ভাল রান্নার আলাদা প্রসংশা করার সূক্ষ্মতা তার নেই।বললে বলে-‘কেমন চেটেপুটে খেলাম দেখলে না?’
কে সত্যি ভালোমানুষ প্রবাল নাকী অমল?অমল বলেছিল—‘খাঁটি বাউল জানে পাখির ঠিকানা।পথের নিশানা তাকে দিতে হয় না।’
অমল আলো হয়ে, আনন্দ হয়ে আসে।একঘর ভাললাগা হয়ে আসে।একবুক বেঁচে থাকা হয়ে আসে। কাশ্মীরি স্টিচের ফুলকারি টেবিলক্লথের ওপর জানলা বেয়ে আসা আলো পড়ে। সূচ নামিয়ে আতসী যেন পাল্লা দুটো খুলে দেয়।মুঠোফোনে বার্তা আসে। অতসী দেখতে পায় একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি উড়তে উড়তে মুঠোফোনের পাল্লা খুলে,পাতা পাতা ডিজাইনের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীল, ঘন নীল শূন্য আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। পিয়ানোয় মেসেজটোন বাজছে। ছাদবাগানের অ্যাসটার, প্যানজি,মুসান্ডার রেণু ঝরে যাচ্ছে ডানা থেকে। পেয়ারা গাছে দুটো দুষ্টু কাঠবিড়ালি লুকোচুরি খেলছে। প্রবাল কাগজ নামিয়ে চশমা পরা চোখ তুলে বলছে—‘সাবধানে যেও।’
প্রতিটি ভোর একটার থেকে আর একটা একদম আলাদা।প্রতিটি দিনও। রঙ,গন্ধ,সুর সব। আজ পর্যন্ত অবিকল একই রকম দুটো মানুষ দেখেনি অতসী,একই রকম দুটো ভোরও না,দিনও না।গ্রীষ্মের মুখর,বর্ষার কলকল,শরতের সুনীল সুন্দর,হেমন্তের লাজুক,শীতের অলস,বসন্তের চঞ্চল ভোর।ভোরের আবেশ আশ্লেষও আলাদা আলাদা। এই যেমন গতকাল বেশ কুয়াশা ছিল,সবুজ পাতারা আবছা,আদুরে। মেঘলা সাদা তুলোট চাদর গায়ে প্রতিবেশী বাড়িগুলো।ঘাসের পাতায় ফুলে হিমকণা। সহজবাউলের একতারার সুর আর ওই যে দরাজ টান—‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরো মাঝার’,মনটাকে বড় উদাস করেছিল। অতসীর কেবলই মনে হচ্ছিল যদি চলে যাওয়া যেত পিছু পিছু !কিন্তু চলা যায় না,যাওয়াও যায় না। দেখা যায় না কিন্তু সে আছে।কথা-সুর জানান দিয়ে,দুরের ডাক দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া ভোর ছিল কাল। আজ কুয়াশা একটু পাতলা।অমিতাভদা রোজকার মতই রাস্তার সি এফ এল আলোগুলো নিভাতে নিভাতে স্কুল মাঠের দিকে চলেছেন। কী জানি কেন দোয়েল-বৌ এর ভারী গলা সাধার ইচ্ছা হয়েছে আজ। কিন্তু প্রেমিক পাগল দোয়েলের বরের সুর তো তার গলায় নেই। তবু—,ওদিকে শেষ হয়ে হয়েও শিউলির কোল জুড়ে কিছু ঝরে পড়া ফুল,সে ফুল একটু পরে অতসী কুড়িয়ে নিয়ে গুরুদেবের ছবির সামনে রাখবে। কিন্তু গন্ধ তার প্রাণে ছুঁয়ে যাচ্ছে এখনই। এমনি করে প্রতিটি ভোর অতসীর কাছে আলাদা আলাদা স্পর্শে আসে।
দিনের বাকিটুকু বেশ একই রকম।কিছুটা গতানুগতিক।নিজেই নিজের দিন গুলোকে বিভিন্ন ব্যস্ততা দিয়ে সাজায়।
বাচ্চাদের স্কুলের পুলকার গুলো ছোটা শুরু করার আগেই অতসী নেমে আসে ছাদ থেকে।প্রাতঃভ্রমণ সেরে ফিরে এই সময়টা প্রবালের চা পানের। একটুকরো ছাদ বাগান। সে বাগানে এখন হিমেল হাওয়া,কুয়াশা আর মরসুমি ফুলগাছের রাজত্ব।মরসুমি ফুলের গাছ গুলোতে এখনও কলি আসেনি।ফুল ধরলে আকাশের নীচে অতসীর ছাদবাগান যেন এক অপ্সরী।
ছোট্ট একরত্তি বাড়ি,একফালি আকাশ আর একচিলতে বাগান,একটুকরো ছাদ।সারাজীবনের তিল তিল সঞ্চয় আর প্রভিডেন্টফান্ডের থেকে নেওয়া ঋণে স্নেহধন্য। মেয়ের লেখাপড়া,তার অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা তারপর বিয়ে।কন্যাদান কর্তব্যের সমাপন,নির্ঝঞ্ঝাট দম্পতি। নিরিবিলি শান্ত এখন ‘নীড়’। অতসী মনে মনে ভাবে নষ্টনীড়। তবু তার নষ্টনীড়কেই কী অসীম মোহে মমতায় আঁকড়ে আছে বুকে!কণায় কণায় মনের ইচ্ছাটুকু দিয়ে সাজিয়ে তুলেছে এতগুলো বছর ধরে!প্রবাল বড় ভালমানুষ। সাদাসিধে।প্রায় চাহিদাহীন।চা পানের সঙ্গে তার দৈনিক সংবাদপত্র পাঠ চলে।
ছোট্ট রান্নাঘর,সে ঘর লাগানো ছোট্ট একটুকরো বাগান। ধনেপাতা,মেথিপাতা আকাশি লঙ্কার ডালপালার ওপর বড় নিম গাছটার পাতার ছায়া আর সকালের রোদ্দুর খেলা করে।হঠাৎ করে শৈবালময় সবুজ জলে ছোট্ট ছোট্ট মাছ খেলা করছে মনে হয় অতসীর।পাতাগুলো দুলে দুলে হাসে। ঠিক সেই সময় অমলের ‘সুপ্রভাত’—বার্তাটি আসে। দু’কলি গানের কথা,বা কবিতার লাইন।কখনো সূর্যোদয়ের ছবি,বেশ লাগে। অতসীর রিফু করা সংসার চলতে থাকে। অতসী আপন মনে সাজাতে থাকে। কখনো ঘর,কখনো বাগান,কখনো বারান্দা,কখনো ঠাকুরঘর কখনো নেহাতই খাবারের ডিস্।
‘যে কোন কারণেই হোক তুমি খুব একা। ’
প্রথমদিকের মেসেজটা পড়ে মুচকি হেসেছিল অতসী।বান্ধবীদের জন্য এ খুব পুরোনো কায়দা পুরুষের।‘অবকাশ কোথায় একা-দোকা এসব ভাবার?কাজ থাকলে একাকীত্ব রোগ ভয় পায়।পালায়। ’
‘মানুষের পরিবর্তে ঘরের কাজ?তাই হয় নাকী?আমি সঠিক বলতে পারবো না,তবে আমার মনে হয় তুমি একা,খুব একা। ’
বহুকাল পরে বুকের মধ্যের সঙ্গোপন দীঘির জলে যেন ঢিল পড়লো। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ উঠলো,মিলিয়েও গেল।
‘তুমি সাজো না কেন?সাজলে যে কোনো রমনীকেই আমার খুব সুন্দর লাগে।’
‘আমি তো সাজতে পারি না।’
অমল মানেই ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। অমল বাতাস কম্পন তোলে মনের তারে।সপ্ততন্ত্র বেজে ওঠে।শীতের শেষে বুলবুলিদের নীড় বাঁধার তৎপরতা বাড়ে।
ছোট ছোট সময়ের শূন্যস্থান,দীর্ঘ একটা দিনের শরীরে ক্ষতের মত। সেই ক্ষতের শূন্যতায় প্রলেপ ছিল অতসীর সবকিছু সাজানোর শখ। আজকাল হাঁপিয়ে পড়ে।সবকিছু সাজিয়ে সে নিজে দেখতে থাকে।আর একজন যে আছে তার যেন দেখার চোখ নেই,ইচ্ছে নেই।অতসী নিজে সাজে না।তাকে কে দেখবে?প্রবাল এসব সাতপাঁচ ভাবে না।ডাল ভাত কাগজ আর সামান্য আড্ডা এতেই খুশি।ঘরের সাজানো গাছ,পুজোর পাঞ্জাবীর সুন্দর সূচীকাজ সে খেয়াল করে না।ভাল রান্নার আলাদা প্রসংশা করার সূক্ষ্মতা তার নেই।বললে বলে-‘কেমন চেটেপুটে খেলাম দেখলে না?’
কে সত্যি ভালোমানুষ প্রবাল নাকী অমল?অমল বলেছিল—‘খাঁটি বাউল জানে পাখির ঠিকানা।পথের নিশানা তাকে দিতে হয় না।’
অমল আলো হয়ে, আনন্দ হয়ে আসে।একঘর ভাললাগা হয়ে আসে।একবুক বেঁচে থাকা হয়ে আসে। কাশ্মীরি স্টিচের ফুলকারি টেবিলক্লথের ওপর জানলা বেয়ে আসা আলো পড়ে। সূচ নামিয়ে আতসী যেন পাল্লা দুটো খুলে দেয়।মুঠোফোনে বার্তা আসে। অতসী দেখতে পায় একটা হলুদ রঙের প্রজাপতি উড়তে উড়তে মুঠোফোনের পাল্লা খুলে,পাতা পাতা ডিজাইনের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীল, ঘন নীল শূন্য আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। পিয়ানোয় মেসেজটোন বাজছে। ছাদবাগানের অ্যাসটার, প্যানজি,মুসান্ডার রেণু ঝরে যাচ্ছে ডানা থেকে। পেয়ারা গাছে দুটো দুষ্টু কাঠবিড়ালি লুকোচুরি খেলছে। প্রবাল কাগজ নামিয়ে চশমা পরা চোখ তুলে বলছে—‘সাবধানে যেও।’