গল্প: নাম বিভ্রাট Nam Bibhrat কলমে: জিৎ কুমার বারিক ( Jeet Kumar Barik )
গল্প: নাম বিভ্রাট
Nam Bibhrat
কলমে: জিৎ কুমার বারিক
Jeet Kumar Barik
****************************
অংশু, ভালো নাম অংশুমান। বয়স মাত্র ষোলো বছর। বাড়ির সবাই তাকে অংশু বলে ডাকলেও গ্রামের বিভিন্ন জন বিভিন্ন নামে ডাকে। কোনো নাম বেশ ভালো আবার কোনো নাম বিশ্রী। এতে অংশু মোটেও রাগ করে না। এইসব নাম ষোলো বছর ধরে শুনতে শুনতে অংশু অভ্যস্ত। তবে একটা ব্যাপার আছে, যার দেওয়া নাম শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি তাকে সেই নামে ডাকতে পারবে।
পাড়ার পরেশ খুড়ো অংশুকে কয়েকদিন ধরে পচা নামে ডাকেন। এই নামে অংশু অভ্যস্ত নয়। তাই মাঝে মাঝে সাড়া দেয় না। যখন কেউ নতুন নামে ডাকা শুরু করে ওমনি অংশু বলে,”কী আসে যায় নামে? মানুষ চিনবে কামে।” অর্থাৎ, নামে কী আর হবে? মানুষ তো চিনবে কাজের মাধ্যমে। কথাটা ফেলে দেওয়ার নয়, যুক্তি আছে।
বড়োলোক বাবার একমাত্র ছেলে বলে কথা, ষোলো হতে না হতেই হাতে দামী স্মার্টফোন ধরিয়ে দিয়েছে বাবা। বন্ধুদের সঙ্গ পেয়ে রাস্তার কালভার্টের উপরে বসে কখনো খেলে ‘ফ্রি ফায়ার’ আবার কখনো রিল বানায়।
বিকেলে বন্ধুদের সাথে বসে ‘ফ্রি ফায়ার’ খেলছে অংশু। এক বন্ধু বললো— “অংশু, একটা গান ট্রেন্ডিং চলছে রে।”
—”বলিস কি! কোথাও?”
—”কোথায় আবার, ইনস্টাগ্রামে।”
—”কী গান রে?”
হিংসার সাথে বন্ধুটি বলে— “বলবো কেন? তুই আমার আগে বানিয়ে নিবি, তোকে আর বলছি না। এমনিতে তোর অনেক ফলোয়ার।”
—”বলবি না তো? ঠিক আছে।”
—”না বলবো না, তুই বরং তোর নামের ঝুড়ি নিয়ে গান বানা, এতে রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাবি।”
মাথা গরম হয়ে যায় অংশুর। দ্রুত পা চালিয়ে ঘরের দিকে ফিরতে থাকে। পরেশ খুড়ো অংশুকে দেখে বলেন— “এই যে পচা তাড়া কিসের?”
পাড়ার কাকিমা ঠাট্টা করে বলেন— “ওওওও…. ‘রেলের ইঞ্জিন’ আমাকে একটু বসাও আমার একটু তাড়া আছে।”
এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে, তার উপর নাম পেল ‘রেলের ইঞ্জিন’ আরও ক্ষেপে গেল অংশু। বললো—
“এইযে শোনো কাকি মণি,
‘পি এন পি সি’র আস্ত খনি,
আজকে আমি ‘রেলের ইঞ্জিন’ বটে।
তোমার মতো ঘরের খেয়ে,
এদিক ওদিক ঘুরে চেয়ে
কথা পাচার করিনা দশ ঘাটে॥
এইযে শোনো পরেশ খুড়ো,
দিনকে দিন হচ্ছো বুড়ো,
আর একটিবার শুনি মুখে ‘পচা’।
ছুট্টে গিয়ে টেড়ে মেড়ে
একটা ঘুসি দেবো ঘাড়ে,
একটানে তে খুলবো সেদিন কাছা॥”
অংশুর কথা শুনে দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। পরেশ খুড়ো মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা তো এমন ছিল না। পরের ছেলে পরমানন্দ, যত ফুটে তত আনন্দ। অংশুকে বললেন— “পচা বললাম বলে এইভাবে বললি তো, পচবি একদিন নির্ঘাত পচবি।”
অংশ বললো— “যাও যাও, বেশি বুলি! শকুনের অভিশাপে কখনো গরু মরে না।”
কাকিমা শুনে বললেন— “ওওওও, তুমি তাহলে গরু নাকি?”
কোনোদিকে কান না দিয়ে ঘরে ফিরলো অংশু।
রাতে খাওয়ার টেবিলে অংশুর বাবা অংশুকে জিজ্ঞেস করলেন— “বিকেলে রাস্তায় চেঁচামেচি করছিলি কেন?”
— “কেন আবার? এমনিতে মাথা গরম ছিল। ‘পচা, রেলের ইঞ্জিন’ শুরু করে দিলো। তুমি বলো এসব ভালো লাগে?”
— “তুই তো নিজে বলিস, ‘কী আসে যায় নামে? মানুষ চিনবে কামে।’ আজ কী হলো?”
অংশু ভেবেচিন্তে বলল— “চেনে তো, তুমি জানো আমি কত ভাইরাল হয়েছি রিল বানিয়ে।”
— “ওওওও, তোর তো এটাই কাজ। রিল বানানো, ‘ফ্রি ফায়ার’ ছাড়া তোর আর দৌড় কতদূর। তোর ভাগ্য ভালো স্যোশাল মিডিয়ায় তোকে কেউ পচা নামে চেনে না। কই পাশের বাড়ির প্রিয়ম তো রিল বানায় না?”
অবাক হয়ে অংশু উত্তর দিলো— “কি! ও বানাবে রিল! মুখ থুবড়ে পড়বে। প্রিয়ম আমার মতো হ্যান্ডসাম নাকি?”
বাবা বিরক্তির স্বরে বললেন— “তোর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তোর হাতে ফোন তুলে দেওয়াই আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হয়েছে।”
এতদিনে টনক নড়লো অংশুর বাবার। ছেলে যে উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। জামার বোতাম খুলে রিল বানাচ্ছে, কখনো আবার উলঙ্গ হয়ে রিল বানাতে পারে। আসল উদ্দেশ্য তো ভিউজ বাড়ানোর। এ যুগের ছেলে তো সঙ্গদোষে কখন কী ঘটাবে ঠিক নেই। ফোন তো হাতে চলে গেছে। বাবা চাইতে গেলে অজুহাত রয়েছে হাজার রকম। “অমুক স্যার হোয়াটসঅ্যাপে নোট পাঠিয়েছেন পড়তে হবে।” কিছু বলার উপায় নেই।
রাতে শুয়ে শুয়ে ট্রেন্ডিং সং খুঁজে বের করলো অংশু। চিন্তা করতে লাগলো কীভাবে? কোথায়? রিল বানানো যায়। কী করলে ভিউজ বাড়বে? দর্শক মজা পাবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে।
পরদিন সকালে বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে অংশু চললো রিল বানাতে। সমস্ত বন্ধুরাও আছে, তারা সবাই ‘ফ্রি ফায়ার’ নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে রিল বানাতে বানাতে খেয়াল হারিয়ে অংশু গিয়ে পড়লো একটা বিশ্রি-নোংরা ডোবায়। এলাকার সমস্ত আবর্জনা সেখানে পড়ে। কোনো রকমে প্রাণের চেয়ে প্রিয় ফোনটা ছুঁড়ে দিল ডাঙায়। ফোনটা যাইহোক বেঁচে গেল, কিন্তু অংশু বাঁচবে তো?
অংশু চিৎকার করতে থাকলো— “বাঁচারে ! আমাকে বাঁচারে!”
কার কথা আর কে শোনে, সবাই তো কানে হেডফোন গুঁজে গেম খেলায় ব্যস্ত। অবশেষে হেডফোনের আওয়াজ তুচ্ছ করে অংশুর চিৎকারের ক্ষীণ শব্দ গিয়ে পৌঁছালো এক বন্ধুর কানে। সবাই দেখতে পেল অংশু নোংরা ডোবায় পড়ে গেছে। তবে জলে নেমে কেউ তাকে তোলায় ইচ্ছা প্রকাশ করলো না। অংশুর নিয়ে যাওয়া ফোন স্ট্যান্ড টা এক বন্ধু অংশুর দিকে বাড়িয়ে দিলো, সেটা ধরে অংশু উপরে উঠে এলো। দুর্গন্ধে কেউ থাকতে পারলো না। ফোনটা তুলে কোনো রকমে অংশু বাড়ি ফিরে গেল।
রাতে দেখা গেল অংশুর সারা শরীরে স্ক্রিন ইনফেকশন্ হয়ে গেছে। গালদুটো লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটো জলে ভরে গেল অংশুর। এবার সে কীভাবে সোস্যাল মিডিয়ায় নিজের মুখ দেখাবে। সারা শরীর বিকট ভাবে চুলকাতে লাগলো। চুলকানির চোটে, বিভিন্ন চিন্তায় রাতের ঘুম উড়ে গেল অংশুর।
পরদিন সকালে নিজের মুখ আয়নায় দেখে নিজেকে চিনতে পারলো না অংশু। অংশুর বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার দেখানোর পর অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিছুদিন পর ইনফেকশন থেকে ঘা-এর সৃষ্টি হলো। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে পুঁজ বের হতে লাগলো। এবার শুধু পাড়ার পরেশ খুড়ো নয়, বেশ কয়েকজন অংশুকে পচা বলে ডাকতে শুরু করলো। অংশু আর বাড়ি থেকে বেরোলো না। এক বন্ধু অংশুর সাথে দেখা করতে এলো। অংশুকে বললো— “বহুদিন তো রিল বানাস না। প্রোফাইলের রিচড্ তো অনেক কমে গেছে মনে হয়?”
— “হ্যাঁ রে, আমার দ্বারা আর মনে হয় রিল বানানো হবে না! এই চেহারা নিয়ে কি আর রিল বানানো সম্ভব? আমার সব স্বপ্ন জলে ভেসে গেল!”
— “কে বলেছে স্বপ্ন ভেসে গেল? পাগল এমন বলতে আছে।” সান্ত্বনা দিয়ে বললো।
—”ভেসে যায়নি তো আর কী হয়েছে? সব গেলো আমার।”
— “না ভেসে যায়নি, তুই বুঝতে পারছিস না আমি কী বলতে চাইছি। আরে, এই চেহারার রিল করলে আরও বেশি বেশি ভিউজ হবে। তোর প্রোফাইলের রিচড্ অনেক বেড়ে যাবে তুই দেখিস। তুই কাল থেকে লেগে পড়।”
পরদিন সকাল থেকে অংশু রিল ভিডিও বানিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে লাগলো। থাকতে থাকতে অংশুর রিল ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল। অংশুকে সবাই ‘পচা’ নামে চিনতে শুরু করলো। ‘অংশু’ নাম প্রায় সবাই ভুলে গেলো। অংশুর সেই কথা মনে পড়ে গেলো, “কী আসে যায় নামে? মানুষ চিনবে কামে।” অংশু বুঝতে পারলো, মানুষকে কাজের মাধ্যমে চেনে, কিন্তু কেউ ভালো কাজ করে পরিচিত লাভ করে, কেউ খারাপ কাজ করে। তাই অংশুর এই কাজ তাকে নতুন পরিচয় এনে দিয়েছে, আর তার নামে এনেছে বিভ্রাট।
★★★★★
রচনাকাল: ২২\০৩\২০২৫