যে ধ্বনি বিপ্লবীদের হৃদয় ঝড় তুলেছিল:
বন্দেমাতরম
বটু কৃষ্ণ হালদার

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম (২৬.৬.১৮৩৮) নৈহাটীর কাঠালপাড়ায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট,
“বন্দে মাতরম্—গান নহে, মন্ত্র।” শ্রীহট্টের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীনীরদ কুমার গুপ্ত লিখছেন—”স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যখনই দুর্বলতা অনুভব করেছি,তখনই ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র উচ্চারণ করায় দেহে ও মনে নূতন বলের সঞ্চার হয়েছে। বিপদের সম্মুখীন হলে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করার সঙ্গে সঙ্গে সাহস এসেছে এবং বিপদকে বিপদ বলে গণ্য করি নাই। পুলিশ বা মিলিটারী জোর করে সভা অথবা শোভাযাত্রা ভেঙ্গে দিতে এসেছে, আমরা ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করেছি। এই দিক থেকে বিচার করলে ‘বন্দেমাতরম্’ ছিল আমাদের War-cry বা যুদ্ধধ্বনি। জেলেও যখনই রাজবন্দীরা অত্যাচারিত হয়েছে, তখনই উচ্চৈঃস্বরে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করেছেন। এককথায় ‘বন্দে মাতরম্ ছিল আমাদের কাছে কতকটা ইষ্ট মন্ত্রেরই মতো।”
১৮৯৬ সালে বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পাঁচ বছর বাদে ১৯০১ সালের কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেন দক্ষিণাচরণ সেন। ১৯০৫ সালে কংগ্রেসের বারাণসী অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেছিলেন সরলা দেবী চৌধুরাণী।
স্বয়ং ঋষি অরবিন্দ ঘোষ “বন্দেমাতরম” কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি এই গানটিকে “বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত” হিসেবে অভিহিত করেন এবং এর মাধ্যমে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এর ব্যবহারকে জনপ্রিয়।
কিন্তু এহেন গীত গাইতে, বিপ্লবের এমন অগ্নীমন্ত্র উচ্চারণের ক্ষেত্রেও অনেকের সমস্যা ছিলো। অনেকের রীতিমত আপত্তিও ছিলো। এই সময়ে দাঁড়িয়ে যাদেরকে অনেকে প্রাতস্মরণীয় বলে মনে করেন, তাঁদের কেউ কেউও সেই তালিকায় ছিলেন।
যে শব্দবন্ধ সমগ্র জাতিকে বিপ্লবের বীজমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল, যে সংগীতের সুরমূর্ছনা সমগ্র জাতির নিদ্রাভঙ্গ করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তির ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেইবন্দেমাতরম এর স্রষ্ঠা কি সাম্প্রদায়িক…?
“ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইংরেজ প্রভু ভক্ত, দালাল, শ্রেষ্ঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং শ্রেষ্ঠ কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী গদ্য লেখক। এই চরম সাম্প্রদায়িক লেখক তার সাহিত্যকর্মে অত্যন্ত কুৎসিত ও অশালীন ভাষায় নিরবচ্ছিন্নভাবে মুসলমান শাসক এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করেছেন।”
সাহিত্য সম্রাট বলে আমরা যাকে সম্মান করি সেই বন্দেমাতরম মন্ত্রের স্রষ্ঠা সম্বন্ধে এমন অনবদ্য সব বিশেষণ পাবেন আপনি গুগল সার্চ করলে। বোঝাই যায় ওপার বাংলার কোন স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীর প্রতিভা এখানে বিকশিত হয়েছে। জীবনের শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’-এ লেখক মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে সীতারামের উদ্দেশ্যে যে কথাগুলি বলেছিলেন, তা সম্ভবত পড়েননি মিঞাজান…।
ফকির বলিল, বাবা! শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে।’
যদি পড়তেন, তাহলে কোন যুক্তিতে বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমান-বিরোধী ছিলেন? ‘বন্দেমাতরম’-এর স্রষ্টাকে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিতে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যায় কলঙ্কিত করে রাখছেন ?
বঙ্কিমচন্দ্র, আনন্দমঠ এবং বন্দেমাতরম, যে তিনটি শব্দ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সমার্থক, সেগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা শুরু হলেই তথাকথিত প্রগতিশীল এবং ‘সেকুলার’-দের কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। একদল এটা বলতে নেমে পড়েন, ‘বন্দেমাতরম’-এ যেহেতু দেশকে ‘মা’ হিসাবে বন্দনা করা হয়েছে, এই গান মুসলমানরা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকার না-ও করতে পারেন। কারণ দেশকে ‘মা’ হিসাবে বন্দনা করাটা নাকি ‘ইসলাম-বিরোধী’!
ভারতের তিরিশ চল্লিশ কোটি মুসলমানের জন্য যদি ‘দেশমাতৃকা’র বন্দনা ‘ধর্মবিরোধী’ হয় এবং ‘বন্দেমাতরম’ গাওয়াটা ‘ইসলাম বিরোধী’ হয়, তা হলে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমান কোন যুক্তিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ আবেগবিহ্বল চিত্তে গাইতে পারে? জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করতে পারে? রবীন্দ্রনাথের সেই গানেও তো দেশকে ‘মা’ রূপেই কল্পনা করা হয়েছে! শুধু একবার মনে করুন সেই লাইনগুলি, যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আসি নয়নজলে ভাসি’…..। রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলার সাহস হয় না। আর বঙ্কিমচন্দ্র হলেই ‘সাম্প্রদায়িক’?
আনন্দমঠের সন্ন্যাসীরা মুসলমান রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে আমরা বলি বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। তাহলে বঙ্কিম যখন উপন্যাসের শেষে মহাপুরুষের মুখ দিয়ে হিন্দু ধর্মের সুতীব্র সমালোচনা করে হিন্দু সন্তানদলের হাত থেকে রাজ্যশাসনের অধিকার কেড়ে নেন তখন আমরা তাঁকে হিন্দুবিদ্বেষী বলি না কেন? হিন্দুধর্মের ত্রুটি-বিচ্যুতি-দুর্বলতার সমালোচনা করলে যদি হিন্দু-বিদ্বেষী না হয় তবে অত্যাচারী মুসলমান রাজশাসনের বিরুদ্ধাচরণ করলেই বা সাম্প্রদায়িক আখ্যায় কলঙ্কিত হতে হবে কেন ?
যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১২৮৭ সনের চৈত্রে ‘আনন্দমঠ’ ছাপা শুরু হয়, সেই একই পত্রিকায় তার তিন মাস আগে, অর্থাৎ পৌষ সংখ্যায় ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’ শীষর্ক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘লোকসংখ্যা গণনায় স্থির হইয়াছে যে যাহাদিগকে বাঙ্গালী বলা যায়, যাহারা বাঙ্গালাদেশে বাস করে, বাঙ্গালাভাষায় কথা কয়, তাহাদিগের মধ্যে অর্ধেক মুসলমান’। মনে রাখবেন, এর আগে এই একই পত্রিকায় ‘বঙ্গদর্শন’-এ ১২৭৯ সনে চারটে সংখ্যা জুড়ে ছাপা হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বঙ্গদেশের কৃষক’। এবং সেই প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র একই সঙ্গে হাসিম শেখ এবং রামা কৈবর্ত্ত, অর্থাৎ বাংলার মুসলমান এবং হিন্দু প্রজা, কি দুর্দশার জীবন যাপন করছে, তার সুনিপুণ ছবি আঁকেন।
বাংলার কৃষকের জীবন যাপনের এই ছবি ক্যানভাসে আঁকার সময় তিনি হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ তো করেনইনি, বরং বারেবারে ‘ছয় কোটি সুখী প্রজা’ দেখার কথা বলেছেন। তাঁর নিজের কথায়, ‘দুই চারিজন অতি ধনবান ব্যক্তির পরিবর্তে’ ‘ছয় কোটি সুখী প্রজা’ দেশের মঙ্গল এবং শ্রীবৃদ্ধিকে সূচিত করবে। এবং ‘বন্দেমাতরম’-এর স্রষ্টা স্পষ্ট করে বারবার বলেছেন, এই ছয় কোটি প্রজার মধ্যে তিন কোটি হাসিম শেখ আর তিন কোটি রামা কৈবর্ত্ত। এর পরেও বলবেন উনি মুসলিম বিদ্বেষী……?
বর্তমানকালের একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক বঙ্কিমসাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বঙ্কিমসাহিত্যের প্রয়োজন নেই বলে দাবি করেছেন। আজকের বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কয়েকজনের মধ্যে বঙ্কিমবিদ্বেষ দেখা যায়, তার যথার্থ উত্তর রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে আছে” মনে আছে, বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচকপদে আসীন ছিলেন তখন তাহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিল না। শত শত অযোগ্য লোক তাহাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না।”
শারদ সংকলন (১৪১১) ‘পত্রী’তে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যের মূল্যায়ন এবং প্রাসঙ্গিতার বিষয়ে গবেষণাধর্মী লেখাগুলি আলোচিত হয়েছিল। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ গুণীজনের প্রতিটি প্রবন্ধই সুচিন্তিত রচনা। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত, অধ্যাপক পবিত্র সরকার প্রমুখ বিদ্বজ্জনের চিঠিতে প্রবন্ধগুলির বিষয়ে সপ্রশংস উল্লেখ করেছেন। সারস্বত পাঠকসমাজেও সমাদৃত হয়েছে সংখ্যাটি, সে কারণে সংকলনটি “প্রসঙ্গ: বঙ্কিমচন্দ্র” নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল।
বন্দেমাতরম্ গানের রচয়িতা, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অন্যতম পুরোধা। তাঁর ‘বঙ্গদর্শন‘ পত্রিকা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসামান্য ঘটনা। মনীষা ও জ্ঞানের এমন সৃষ্টি বাংলা সাহিত্য পত্রিকার ইতিহাসে বিরল। বঙ্কিমচন্দ্রের যুগান্তকারী উপন্যাসের মধ্যে ‘বিষবৃক্ষ‘, ‘কপালকুণ্ডলা’ ও ‘আনন্দমঠ’ অন্যতম। ‘বিষবৃক্ষ‘ তাঁর অসামান্য শিল্পকীর্তি। ‘কপালকুণ্ডলা’র সমতুল্য উপন্যাস এখনও রচিত হয় নি। ‘কমলাকান্তের দপ্তর‘ গ্রন্থটি সমাজ সমালোচনায় বঙ্কিম-প্রতিভার উজ্জ্বল দিকও উন্মোচিত করে। সমালোচনা সাহিত্যেও পথিকৃত বঙ্কিম। ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের আবির্ভাব ও তাঁর প্রভাব প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃল্পদ্ম প্রথম উন্মোচিত হইল।… বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।” তিনি যে রুচি, চিন্তা ও মনীষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আজকের বাংলা সাহিত্যে বিরল।
বটু কৃষ্ণ হালদার,কলকাতা_১০৪

আমার রচিত কবিতা প্রকাশ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
"ঝড় এলেও ভাঙবে না", এই বহু অভিজ্ঞতার গদ্যে কবি, লেখক ও ইঞ্জিনিয়ার শ্যামল মন্ডল খুব টানটান করে নানা অভিজ্ঞতার গল্প…
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice