Spread the love

 গল্প:—“একান্ত আপন”

কলমে—-মেরী খাতুন

রবি কুমার সান্যাল মালদায় পোস্টমাস্টারের চাকরি করতে করতে তাঁর পত্নী তিন ছেলে আর দুই মেয়ের জন্ম দিয়ে বিগত হয়েছেন।গত চার বছর।অর্থাৎ ঠিক রিটায়ার করার পরের বছর চলে গেছেন।তিনটি পুত্রের মধ্যে একটি পুত্রকে শ্রীভগবান নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন খুব অল্প বয়সে,অনেক দিন হলো।বড় মেয়ের মালতি,অতিরিক্ত বয়স হয়ে গিয়েছে।,আর ছোটটি সুনীতি এখনও কলেজ ছাড়েনি। সান্যালমশাই মালদার স্টেশন রোডের ধারে এক টুকরো জায়গা কিনে তার ওপর ছোট একতলা বসতবাড়ি করেছিলেন বলে বাঁচোয়া।সামান্য মানুষের সামান্য বাড়ি, তার বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন কী।বড়মেয়েটি দর্শনধারী তো নয়ই,বরং বেশ সুগঠিত,স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপূণা,ত্রিশোর্ধ্ব বয়স এবং এই সংসারের পক্ষে উপযুক্ত তো নিশ্চয়।
আজ বড় মেয়ে মালতিকে দেখতে আসছে।কাটিহার থেকে।
সকাল আটটায় মালদা স্টেশন পৌঁচ্ছায় ডঃ রাকেশ।রবি বাবুর বাড়ি খুঁজে নিতে অসুবিধা হয় নি রাকেশবাবুর।

—-কড়া নাড়লেন রাকেশবাবু।, দরজা খুললেন রবিবাবু।
দুজন দুজনের দিকে এগিয়ে এলো।রবিবাবু বললেন আপনি রাকেশবাবু না? কাটিহার থেকে।
হ্যাঁ আমি রাকেশ।
আমি রবি কুমার সান্যাল।
রাকেশ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো,যেটা তার ধাতে নেই। তার কাঁধের ব্যাগটি চমৎকার,তার জামাকাপড় পরিপাটি, মুখটি নিখুঁত ভাবে কামানো।কানে দুপাশে চুলে কিছু সাদার ছোপ লেগেছে বটে,তবু তার শরীর বেশ সুঠাম।তাহলে এই পাত্র,সেই রকম পরীক্ষকের চোখ দিয়ে মেপে নিলেন রবিবাবু।এই তাহলে ডাক্তার রাকেশ ভাদুড়ি, পাত্র নিজে এসেছে,সঙ্গে কাউকে আনেনি।মেয়েটার যদি ঠিক সময়ে বিয়ে হত,তাহলে জামাই কি এমন হতো দেখতে? কতটা বয়েস হবে,চল্লিশ নাকি বেশি হবে আরোও। ঠিকই আছে তাহলে মালতি প্রায় পঁয়ত্রিশ,বলা হয় তিরিশ।তার চিন্তা ভাবনার কথা থাক।

—– উঠোনের চারিদিকটা এক নজরে দেখে নিল রাকেশ।একতলা এল অক্ষরের মতো বাড়ি,সামান্য ছাতবিহীন বারান্দা,ছাতে ওঠার দিক আছে,তাতে চিলেকোঠা আছে,আছে তার টাঙানো।সেই তারে শাড়ি সায়া ব্লাউজ ঝুলে রয়েছে।রেললাইনে মালগাড়ি যাওয়ার শব্দ,কোথা থেকে মাইকে হিন্দি গানের শব্দ। বাড়িটার পুরোটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।এটাকে ঠিক শশুড়বাড়ি ভাবতে পারলো না রাকেশ ডাক্তার।কিন্তু যে কারণে আসা,যদি রবিবাবুর বড় মেয়েকে ঠিক মনে হয়,তো আজই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যেতে পারে।বিয়ে করাটা তার খুবই দরকার,একটা দিনও দেরি করার উপায় নেই।এমন করে ভাবতে খারাপ যদিও লাগছে,তবুও এটাই সত্যি। বাঙালি মেয়ে চাই,শিক্ষিতা মেয়ে চাই আর সবচেয়ে যেটা জরুরি,সেটা হল তার প্রথম দিন থেকে সংসারের হাল ধরার মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া চাই।শশুড়-শাশুড়ি, নিজের দুটো ছেলেমেয়ে,কর্মব্যস্ত স্বামী এবং চাকরবাকর মালি ড্রাইভার সমেত বিশাল সংসার চালানো মুখের কথা নয়।এবং সেটা করতে হবে ঘরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।এত সব চাই চাইয়ের ঠেলায় উপযুক্ত মেয়ে পাওয়া মার খেয়েছে এত দিন।কেবল আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের উত্তরে যে বায়োডাটা রবিবাবু পাঠিয়েছিলেন,সেটা পড়ে মা বলেছেন, এই মালতিই তাঁর কাছে ঠিক পাত্রী মনে হয়েছে, তাই আসা।
——ভেতরে আসা হোক।
রবিবাবু তুমি আপনি দুটোতেই সঙ্কোচ বোধ করছেন।তক্তপোশের উপর পরিস্কার চাদর পাতা দুটো বালিশ,কারোও হাতের স্পর্শে প্রাণ পাওয়ার চিহ্ন সর্বত্র লেগে আছে ঘরময়। ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখল রাকেশ ডাক্তার।
——আমাকে রাকেশ বলবেন,তুমি বলবেন কেমন।
——বেশ বেশ,সেই ভালো।বসো তুমি তাহলে এখন,আমি দেখছি ভেতরের দিকটা।
তাঁকে দেখতে আর যেতে হল না,এক মহিলা ট্রেতে করে জলের গ্লাস,খাবারদাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো।রবিবাবু একগাল হেসে বললেন, এই আমার বড় মেয়ে মালতি।আয় আয়,আর এই ইনি হলেন ডাক্তার রাকেশ ভাদুড়ি, কাটিহার থেকে এসেছেন।
—–সুস্মিত হেসে দু হাত জোড় করে মালতি নমস্কার করল।
ডাক্তারি চোখে জরিপ করলো রাকেশ, মুখের মধ্যে ক্লান্তি বা হতাশার লেশ মাত্র নেই। বরঞ্চ একটি প্রাপ্তি উজ্জ্বল হয়ে ফুটে রয়েছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার জোড়া ভ্রু, বড় বড় টানা চোখের ওপর সে দুটো বড় আকর্ষণ করে।গায়ের রঙ  ময়লা আর মুখশ্রীতে লাবণ্যের কিছু অভাব রয়েছে মনে হয়। অনেকটা গোল গোল,মোটা মোটা ধরনের গড়ন।মালতি নিজেই বললো,বাড়িতে অতিথি, কী করি বলুন? লজ্জা করে বসে থাকার উপায় নেই।
——সুনীতি কোথায়?
—–তার কলেজে পরীক্ষা আছে, আসবে একটু পরে।তুমি বেশি ভেবো না বাবা,উনি মেয়ে দেখতে এসেছেন, দেখে যান ঠিক ঠিক যা দেখার, যেমন আছি তেমনি দেখবেন।
রবিবাবু টেবিল এগিয়ে আনল,তার ওপর রাখা হলো জলখাবারের থালা। বেশ ভালো আয়োজন,সবই বাড়িতে তৈরি। মালতির হাতের ছাপ রয়েছে  লুচিতে গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ, শুকনো আলুর দম আর মিষ্টি লাড্ডু। মনটা ভরে গেল রাকেশের।
—–নিন কিছু  খান, খেতে খেতে বাবার সাথে কথা বলুন।
—-পেটে খিদে ছিল—সব খেয়ে ফেলল সে। বিশেষ করে লাড্ডু সেটার অপূর্ব টেস্ট।
—–সব মালতির তৈরি। খুব ভালো রাঁধে বড়কি।
——আমার স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর হলো।ছোট বেটি কলেজে পড়ে। ফাইনাল ইয়ার,বি এ।মালতিই সংসার চালায়।বড় ছেলে কোলকাতায়–রেলের চাকরি।ছোট ছেলে শিলিগুড়িতে একটি কারখানার স্টোরকিপার।দুজনের চাকরি,বিয়েও হয়ে গিয়েছে অতএব নিশ্চিত।
——-তা তোমার সাথে আর কেউ আসেনি, বাবা–মা, বন্ধুরা?
——বাবার  চুরাশি বছর বয়স।মার আশি বছর।বাবার  প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়েছে একমাস হলো।অপারেশন করাবেন না।আর বন্ধুরা তাদের সময় কোথা? একটা কথা বলি আপনাকে, মালতিকে নানারকম খাবারের আয়োজন করতে বারন করুন। বরঞ্চ আমাদের পরিবার সম্পর্কে তাকে কিছু কথা বলার দরকার ছিল। যদি তার ঠিক মনে হয়, তবেই পরের কথা হতে পারে। আমি রাতে ফিরে যাব।বুঝতেই পারছেন সময় খুব কম।
——তোমার কি মালতিকে পচ্ছন্দ হয়নি? কিন্তু অপছন্দ হওয়ার মেয়ে সে নয়।একথা বাবা হয়ে আমি বলছি না, ওর মূল্য জানি বলেই বলছি।
—–এখনও পর্যন্ত অপছন্দ হওয়ার মতো কোনও কারণ দেখিনি। বরঞ্চ আমার তো ভালোই লেগেছে। আপনি ওকে ডেকে আনুন। চলে গেলেন রবিবাবু।রাকেশ বিবেচনা করলো পরিস্থিতিটা। তাদের কাটিহারের  বাড়িতে তিনটে বেডরুম, ড্রইং, ডাইনিং, কিচেন দুটো বাথরুম নিয়ে যথেষ্ট জায়গা। অসুস্থ বাবা-মা আর দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ জটিল সংসার। রাঁধুনি, বাসন মাজার লোক, কাপড় কাচার লোক, ড্রাইভার মালি সব মিলে সকাল থেকে ঝড় বয় প্রতিদিন। নিজের সারাদিনের কাজও বেশ জটিল। সকালে নিজের ক্লিনিক, দুপুরে নার্সিংহোম, বিকেলে আবার গোবিন্দপুর গ্রামে ফ্রিতে রুগি অসম্ভব ভিড় সামলে রাত দশটায় বাড়ি ফিরে শরীরে কিছু থাকে না।
কাজের লোকেরা যখন ছুটি নেয় কে বাচ্চা সামলায় কে বয়স্ক মানুষদের দেখে।নিজের লোক চাই আজই,পারলে এক্ষুনি।

মালতি চায়ের কাপ নিয়ে এল।
—–আবার চা কেন? বসুন এখানে, কথা আছে, খুব জরুরী কথা।
—–এখন চা খান,আর আপনি বলার দরকার নেই। তুমি বললেই ভালো হয়।
—-বেশ তাই হবে।শোন মালতি,মা তো আমার সমস্ত বায়োডাটা দিয়ে দিয়েছে তবুও তোমাকে আমি বলছি,আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল। মাধ্যমিক পাশ ছিল। বাবার বন্ধুর মেয়ে বলে আমার কোন কথায় কেউ কান দেয়নি। মাও জোর করে রাজি করিয়েছেন।
শ্রীময়ীর আমার স্ত্রীর নাম।
—–বয়ঃসন্ধির সময় সে বার বার ফিট হতো,বিছানা ভিজিয়ে ফেলত।মৃগী রোগ বলতে পারো,হিস্টিরিয়া। ওরা এসব কথা চেপে গিয়েছিল।
—-এই সব নিয়ে শ্রীময়ীর ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল।বিয়ের দশ বছর পর তার ধারনা হয়েছিল,তার বিয়ে করাটা ভালো হয়নি।
—–চিকিৎসা করাননি?
——আমি নিজে ডাক্তার,তার ওপর স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব রয়েছে, আমি প্রতিটি ঘটনার সাক্ষী।সে ধীরে ধীরে নিজেকে ক্ষয় করে ফেলল,সামান্য চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দিল না।সাইকায়াট্রিস্টের কাছে গেল না।খাওয়াদাওয়া করতো না,কিন্তু নিজের বাচ্চাদের অযত্ন করতো না।খুব যত্ন আর ভালোবাসতো। তারাই ওর সব ছিল। আমার যথেষ্ট রোজগার মালতি, কিন্তু ও আমাকে বড় দুঃখের মধ্যে ফেলে রেখে গেল।বাথরুমের মধ্যে ঢুকে গায়ে আগুন দিয়েছিল। বড় বেদনাদায়ক অবস্থা মালতি,আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না।
—-কতদিন হল এই ঘটনা?
—–দু বছর আগের কথা এটা। আরও একটু আছে–পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করেছিল,পরে সব বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়।খবরের কাগজে সমস্ত ঘটনা ফলাও করে বেরিয়েছিল। এবার তুমি ভেবে দেখ এমন পরিবারে তুমি যাবে কি না।সময় নাও।চিন্তা করে দেখ ঠান্ডা মাথায়।
—-এখানে এসে যেটুকু দেখলাম তাতে তোমার বুদ্ধি, সাংসারিক কর্মদক্ষতা, সহজাত মায়া দেখে আমি অবাক। যে বাড়িতে মা নেই অথচ মায়ের অভাব নেই,সেই মেয়েটিকেই আমার বড় প্রয়োজন।আমার একজন মায়ের দরকার, স্ত্রীর জন্য আসিনি মেয়ে দেখতে।
—–আর তার পরের কারণ?
—-তুমি গ্র্যাজুয়েট, শিক্ষিতা মহিলা,মনের দিক থেকে আমার অনেক কথা বুঝতে পারবে।এবার সমস্ত জিনিসটা তোমার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
—–বেশ তাই হবে।এখন আমি যাই।আপনি একটু বিশ্রাম করুণ। দুপুরের লাঞ্চ হয়ে যাবার পর আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।খুব ভালো যায়গা, সেখানেই আপনার কথার উত্তর দেব।মালতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এক অনাস্বাদিত অনুভূতি ঢেকে নিল ডাক্তারকে।কেমন যেন একটা সুগন্ধ আবহাওয়া বয়ে এনেছে কেউ,সেই আবেশে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

রবিবাবুর  ডাকে ঘুম ভাঙলো রাকেশবাবুর।মুখটুক ধুয়ে খাবারের জায়গায় এসে দাঁড়ালো সে।এটা বোধহয় খাবারঘর, মাটিতে আসন পাতা।বড় কানা উঁচু পেতলের থালায় প্রচুর ভাত,ভাজাভুজি, বাটিতে ডাল,তরকারি, মাছ,মাংস আর বোধহয় দই সাজানো হয়েছে থালার পাশে পাশে।তার পিছনে স্বয়ং মালতি।ভাবছিল কি করবে।এত ভাত সে কোনও দিনই খায় না।দু চামচ হলেই যথেষ্ট।
—–বসুন।
——-এতো ভাত?
——-বেশ তো,কমিয়ে দিচ্ছি। আর একটি পিতলের থালায় ভাত তুলে নিল মালতি।রবিবাবু  বসলেন খেতে।
খাওয়া শুরু করলো রাকেশ। এমনভাবে কোনওদিন খায়নি সে,নিজের বাড়িতেও না।তাদের খাবার টেবিলে গদিমোড়া চেয়ারে বসে লা-ওপালার প্লেটে এক চামচ ভাত একটু ডাল আর একটা মাছ কিংবা চিকেন তুলে নেয় সে নিজেই। শ্রীময়ী প্রায়ই শুয়েটুয়ে থাকতো,মার অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকার কথা নয়।ঠান্ডা ঠান্ডা ভাত গলা দিয়ে নামার সময় বেশ দুঃখ হতো তার।এখন এই ঘরে তিনজনের সান্নিধ্যে তার চোখে জল ভরে এল।
——ঝাল বেশি হয়েছে কি?
——না না,ঠিক আছে।
অল্প অল্প করে পরিবেশন করলো তাকে মালতি।কতদিন মাটিতে বসে খাওয়া হয় না।কতদিন মা-কিংবা বউ পাশে থেকে একটা বড়া ভাজা কিংবা মাছ ভাজা পাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করে না,আজ দিনটা কেমন কাটলো? তাকিয়ে দেখল মালতি কেমন কোমল স্নেহময়ীর চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।বেশিই খাওয়া হয়ে গেল অনেকদিন পর।হাত ধুয়ে, রুমালে হাত মুছে বৈঠকখানায় এসে বসল রাকেশ।মালতি কোথায় নিয়ে যাবে বলেছে। সেখানে সে নিজের কথা বলবে।
একটু পরে মালতি তৈরি হয়ে একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলো,আমার ছোট বোন সুনীতি।মেয়েটা টপ করে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ফেলল।বেশ লম্বা গড়ন,পাতলা পাতলা চেহারা, বছর কুড়ি-বাইশ হবে।
—-খেয়েছো তোমরা? কেমন পরীক্ষা হল।
—-হ্যাঁ ভালোই হয়েছে সুনীতর জবাব।
—-সুনীতি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

—–চলুন, দুজনে হাঁটছিল স্টেশন থেকে উল্টো দিকের রাস্তায়। একটা মোড় পেরিয়ে রিকশা ডাকল মালতি চলেন, “জোহরা তলা মন্দির’।নিঃসঙ্কোচে পাশে উঠে বসল সে গায়ে গা ঠেকিয়ে।
—- মন্দিরে পৌচ্ছে, প্রণাম করুন, মাকে আমি খুব বিশ্বাস করি। এখানে কেউ মিথ্যে কথা বলে না।আর সত্য বুদ্ধি নিয়ে বললে মা সকলকে সত্য পথ দেখান।আপনার সব সমস্যার সমাধান করবেন মা, এ আমার বিশ্বাস।
—-মন্দিরের ঘন্টা বাজিয়ে নেমে এলো দুজনে।মন্দিরের পাশে একটা খোলা আকাশের নীচে বসল দুজনে।
মালতি বললো, এবার আমার কথা বলি।

——  বলো মালতি, তোমার কথা শুনব বলেই তো তোমার সঙ্গে এলাম। মালতি রাকেশের পাশে এসে বসল।
——-মায়ের অবর্তমানে সংসারটার সমস্ত দায়িত্ব আমার হাতে এসে পড়েছে স্বাভাবিকভাবে।কিন্তু প্রতিটি মেয়েরই বিয়ে হয়,তারা শ্বশুরবাড়ি যায়। আমার বাবাও তাই চাইছেন। বুঝতে পারছি আপনাদের সংসারেও আমার প্রয়োজন পড়েছে। আপনাদের একজন মানুষের দরকার যে গিন্নিবান্নির ভূমিকায় প্রথমদিন থেকেই ফিট হবে, ঠিক কি না?
—ঠিক বলেছো তুমি।
তাহলে এই পোড়া দেশে যে কয়েক কোটি বয়স্কা মহিলা রয়েছেন কুমারী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, অথবা এঁটো হয়ে যাওয়া মানুষ, যাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়,তাদের যে কেউ একজন হলেই হয়।তাদের যে কেউ ঘর-সংসার দেখতে পারবে, বাচ্চাদের দেখাশোনা করতে পারবে,রোগীকে চান করানো খাওয়ানো এবং রাতে বিছানায় শুতে পারবে।তাই যদি আপনার ডিমান্ড হয়, তো গন্ডায়  গন্ডায় অমন মেয়েমানুষ পেয়ে যাবেন। মালতির মুশকিল কী জানেন তার মন বলে একটি পদার্থ  রয়েছে। তারও স্ত্রী হতে সাধ যায়।তারও একটি সুস্থ পরিবেশ,একটি পরিষ্কার হাওয়া-বাতাসের প্রয়োজন। যদি মনে করেন সেই কামনা কেবল একটি বয়েস পর্যন্ত ঠিক, তার পর থেকে সে সবের দরকার নেই, তাহলে মালতির দরকার কী? সে কেবল কর্তৃত্বই করতে জানে না,ভালোবাসতেও জানে এবং সেটি পাওয়ার ও আশা করে।আপনি আমার ওপরটা দেখছেন, ভেতরের খবর রাখেন কী?
দম নিল মালতি।অনেক কথা বলে ফেলেছে বলে কিছুটা যেন লজ্জিত হল।
রাকেশ একটু আগেই বলেছে তার একজন গিন্নি চাই,স্ত্রী চাই না। ঘুরিয়ে বলেই দিয়েছে মালতি, রাকেশকে তার পছন্দ হয়নি। তার কথা মালতিকে আহত করেছে,খুব বড় একটা দোষের ব্যাপার হয়ে গেছে।
——জানো মালতি, আমি রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত রোগ আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।বয়সটাও গড়িয়ে গিয়ে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে,আমি জোর দিয়ে বলতে পারি না একজন ভাল স্বামী হওয়ার সব গুণ আমার আছে।হয়তো তোমরা মেয়েরা যা চাও,তার পুরোটা প্রত্যাশামত পূরণ করার যোগ্যতা আমার নেই। কী জানি!
হঠাৎ প্রশ্ন করল মালতি,সত্যি করে বলুন তো, আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসতেন আপনি?
——-তেমন করে বোধ হয় না।একসাথে থাকতে থাকতে যেমন গড়ে ওঠে,তেমনি ছিল আমাদের সম্পর্ক।
—— আর ছেলে-মেয়েদের? মন খুলে সব কথা বলুন আপনি আমার কাছে।
—–যে জন্যে আমি একজন মায়ের খোঁজ করছি, হন্যে হয়ে খোঁজ করছি, নিজেকে বাদ দিয়ে ভাবছি, তার পেছনে একটা বিশেষ ঘটনা রয়েছে মালতি।আমার সমস্ত সত্তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সেটা। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারবে কেননা তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, আমার চেয়েও সাংসারিক অভিজ্ঞতা তোমার অনেক বেশি। আমার ছেলের নাম সুমিত। মাত্র পাঁচ বছর বয়স।একদিন স্কুল থেকে ফিরল না। মা ফোন করলো নার্সিংহোমে।খোঁজপাত শুরু হলো।স্কুল বন্ধুদের বাড়ি, জানাশোনা সবার কাছে খোঁজ নেওয়া হলো,কোথাও নেই। সে যে কি অসহ্য কষ্ট বলা যায় না। মা হারা ছেলেটা গেল কোথায়! রাকেশের চোখ ফেটে জল নামল।সন্ধ্যে উতরে রাত নামল, সুমিত ফিরল না।পুলিশকে খবর দিতে গেলাম আমি নিজে।তারপর বাড়ি ফিরে দেখি সুমিত ফিরেছে।এমন কিছু ব্যাপার নয়,সুমিত স্কুল বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। স্কুল বাসটা সব বাচ্চাকে নামিয়ে ডিপোতে ফিরে যাওয়ার পর আবিষ্কার হলো ঘুমন্ত বাচ্চা।তাই সে দিন দেরি হয়ে যায়  সুমিতের বাড়ি ফিরতে।ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরকে কী বলে যে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাবো বুঝে পেলাম না। আর তখনই অনুভব করলাম শিশুদের কাছে মায়ের কোনও বিকল্প হয় নেই। মা চাই,একজন ভালো মায়ের দরকার। এর বেশি কিছু আমার মাথায় আসেনি।
—–আমি নিজের জন্যে কোনওদিন ভাবিনি মালতি,কিন্তু সুমিতের ঘটনা আমাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। এখন তুমি আমাকে বলো আমি কী করব,কী করতে পারি অথবা কী করা উচিত।
অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখলো মালতি।বড় শ্বাস নিল সে।বিভ্রান্ত দেখাছিল তাকে। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, শোনো তুমি আমাকে তোমার বুকে চেপে ধরতে পারবে?

—-কি বলছো তুমি?
—–আমাকে ধরো তো তুমি নিজের বুকে।
অপ্রস্তুতের মতো মালতীকে আলতো কর ধরলো ডাক্তার। কানের কাছে শুনল মালতি বলছে,আরও চেপে ধরো তুমি। ভয় কী, আমিই তো বলছি।
টিপে ধরলো সে।তার সুগঠিত শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো ডাক্তারের দু হাতের মধ্যে কয়েকবার।
মালতির অন্তরাত্মা হাহাকার করে উঠল,হে ঈশ্বর এমন কেন হয়!এমন করে দুমড়ে মুচড়ে গুড়িয়ে যায় কেন হৃদয়!উষ্ণ পুরুষ স্পর্শে শিহরণ হয় কেন শরীরে? এর নাম কি ভালোবাসা?এ যদি ভালোবাসা না হয়,তা হলে একে কী বলবো? কামনা বাসনার কি ভালোবাসার আর এক নাম নয়? হে ঈশ্বর আমার শরীরে একী খেলা খেলছে তুমি? দুটো বলিষ্ঠ বাহুর মধ্যে মিশে যেতে চায় কেন আমার শরীর? আরও শক্ত করে ধরে থাকো তুমি, ধরে থাকো চিরকাল। অনেক অনেক সময় ধরে অনন্ত সময় ধরে এমনি করে বেঁধে রাখো আমাকে।স্বপ্ন ছিল সে আসবে, সে আসবে,নির্ধারিত সেই একজন আমার নিজের, একান্তভাবে আমার। সে আমার হয়ে থাকবে চিরকাল। এত দিনে সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হল। এখন আর কোনও দ্বিধা নেই, শঙ্কা নেই, দুহাত ভরে জীবন সুধা পান করতে আমার আর কোনও বাধা নেই।মন্দির থেকে বেশ কয়েকজন তাদের দেখছে।মালতির হুঁশ নেই।
তখনও মালতির ঘোর কাটেনি, মনেরও বা শরীরেরও না।

******************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *