Spread the love


      ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★ –July- 22
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১১। কাক ও হংসের উপাখ্যান।

প্রমাদগ্রস্ত হে তুমি মদ‍্যপ যেমতি।
কহেন শল‍্য তখন ক্রুদ্ধ কর্ণ প্রতি।।
চিকিৎসা প্রয়োজন অতীব সত্ত্বর।
সুহৃদ আমি নহিক শত্রু কিম্বা পর।।
হিত বা অহিত তব যাহা মোর জ্ঞাত,
উচিত তাহাই মোর করা অবগত।।
এবে এক উপাখ্যান করিব বর্ণন।
মনোযোগ সহকারে করহ শ্রবণ।।

সাগরের তীরে ছিল কোন এক দেশ।
ছিল তথা বৈশ‍্য এক ধনবান বেশ।।
ছিল তার বহু পুত্র পেট পরায়ণ।
প্রতিদিন নানা খাদ্য করিত ভক্ষণ।।
ভুক্তাবশিষ্ট খাবার সেই পুত্রগণ,
প্রত‍্যহ বায়সে এক করিত অর্পণ।।
উচ্ছিষ্টভোজী বায়স হইয়া গর্বিত,
অন‍্যসব পক্ষীদলে অবজ্ঞা করিত।।
একদা সাগর তটে বলাকার দল,
অবতরি সেথা সবে করে কলাহল।।
দ্রুতগামী তারা সবে গরুড়ের প্রায়।
মন সুখে করে বাস বিচরি তথায়।।
বৈশ‍্যপুত্র কাকে কয় শোন বিহঙ্গম্ ।
শ্রেষ্ঠ তুমি উড্ডয়নে অতি পারঙ্গম্ ।।
তোমার চেয়ে নিকৃষ্ট বলাকার দল।
দ্রুতগামী তুমি অতি আছে সেই বল।।
গর্বিত বায়স তায় পুলকিত প্রাণ।
উড্ডয়নে বলাকারে করে আহ্বান।।
গর্বিত বায়সে কহে বলাকার দল ।
উড়িলে মোদের সাথে হইবে বিফল।।
বিচরণ করি মোরা মানসের জলে।
দূর দূরান্তে উড়িয়া যাই অবহেলে।।
ক্লেশ নাহিক মোদের দূরান্ত গমনে।
পক্ষীকুলে খ‍্যাত মোরা তাহার কারণে।।
কাক তুমি তব পক্ষ অতীব দুর্বল।
মোদের সাথে উড়ানে হইবে বিফল।।
গর্ব ভরি কহে কাক উড়ি অবিরত।
উড়ানের প্রথা আমি জানি একশত।।
পদ্ধতি প্রতি গমন শতেক যোজন।
ক্লান্তি নাহি মোর করি সুখাদ‍্য ভোজন।।
বিচিত্র পদ্ধতি মোর নিডীন প্রডীন।
ক্ষমতা দর্শিবে মোর হইলে উড্ডীন।।
কহ মোরে কোন গতি লইব শরণ।
তোমরা সকলে পিছে করিবে গমন।।
গ্রহণ করহ তাহা ইচ্ছা যাহা মনে।
কহিল হংস এক বায়স বচনে।।
উড়িল আকাশে তারা দর্শিতে ক্ষমতা।
মসৃণ বলাকা গতি হয়না অন‍্যথা।।
কাক ধরে নানা গতি ক’রে নানা দশা।
হেরি তাহা পক্ষীকুল করে প্রশংসা।।
বলাকার গতি হেরি বায়সের দল,
বিদ্রুপের হাসি হাসে ক’রে কোলাহল।।
সেই হাসি বলাকারা করিল শ্রবণ।
তারপর তীব্র বেগে করিল গমন।।
পশ্চাতে রহিল কাক ধায়িল সাগরে।
হেরিয়া সাগর কাক অতি ভয়ে মরে।।
তথাপি সে চলে উড়ে বলাকার পিছে।
কিন্তু ক্ষমতা জাহির হলো শেষে মিছে।।
উড়ে উড়ে ক্লান্ত কাক ভয়ে হলো ভীত ।
বৃক্ষহীন সাগরেতে মরণ নিশ্চিত।।
অবশেষে হলো ভারি ডানা দুটি তার।
শ্রান্ত হ’য়ে কাক পড়ে জলে বারবার।।
পশ্চাতে ফিরে হংস দেখে সে দুর্গতি।
কহে তারে কিবা নামে ভূষিত এ গতি।।
কহে কাক দম্ভ মোর ছিল অকারণ।
রক্ষা কর মোরে তুমি লইনু শরণ।।
নিয়ে চল তুমি মোরে সাগরের তটে।
শিক্ষা হ’লো খুব মোর এই ছিল ঘটে।।
রক্ষা কর ভাই তুমি কহি বারবার।
কাহাকেও হেয় আমি করিব না আর।।
বায়স-বিলাপ হংস করিল শ্রবণ।
জল হ’তে তারে তাই করে উত্তোলন।।
তারপর চলে উড়ে সাগরের তীরে।
হেনরূপে প্রাণ তার কাক পায় ফিরে।।
কহিলেন শল্য সাঙ্গ করি উপাখ্যান।
এইবার কর্ণ তুমি কর প্রণিধান।।
উচ্ছিষ্ট ভোজী বায়স তুমি কুরু কুলে।
গর্ব আর অহঙ্কারে সব গেছ ভুলে।।
তব হ’তে শ্রেষ্ঠ জনে কর হেয় জ্ঞান।
পরিণতি কিযে তার পাইলে প্রমাণ।।
পাইল জীবন কাক হংস শরণে।
তুমিও শরণ তাই লহ কৃষ্ণার্জুনে।।
ত্যাজ তুমি অকারণ অহং চিন্তন।
অহং বর্জিত সদা জ্ঞানী-গুণীজন।।

১২। কর্ণের শাপ বৃত্তান্ত ।

কৃষ্ণার্জুন শক্তি কত আছে মোর জ্ঞান।
তথাপি করিব যুদ্ধ ভয়হীন প্রাণ।।
পরশুরাম শাপেতে উচাটন অতি।
যুদ্ধে না জানি আমার কিবা হয় গতি।।
পরশুরাম অভিশাপ কিবা সে কারণ।
কহেন কর্ণ সে কথা করিব বর্ণন।।
পরশুরামে মানিয়া অস্ত্রগুরু মনে,
চলিলাম একদিন তাঁহার সদনে।।
ব্রাহ্মণ হইলে তিনি করেন গ্রহণ।
ব্রাহ্মণের বেশে তাই লইনু শরণ।।
দিব্যাস্ত্রের শিক্ষা হেতু কুটীরে তাঁহার,
রহিলাম শিষ্যরূপে আকাঙ্ক্ষা অপার।।
একদিন রেখে মাথা মোর ঊরু ‘পরে,
নিদ্রা যান গুরুদেব নিশ্চিন্তে অঘোরে।।
হেনকালে কীট রূপ করিয়া ধারণ,
দেবরাজ করিলেন মোরে দংশন।।
করিলেন তিনি মোর ঊরু বিদারণ।
তাহা হ’তে হয় অতি শোণিত ক্ষরণ।।
তবু আমি স্থির অতি গুরুদেব লাগি।
নিদ্রাভঙ্গ হ’য়ে তিনি পাছে যান জাগি।।
ক্ষণপরে হেরিলেন নিদ্রা জাগরণে,
সহ্য শক্তি মোর সেই শোণিত ক্ষরণে।।
সাথে সাথে সংশয় জাগে তাঁর মনে।
ব্রাহ্মণ নয়তো আমি দৃঢ় বোধ মনে।।
কহিলেন তিনি মোরে কহ সত্য বচন।
কিবা পরিচয় তুমি করহ বহন।।
ভয়ে আমি সত্য কথা করিনু জ্ঞাপন।
অতি ক্রুদ্ধ গুরু মোরে শাপেন তখন।।
কপট উপায়ে অস্ত্রে লভিয়াছ জ্ঞান।
কার্যকালে ব্যর্থ হবে নাহি পরিত্রাণ।।
ভুলে যাবে কিবা অস্ত্র ঘোর যুদ্ধ কালে।
হইবে মরণ তব জেনো তার ফলে।।
কহিলেন কর্ণ পুন শোন মদ্ররাজ,
যথেষ্টই ছিল মোর সেই অস্ত্র আজ।।
কিন্তু আমি অন্য অস্ত্র করিব ধারণ।
সেই অস্ত্রেই অর্জুনে করিব নিধন।।
ব্রাহ্ম অস্ত্র আমি এক করিব ক্ষেপন।
অকল্পনীয় শক্তিতে নিশ্চিত মরণ।।
আর এক শাপে শপ্ত ধেনু বধ তরে।
অভিশাপ দেন এক ব্রাহ্মণ আমারে।।
কিছুকাল পূর্বে কোন একদিন প্রাতে,
অস্ত্রাভ্যাসে ছিনু রত ধনুর্বাণ হাতে।।
সবৎস ধেনু সেথা করে বিচরণ।
মোর শরে ধেনু এক লভিল মরণ।।
ইচ্ছাকৃত নহে বধ ভুলের কারণ।
মনোপীড়া মোর কত তাহার কারণ।।
হেরিয়া ব্রাহ্মণ মোরে দেন অভিশাপ,
‘রে দুরাত্মা! হেন কর্মে হলো মহাপাপ।।
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সনে যুঝিবার কালে,
অকারণে সেই রণে মরিবি অকালে।।
মেদিনী করিবে তোর রথচক্র গ্রাস।
তাহার কারণে তোর হবে প্রাণ নাশ’।।
চাহিলাম করিবারে বহু ধেনু দান।
ব্রাহ্মণের তবু তাহে নাহি গলে প্রাণ।।
করিলেও নিন্দা মোরে আপনি আপন।
কহিলাম গুহ্যকথা না করি গোপন।।
কর্ণের নহে জনম হইবারে ভীত।
মদ্ররাজ আপনারে করি অবগত।।
শল্যহীনে আমি যুদ্ধ জিনিতে সক্ষম।
মদ্ররাজ আছে মোর তদ্রূপ বিক্রম।।
ক্রোধান্বিত মদ্ররাজ কহেন তখন,
সারথি করিলে কেন কহ সে বচন।।
হেনকালে দুর্যোধন আইলেন তথা।
নিবারণ করিলেন বিবাদ অযথা।।

( চলবে )

কবি কৃষ্ণপদ ঘোষ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *