স্বামী বিবেকানন্দ ও কুমারী পূজা
বটু কৃষ্ণ হালদার
নবরাত্রি (নব রাত্রি) একটি হিন্দু ধর্মীয় উৎসব, যা মা দুর্গার ন’টি রূপের পূজার মাধ্যমে উদযাপিত হয়। “নবরাত্রি” শব্দের অর্থ—নয়টি রাত। এই উৎসব সাধারণত বছরে দু’বার পালিত হয়—চৈত্র নবরাত্রি ও শারদীয়া নবরাত্রি। এর মধ্যে শারদীয়া নবরাত্রি সবচেয়ে জনপ্রিয়, যা দুর্গাপূজার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
নবরাত্রির নয় রূপ (নবদুর্গা):
প্রতিটি দিনে এক একটি দেবীর পূজা হয়:
মা শৈলপুত্রী – পর্বতের কন্যা, শিবের পত্নী
মা ব্রহ্মচারিণী – তপস্যার প্রতীক
মা চন্দ্রঘণ্টা – শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক
মা কুষ্মাণ্ডা – সৃষ্টি শক্তির মূর্তি
মা স্কন্দমাতা – কার্তিকের জননী
মা কাত্যায়নী – অসুর বধকারী
মা কালরাত্রি – অন্ধকার বিনাশকারী
মা মহাগৌরী – পবিত্রতার প্রতীক
মা সিদ্ধিদাত্রী – সিদ্ধির দাত্রী
নবরাত্রির তাৎপর্য:
আধ্যাত্মিক শুদ্ধিকরণ: আত্মা ও মনকে বিশুদ্ধ করার সময়।
নারীর শক্তির পূজা: নারীত্ব ও মাতৃত্বের পূর্ণ রূপকে সম্মান জানানো হয়।
উপবাস ও উপাসনা: উপবাস রেখে ভগবতী মা-র পূজা ও আরাধনা করা হয়।
দুর্গোৎসবের একটি বড় অঙ্গ হচ্ছে কুমারী পূজা । কুমারী পূজা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কৌতূহলের কমতি নেই । ভারত ও বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমীর মহাতিথিতে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে ।শাস্ত্রকাররা নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধা করতে এই পূজা করতে বলেছেন । আমাদের হিন্দুধর্মে নারীকে সন্মানের শ্রেষ্ঠ আসনে বসানো হয়েছে ।শাস্ত্র অনুসারে কুমারী পূজার উৎপত্তি হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে । উপাখ্যানে বর্ণিত রয়েছে, কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবতাগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন । সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন । এরপর থেকেই মর্ত্যে অর্থাৎ পৃথিবীতে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয় ।
পুরোহিত দর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয় । তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত হলেও কোথাও বলা নেই যে ব্রাহ্মণকন্যাই কেবল পূজ্য। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়।বয়সের ক্রমানুসারেযেমন এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা,দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী,তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি,চার বছরের কন্যা — কালীকা,পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা,ছয় বছরের কন্যা — উমা,সাত বছরের কন্যা — মালিনী,আট বছরের কন্যা — কুব্জিকা,নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা,দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা,এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী,বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী,তেরো বছরের কন্যা — মহালক্ষ্মী,চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা,পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা,ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো- নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
স্বামীজি মহা অষ্টমীর দিন কুমারী পূজা আরম্ভ করেছিলেন তাঁর একনিষ্ঠা শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতা কে সঙ্গে নিয়ে।সালটা ছিল ১৮৯৮,চিকাগো থেকে ফেরার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।স্বামীজী বসে ছিলেন বেলুড় মঠের গঙ্গার তীরে।শীতের বিকালের শেষ রোদ গঙ্গার ঢেউয়ের বিভঙ্গে লুকোচুরি খেলছে ।স্বামীজীর পাশেই বসে আছেন,তাঁর বিদেশীনী শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা।
নৈস্বর্গীক নিস্তব্ধতা ভেঙে, জলদগম্ভীর কন্ঠে স্বামীজী বলে উঠলেন – সিস্টার এই ভাবে বসে বসে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছেনা,কারণ সমগ্র পৃথিবীকে আমি ভারতীয় দর্শন বোঝালাম।কিন্তু আমি নিজে কি আজও ভারত মা কে জানা চেনার চেষ্টা করেছি?ভাবছি পায়ে হেঁটে আমি ভারত মা কে দর্শন করবো।তুমি কি পারবে আমার সঙ্গে যেতে?এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় নি সিস্টার নিবেদিতা,উত্তরে তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন,এ তো আমার পরম সৌভাগ্য স্বামীজী। এই দেশটাকে আমি আমার নিজের দেশ ভেবে সব ছেড়ে চলে এসেছি। এই দেশকে চেনা জানার সৌভাগ্য আমি অর্জন করতে চাই। যত কষ্টই হোক, আমি আপনার সঙ্গে যাব স্বামীজী।যেমন ভাবনা,তেমন কাজ,
দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে শুরু হলো পায়ে হেঁটে ভারত দর্শন।গন্তব্য ছিল উত্তরের কাশ্মীর উপত্যকা। টানা প্রায় ৬ মাস পথ চলে,অক্টোবরে স্বামীজী পৌঁছালেন কাশ্মীর। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর তখন প্রায় চলছেনা, একটু বিশ্রাম চাইছে। উপত্যকার একটা ফাঁকা মাঠের পাশে একটা পাথরের খন্ডের উপর বসে ক্ষণিক বিশ্রাম নিচ্ছেন স্বামীজী। সামনের মাঠে খেলা করছে কয়েকটি স্থানীয় শিশু কিশোর।
একটি বছর পাঁচেকের শিশুকন্যাও তাদের মধ্যে রয়েছে।ঐ কন্যাটির দিকে একদৃষ্টে দেখছেন স্বামীজী। কন্যাটির মা, তাঁর মেয়েকে ডেকে, একটি পাত্র করে কিছু খাবার দিয়ে গেলেন। মেয়েটিও খাবারটি সবে মুখে তুলতে যাবে।
এমন সময়ে, আরও দূর থেকে, আরও ছোট একটি ছেলে চিৎকার করে নিজেদের ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে মেয়েটির কাছে ছুটে এলো।
মেয়েটি নিজের মুখের খাবারটা রেখে দিলো আবার পাত্রের মধ্যে। খাবার সমেত পাত্রটি এগিয়ে দিলো ঐ ছেলেটির দিকে। স্বামীজীও উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেনচিৎকার করে বললেন – সিস্টার আমি পেয়ে গেছি।আমি মা দূর্গাকে পেয়ে গেছি। যে ভারত মা কে এতদিন খুঁজেছি তাকে আমি পেয়ে গেছি।যে মেয়েটা নিজের মুখের খাবার,হাসতে হাসতে ভাইয়ের মুখে তুলে দিতে পারে, যুগ যুগ ধরে সেই তো আমার মা দূর্গা।সেই তো আমার ভারত মাতা।
স্বামীজী সিস্টার কে তৎক্ষণাৎ উপদেশ দিয়েছিলেন,পূজার উপকরণ সাজিয়ে ফেলতে।স্বামীজী বললেন, আগামীকাল দূর্গাপূজার অষ্টমীতে এই মেয়েটিকেই আমি ক্ষির ভবানী মন্দিরে,দূর্গার আসনে বসিয়ে কুমারীপূজা করবো।আমি যাচ্ছি মেয়েটির বাবার সঙ্গে কথা বলতে।কিন্তুহঠাৎ স্বামীজীর রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন কিছু কুসংষ্কারাচ্ছন্ন কাশ্মীরী পন্ডিত।
বললেন,আপনি না জেনে বুঝেই ভুল করতে যাচ্ছেন।ঐ মেয়েটিকে আপনি কখনোই দূর্গা রূপে পূজা করতে পারেন না। কারণ ওর জন্ম মুসলমান ঘরে।ওর বাবা একজন মুসলমান শীকারা চালক।একথা শোনা মাত্রস্বামীজীর কান দুটো লাল হয়ে গেছে,চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠেছে,গম্ভীর গলায় স্বামীজী বললেন;_আপনারা আপনাদের মা দূর্গাকে হিন্দু আর মুসলমানের পোষাক দিয়ে চেনেন।আমি আমার মা দূর্গাকে অন্তরাত্মা দিয়ে চিনিঐ মেয়েটির শরীরে হিন্দুর পোষাক থাক বা মুসলমানের পোষাক,ওই আমার মা দূর্গা।
আগামীকাল ওকেই আমি দূর্গার আসনে বসিয়ে পূজা করবো।পরেরদিন সকালদূর্গাপূজার অষ্টমী ক্ষির ভবানী মন্দিরে ঘন্টা বাজছে,শাঁখ বাজছে।
মুসলমানের মেয়ে, বসে আছে দূর্গা সেজে,
পূজা করছেন,হিন্দুর সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ।
পূজার উপকরণ সাজিয়ে দিচ্ছেন,খ্রীষ্টান ঘরে জন্ম নেওয়া ভগিনী নিবেদিতা।এই হলো মহামানবের দূর্গা পূজা।এই হলো মানবিকতার দূর্গা পূজা।মা আমাদের সবার।জাত ধর্মে নির্বিশেষে সবার।মায়ের কোনো জাত ধর্মে নেই,থাকে না।
স্বামী বিবেকানন্দ সেই কর্ম যোগী মহান বীর, যাঁর চোখে সমাজে কোন ভেদাভেদ ছিল,না,সব দিক সমতল।ঠিক তেমনি নারীদের তিনি এই সমাজে স্থান দিয়েছেন দেবী রূপে।যুগের পর যুগ হিন্দু শাস্ত্র মতে মহা অষ্টমীর দিন নারী দেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।স্বামীজি নারীর উন্নতির কথা ভেবেছেন। বারবার তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন; নারীর আদর্শের কথাও শুনিয়েছেন, “হে ভারত, ভুলিয়ো না তোমার নারী জাতির আদর্শ।” সমকালে দাঁড়িয়ে ইওরোপীয় মহাপুরুষের এটা বলার প্রয়োজন ছিল না, তারা বলেনও নি। কিন্তু ভারতের প্রেক্ষাপট তখন আলাদা। নবজাগরণের পর্ব। এবং তার অন্যতম প্রয়োজন নারীমুক্তি। ভারতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তাই স্বামীজি এই কর্তব্যবোধ দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতাকে বালিকা বিদ্যালয় গঠনের উপদেশ দিয়েছেন। একেই বলে সামাজিকভাবে চালিত হওয়া। এই শিক্ষা স্বামীজির সবচাইতে বড় শিক্ষা।
*****************************
আমার এই কবিতাটি প্রকাশ করার জন্য মাননীয় সম্পাদক মহাশয়, এবং কাব্যপট পত্রিকার সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।
Very very nice.
Very nice
[…] শিশুর চাবি… বিশ্বনাথ সাহা […]
[…] আরও পড়ুন:-ভ্রমণ পিয়াসী : বিশ্বনাথ সাহা […]