(ছবি : Zee news থেকে সংগ্রহ)
শিশুশ্রম বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় চরম লজ্জার
বটু কৃষ্ণ হালদার
সাল ২০২২,স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত,দেশ আধুনিক সভ্যতার আঙিনায় পা রেখেছে।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহারে ভারত বর্ষ ডিজিটাল ইন্ডিয়া তে রূপান্তরিত হয়েছে।কিন্তু আদপে ভারত বর্ষ কি সত্যিই সভ্য হয়ে উঠেছে? কারণ যে আধুনিকতার রঙে আমরা সবাই রঙিন হয়ে উঠেছি সেই সভ্য সমাজের মুখোশের পেছনে রয়েছে আরও একটি অন্ধকারের বিভীষিকা ময় রূপ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সেটি হল আমাদের সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা গুলির মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ।সেই জ্বলন্ত সমস্যার নাম শিশু শ্রম।দেশ স্বাধীন তার প্রায় ৭৫ বছর অতিক্রান্ত, দেশের সরকার বারবার এই জীবন্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করলেও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকান ,ইটভাটা ,হোটেল চাষের ক্ষেত বিড়ি বাধা, বোতল কুড়ানো, গৃহভিত্তিক কর্ম,রাজমিস্ত্রি জোগাড়ে,এমনকি ভিক্ষা করতে ছোট ছোট শিশু দের ব্যাবহার করা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানোটা আজকাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাতে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক অনেক রথি মহারথীরা যুক্ত রয়েছেন। বিটিশা প্রায় ২০০ বছর যাবত আমাদের ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে তাদের সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছে সোনার চামচ, আর আমাদের দেশের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে।তবে স্বাধীনতার পরে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানা আইন তৈরি হলেও তার হয়ে গেছে খাতা কলমে। ব্রিটিশরা যেটুকু ভারতবর্ষে রেখেছিল তা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা লুটেপুটে খাচ্ছে। তাতে ভারত বর্ষ আরো গরীব দেশে পরিণত হচ্ছে।বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমের সংখ্যা।শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানান আইন তৈরি হলে তা খাতা কলমে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
মানব জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে শৈশবের অবস্থান।এই বয়সে তাদের হাসি খেলা এবং পড়াশোনা নিয়ে থাকার কথা সেই বয়সে তারা হয়ে উঠছে কর্মমুখী। অথচ এই শিশুদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ।কর্মমুখী হওয়ার ফলে বহু শিশুদের প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক মতো ভাবে পরিচর্যা করলে হয়তো দেখা যেত ওই সমস্ত শিশুগুলোর মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তান হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু
সমাজের বুকে জায়গা করে নিচ্ছে শিশু শ্রমিক হিসেবে। আর এইসব শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ। তারা তাদের কম পয়সা দিয়ে অথবা দুবেলার খাবার দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে।
২০১৯ এর করানো মহামাড়িতে দেশে লকডাউন চলতে থাকায় বন্ধ ছিল সমস্ত মানুষের রোজগার। উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ ছিল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।
যার ফলে অনেক ছোট ছোট পড়ুয়ায় পড়াশোনার ব্যাগ কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিশু শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয় বিশেষত ফুটপাতের দোকানগুলিতে। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে খুললেও আর বিদ্যালয় মুখী হয়নি সেই সব ছেলেমেয়েরা। তারা শিশু শ্রমিক হিসেবে থেকে গেছে সমাজের বুকে।শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করার জন্য আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন আইন, রয়েছে শিশু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিটি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকার এই শিশুশ্রমকে বন্ধ করার জন্য আইন করে ১৪ বছর বয়সের কম শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে।তাতে ও চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ,র তথ্য অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত লজ্জাজনক।সমগ্র ভারতে ৫১৮ বছরের প্রতি ১১ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমিক।১৫১৮ বছরের শিশুদের পাঁচ জনে একজন শ্রমিক।২০০১_২০১১ সালের মধ্যে শহরের শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে সেই পরিসংখ্যান আরো ভয়ংকর, প্রায় ৮০ শতাংশ।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ থেকে চোদ্দ বছরের শিশু শ্রমিক ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ।কিন্তু তবুও আইন লঙ্ঘন করে এই কাজ করে চলেছে অনেকে।যার ফলে নষ্ট হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ ভেঙে পড়ছে আমাদের জাতির মেরুদন্ড।
আমাদের সকলেরই জানা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।কিন্তু কোন কাজই কঠিন হবে না যদি আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই বিষয়ে সচেতন হওয়াটা খুবই জরুরী।কিন্তু আমরা যদি এখন থেকে শিশুশ্রম এর মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছোট ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে থাকি তবে ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদেরকে বড় মূল্য দিতে হবে। পঙ্গু হয়ে পড়বে আমাদের ভারত বর্ষ।কারণ শিশুরাই হল জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যদি ঠিকমতো সুরক্ষা দিতে না পারি তবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় অভিশাপ অপেক্ষা করছে।তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের উচিত এই জঘন্য ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করা। তবেই ভবিষ্যতে আমরা সোনার ভারতবর্ষ গড়তে পারব।এখন ই করো,শিশুশ্রমের সমাপ্তি এই সংকল্প নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর যারা শিশুদেরকে দিয়ে শ্রম করানোর চেষ্টা করছে তাদের বুঝতে হবে তাদের ঘরের সন্তান আর যারা শ্রম করছে তারাও এই ভারতবর্ষের সন্তান। আর বুঝতে হবে যতদিন শিশু শ্রমের মত সামাজিক ব্যাধি এই দেশ থেকে ধ্বংস না হচ্ছে ততদিন ভারতবর্ষ কখনোই সোনার ভারতবর্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।
দা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে আজ অর্থাৎ ১২ই জুন কে বেছে নিয়েছিল।সেই থেকে পালিত হয় আসছে আজকের এই দিন।এখনো সারা বিশ্বে প্রায় ১৫২মিলিয়ন শিশু শ্রম করে ।আন্তর্জাতিক স্তরে তাই ক্যাম্পেন করে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো টা যে অপরাধ তার প্রচার ও প্রসার হয়ে চলেছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার জন্য অসংখ্য বাবা মা তাঁদের শিশুদের কাজ করতে পাঠায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে।যা একেবারেই প্রযোজ্য নয় ।শিশুদের দ্বারা শ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ জেনে ও আজ ও চলছে এই শিশুদের নিয়ে কাজ করানোর প্রবণতা।আইনের ঊর্ধ্বে ফাঁক ,তাই এই ধরনের সমস্যা আজও দেখতে পাওয়া যায় সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নজর রাখলেই অনুমেয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো শিশুদের খাটনি চায়ের দোকানে,হোটেল রেস্টুরেন্টে, চলচ্চিত্রে প্রমুখ স্থানে শিশুদের পরিশ্রম করতে দেখতে পেলেও প্রতিবাদ করতে পারি না।এই প্রতিবাদ যেদিন কলরবে উচ্চারিত হবে সেদিন আমরা হয়ত আমাদের লজ্জা কে ঢাকতে পারবো।এই বিশ্বে মন ভালো করার সবথেকে সুন্দর জিনিস হল শিশুর হাসি।তাদের কে প্রাণ খুলে খেলতে,হাসতে দিন।ওরা ও এই ধরিত্রীর অমূল্য সম্পদ।ওদেরকে প্রাণ খুলে বাঁচার সুযোগ করে দিন।বিশ্বের সকল শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত ক্ষুদেদের প্রতি সমবেদনা জানাই,আর এর পরিবর্তনের উদিত সূর্য্যের অপেক্ষায় রইলাম।
সর্ব ধর্ম সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের উৎসব রেশ সর্বদা বজায় থাকে। এই উৎসবগুলো পালন করতে লক্ষাধিক টাকা এমনকি কোটি কোটি টাকা ও ব্যয় করা হয়। যে দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উৎসব পালন হয় সেই দেশে শিশু শ্রমিকের হার বেড়ে চলা, কিংবা ছোট ছোট শিশুরা দুই হাত পেতে ভিক্ষা করার চিত্র কি সামাজিক লজ্জা নয়? এ সমস্ত ঘটনাগুলো কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? মনে রাখবেন এই সামাজিক লজ্জা শুধু আমার আপনার নয় সমগ্র ভারতবাসীর? তবে যে যার মত করে উৎসব পালন করুন, সেই উৎসবে ওই অসহায় শিশুগুলোকে আলোর রোশনাই ও প্রাণোচ্ছল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন।
কলমে : বটু কৃষ্ণ হালদার