বাংলায় হিন্দি আগ্রাসন বাঙালি কিছুতেই মেনে নেবে না
বটু কৃষ্ণ হালদার
সমগ্র বিশ্ব বাসীর কাছে বাঙালি জাতি ও প্রিয় বাংলা ভাষা আবেগের পরিস্ফুটন।বিশ্বে একমাত্র বাঙালি জাতি ও ভাষাকে নিয়ে যুগের পর যুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।ইতিমধ্যেই বিশ্বের বহু দেশে বাঙালির বাংলা ভাষা,রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা লাভ করেছে।লন্ডনের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাড়ির নেমপ্লেট এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলা ভাষা নিজের আধিপত্য লাভে সচেষ্ট হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজেদের ভাষা ছেড়ে বাংলা ভাষায় গান গেয়ে সমৃদ্ধি লাভ করছে। বাঙালি হিসাবে এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গর্বের। বইপ্রেমী,আড্ডাবাজ,হুল্লোড় ভোজন রসিক বাঙালির অন্যতম পরিচয় হলো বাংলা ভাষায় কথা বলা।এই বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম “মা” শব্দটি উচ্চারণ করে।
বাংলা ভাষা_বাঙলা, বাঙ্গলা,আবার বাঙ্গালা নামেও পরিচিত, এটি একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের পঞ্চম ও মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা।বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছর পুরনো। চর্যাপদ এই ভাষার আদি নিদর্শন।
অষ্টম শতক থেকে বাংলা র রচিত সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের মধ্যে দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান ও আদি রূপ ধারণ করে। বাংলা ভাষার লিপি হল বাংলা লিপি।সর্বপ্রথম বাংলায় পদ রচনা করেছিলেন কাহ্নপা। বাংলা ভাষার প্রথম কবি এবং আদি কবি বলা হয় কাহ্নপাকে।এক কথায় কাহ্নপাকে বাংলা ভাষার জনক ও বলা যেতে পারে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সময়কালীন আরো কিছু প্রচলিত লিপির কথা জানা যায় ভাষা সম্পর্কিত। সাহিত্য জগতের অন্যতম তথ্য নির্ভর প্রাচীন গ্রন্থ “ললিতবিস্তর” বই থেকে জানা যায় গৌতম বুদ্ধের সময় বালক গৌতম তাঁর শিক্ষার শুরুতেই ৬৫টি প্রচলিত লিপির কথা জানতে পারেন।সেই লিপিগুলির মধ্যে অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কিরাত, ব্রাহ্মী ইত্যাদি লিপি ছিল, তবে নাগরী বা দেবনাগরী ছিল না। সে সময় হিন্দি বলে কোন কিছুই ছিল না।আজ যে লিপি প্রয়োগ করে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন চলছে তা’ কোথা থেকে, কখন থেকে এলো কেউ বলতে পারেন?
যে ভাষা,লিপির কাঁধে ভর করে হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়ার অধিকার চাপানো হচ্ছে সেই সংস্কৃত একটি ভাষা, তা’ লিপি হয় কিভাবে?আবার অতীতে বৈদিক ব্রাহ্মণরা যে লিপি ব্যবহার করতো সেটাই ব্রাহ্মী লিপি। এই লিপি আরামাইক বা খরোষ্টী লিপির মতই,মাত্রা নেই। ব্রাহ্মণরা যখন এই লিপি নিয়ে আসে তখন অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কিরাত এলাকায় প্রাকৃত ভাষার নিজস্ব লিপি ছিল, নানা পুস্তকও ছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণরা গুপ্ত যুগের পরে প্রতিপত্তি হারালে ব্রাহ্মী লিপির ব্যবহার কমে যায় ও প্রাকৃত লিপিগুলি গুরুত্বপূর্ণ হয়।বলতে পারেন হিন্দি ভাষার বয়স কত?বড় জোর মেরেকেটে দেড়শ বছর।অথচ ব্রিটিশ ভারতের কারেন্সি নো টে আটটা ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা স্থান ছিল,হিন্দি নয়।
যারা বাংলা ভাষায় কথা বলেন তাদের বাঙালী বলা হয়,হিন্দি কে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বকৃতি দিয়ে বাঙালিদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাইছে। ঝাড়খণ্ড,বিহার,সহ হিন্দি ভাষার বহু রাজ্যে
৬০% বাঙালী, অথচ বাংলা ভাষায় লিখতে পারে না, পড়তে পারে না,ওদের কে জোর করে হিন্দি শিখতে বাধ্য করা হয়, ওদের আগামী প্রজন্ম হিন্দি ভাষীতে পরিণত হবে,বাঙালি জাতি সত্তা মুছে দিতে চাইছে,এইভাবে রাজ্যে রাজ্যে বাঙালী জাতি চিরতরে হারিয়ে যেতে চলেছে। অথচ বাংলায় বহু হিন্দি ভাষার জনগন আছেন,তারা বহাল তবিয়তে তাদের ভাষায় কথা বলেন।এখানে জোর করে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয় না।বাংলায় ভাষা সংরক্ষণ না থাকার জন্য হিন্দি ভাষায় কথা বললেও রাজ্য সরকারের বহু দপ্তরের চাকরি ও করছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে আর তাতে বঞ্চিত হচ্ছেন বাংলা ভাষাভাষীর বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা।
কেন্দ্র সরকারের এক রাষ্ট্র,এক নির্বাচন সমর্থন যোগ্য।কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে স স জাতির স্বাধীনতা অবশ্যই থাকা উচিত। জোর করে কোন ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাতে প্রত্যেক জাতির আত্মমর্যাদা অবশ্যই ক্ষুন্ন হবে। তবে পশ্চিমবাংলায় হিন্দি ভাষার আগ্রাসন বাঙালি কোনমতেই মেনে নেবে না। কারণ অতীতে এই বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদা রক্ষা করার জন্য বাঙালির রক্তে বাংলার মাটি ভিজেছিল। বুকে বুলেটের গুলি খেয়ে তারা বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে রক্ষা করেছে। অবিভক্ত বাংলাদেশের মানুষ উর্দু ভাষার আগ্রাসন মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্বপ্রথম আওয়াজ তুলেছিলেন। তাঁকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়।১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সালাম ল,রফিক,বরকতদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এর পর ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরের বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষার আগ্রাসন মেনে নেয়নি বাঙালিরা।অসমীয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙ্গালীদের উপর। তার বিরুদ্ধে ভয়ংকর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়।তাদের উপর সরকার নির্বিচারে গুলি চালায়।১৯৬১ সালের ১৯ মে, ষোড়শী কমলা ভট্টাচার্য সহ ১১ জন প্রতিবাদীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করেন। এই সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সাক্ষ্য দেয়, বাঙালি তার প্রিয় বাংলা ভাষাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। বাঙালি ভাষার জন্য যেমন জীবন দিতে পারে, তেমনি বাংলা ভাষার জন্য আগামীতে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলতেও পারে সেটা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। তাই নিজের ভাষার প্রতি সন্মান জানাত হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে দিকে দিকে ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।
লেখকের মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত