Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব‍্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩০
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৭। কর্ণ–দুর্যোধন–শল্য সংবাদ ।।

শত্রু হস্তে পরাজিত বিধ্বস্ত কৌরব।
হত-বিষ সর্পসম হারায়ে গৌরব।।
করেন মন্ত্রণা বসি শিবিরে সকলে।
আজিকার দিন কেন যাইল বিফলে।।
কর্ণ কন দুর্যোধনে, “শোন মহারাজ,
কৃষ্ণার্জুন জয়লাভ করে কেন আজ।।
ধনঞ্জয় ধৈর্যশীল, রণে ক্ষীপ্র অতি।
তার সাথে কৃষ্ণ তার কৌশলী সারথি।।
সঠিক সময়ে তারা চলে ঠিক পথে।
উদীপ্ত অর্জুন তাই ভগ্ন মনোরথে।।
অতর্কিতে আজ অস্ত্র করিল প্রয়োগ।
কাল আমি প্রাণ তার করিব বিয়োগ”।।
পরদিন প্রাতে কর্ণ দুর্যোধনে কন,
“নিশ্চয় অর্জুনে আজ করিব হনন।।
নানা দিকে রত আমি ছিনু তব হিতে।
পার্থ সনে রণে তাই পারিনি মিলিতে।।
হয় আমি আজ তারে করিব হনন,
নতুবা আমিই স্বর্গে করিব গমন।।
শ্রেষ্ঠ বীরগণ সব হইলেন হত।
ইন্দ্রদত্ত শক্তি-অস্ত্র হলো অন্তর্হিত।।
তথাপি অস্ত্রবিদ‍্যায় শৌর্যে আর জ্ঞানে,
সব‍্যসাচী সমতুল নহে মোর সনে।।
আছে মোর পাশে এক বিজয় ধনুক।
গাণ্ডীব অপেক্ষা তাহা শ্রেষ্ঠ সে কার্মুক।।
ইন্দ্র তা পরশুরামে করিলেন দান।
পরশুরাম মোরে তা করেন প্রদান।।
এহেন কার্মুকে আমি বধিব অর্জুনে।
হইবে হত অর্জুন ইহা রেখ মনে।।
ধনঞ্জয় ভাগ‍্যবান কয়েক বিষয়ে।
সুবিধা তাহার তাহে যুদ্ধের সময়ে।।
আছে তার দিব‍্য জ‍্যা অক্ষয় তূণীর।
গোবিন্দ সারথি তার বুদ্ধি সুগভীর।।
মনসম দ্রুতগামী অগ্নিদত্ত রথ।
যেথা খুশি সেথা যায় নাহি লাগে পথ।।
রথধ্বজোপরি বসে আছে যে বানর,
অতীব ক্ষীপ্র তাহাও অতি ভয়ঙ্কর।।
হীন আমি দীন অতি এ সব বিষয়ে।
তথাপি করিব যুদ্ধ আজিকে নির্ভয়ে।।
শল‍্য দক্ষ কৃষ্ণসম জানে সর্বজন।
সারথি করিব তাঁরে এই মোর মন।।
বহুগাড়ি নানা অস্ত্র থাকে যেন সাথে।
অশ্বযুক্ত বহু রথ থাকিবে পশ্চাতে।।
শল‍্যসম অশ্বজ্ঞানী কেহ নাহি আর।
হইলে সারথি তিনি ইন্দ্র মানে হার”।।
“যাহা চাও কর্ণ তুমি হবে ঠিক তাই”।
কহিলেন দুর্যোধন, “কোন চিন্তা নাই”।।
তারপর শল‍্য পাশে করেন গমন।
মদ্ররাজ শল‍্যে তিনি সবিনয়ে কন।।
“নতমস্তকে আজিকে করিনু মিনতি,
করুন গ্রহণ পদ শল‍্যের সারথি।।
কেশব করেন রক্ষা অর্জুনে যেমতি,
আপনি করুন কর্ণে হইয়া সারথি।।
পাণ্ডবের ছলে ভীষ্ম হলেন নিধন।
দ্রোণাচার্যেও কৌশলে করিল হনন।।
হেনরূপে হত মোর যত বীরদল।
তন্মধ্যে জীবিত মাত্র কর্ণ মহাবল।।
আপনি ভরসা মোর অতি মহারথ।
আপনি ও কর্ণ ছাড়া নাই কোন পথ।।
কর্ণ ‘পরে আছে মোর অগাধ বিশ্বাস।
আপনি সারথি হলে রহিবে আশ্বাস”।।
গর্বিত কুল-ঐশ্বর্য আর শাস্ত্রজ্ঞানে,
হইলেন ক্রুদ্ধ শল‍্য দুর্যোধন বচনে।।
“হেন বচন কদাপি নাহি শুনি আর।
এহেন কর্মে নিয়োগে নাহি অধিকার।।
উচ্চকুল জাত আমি অতি মর্যাদার।
নীচের দাসত্ব কেন করিব স্বীকার।।
সূত-আজ্ঞা আমি নাহি করিব পালন।
সূতের সারথ‍্য নাহি করিব গ্রহণ।।
দুর্যোধন তুমি মোরে কর অপমান।
মোর চেয়ে কর্ণ শ্রেষ্ঠ করিয়াছ জ্ঞান।।
নহিতো সামান্য আমি রাজর্ষি সন্তান।
করিবনা যুদ্ধ আমি স’য়ে অপমান।।
অনুমতি দাও মোরে সদনে গমনে”।
এতেক কহিয়া শল‍্য উদ‍্যত গমনে।।
উচাটন দুর্যোধন ধরিয়া তখন,
সসম্মানে সবিনয়ে শল‍্যে তিনি কন,
“মদ্রেশ্বর, আপনার যথার্থ বচন।
কিন্তু মম অভিপ্রায় করুন শ্রবণ।।
অন্য কেহ নহে শ্রেষ্ঠ চেয়ে আপনার।
বিক্রমে মধুসূদন মানিবেন হার।
তথাপি সারথি পদে করিব বরণ।
কেশব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তাহার কারণ।।
কৃষ্ণ জ্ঞানী অশ্বজ্ঞানে সত্য সে বচন।
আপনি দ্বিগুণ জ্ঞানী জানে সর্বজন”।।
“হইলাম প্রীত আমি রাজা দুর্যোধন।
কর্ণের সারথ‍্য আমি করিনু গ্রহণ।।
কিন্তু আছে শর্ত মোর করহ শ্রবণ।
যাহা ইচ্ছা কর্ণে আমি কহিব বচন”।।
শল‍্য শর্তে হন রাজি কর্ণ দুর্যোধন।
কর্ণের সারথ‍্য শল‍্য করেন গ্রহণ।।
★★★

৮। ত্রিপুর সংহার ও পরশুরামের কথা ।।

দেবাসুর যুদ্ধ কথা করিব বর্ণন।
মদ্ররাজ শল‍্যে তাহা ভনে দুর্যোধন।।
দৈত‍্যগণ করে রণ দেবগণ সনে।
পরাজিত দৈত‍্যগণ ভঙ্গ দিল রণে।
তারকাসুর পুত্রেরা বন মাঝে যায়।
কঠোর তপস্যা ব্রতী ব্রহ্মা সাধনায়।।
তুষ্ট ব্রহ্মা আবির্ভূত দানিবারে বর।
ভ্রাতাত্রয় চাহে বর হইতে অমর।
এহেন কামনা ব্রহ্মা করিয়া শ্রবণ,
ভ্রাতাত্রয়ে তিনি ত্বরা কহেন তখন।।
“অমরত্ব অপ্রদেয় কর অবধান।
ভিন্ন বর চাহ আমি করিব প্রদান”।।
তারকের পুত্রত্রয় করি আলোচন,
ব্রহ্মায় সকলে তারা করে নিবেদন।।
“বেশ তবে তাই দিন ভিন্ন এক বর।
মোরা আর নাহি চাহি হইতে অমর।।
তিন নগরী মোদের করুন প্রদান।
সেথা যেন সুখে মোরা করি অবস্থান।।
অবিনাশী হয় যেন যত সব প্রাণী।
অস্ত্র শস্ত্র ব্রহ্ম শাপে নাহি হয় হানি।।
নারিবে নগরে কেহ করিতে হনন।
গতিশীল নগরেতে করি বিচরণ।।
সহস্র বছর পরে হেনরূপে ঘুরে,
মিলি যেন তিন ভাই নগর ত্রিপুরে।।
সেইকালে সে হইবে মৃত্যুর কারণ।
এক বাণে ত্রিপুরে যে করিবে ভেদন”।।
“বেশ তবে তাই হোক তব ইচ্ছা মত”।
হেন বর দিয়া ব্রহ্মা হলেন প্রস্থিত।।
ময়দানবে তখন দৈত‍্য-পুত্রগণ,
ত্রিপুর নির্মাণ ভার করিল অর্পণ।।
ময়দানব করিল ত্রিপুর গঠন।
দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে তারা সহস্র যোজন।।
একটি সে স্বর্ণময় অন‍্যটি রজত।
তৃতীয়টি কৃষ্ণ লৌহ আকারে বৃহৎ।।
স্বর্ণপুর স্বর্গলোকে রজত গগনে।
তৃতীয়টি লৌহপুর রহিল ভুবনে।
তারকের জ‍্যেষ্ঠ পুত্র তারকাক্ষ নাম।
লইল স্বর্গের সেই স্বর্ণপুর ধাম।।
কমলাক্ষ মধ‍্যম সে নিল রৌপ‍্যপুর।
কনিষ্ঠ বিদ‍্যুন্মালী সে কৃষ্ণ লৌহপুর।।

দেবগণ বিতাড়িত যত দৈত‍্যগণ,
তিন পুরে করে তারা আশ্রয় গ্রহণ।।
তারকাক্ষ পুত্র এক হরি নাম ধরে।
তৈরি করে সরোবর ব্রহ্মা-দত্ত বরে।।
এইরূপ সরোবর গড়ে প্রতি পুরে।
মৃতগণ পায় প্রাণ তাহাদের নীরে।।
ছিল মৃত দৈত্য যত সুরাসুর রণে,
লভিল জীবন তারা তার বারি গুণে।।

দম্ভ ভরি তিন দৈত্য করি বিচরণ,
ত্রিলোকের ‘পরে চলে করিয়া পীড়ন।।
ত্রিপুর ‘পরে করেন ইন্দ্র বজ্রপাত।
ব‍্যর্থ বজ্র সেথা নাহি করিল আঘাত।।
বিচলিত হইলেন সব দেবগণ।
লইলেন সবে তাঁরা ব্রহ্মার শরণ।।
সকলেরে ব্রহ্মা কন, “করহ শ্রবণ,
একবাণে যায় করা ত্রিপুর ভেদন।।
ঈশান ভিন্ন এখন কেহ নাই আর।
গমন করহ সবে সকাশে তাঁহার”।।
ব্রহ্মা উপদেশ শুনি যত দেবগণ,
ঈশান সকাশে তাঁরা করেন গমন।।
বিপন্ন দেবতাগণে শূলপাণি কন,
“ব্রহ্মার বরে প্রবল সব দৈত‍্যগণ।।
তাই নহেক সম্ভব একাকী নিধন।
অর্ধতেজ সবে মোর করহ গ্রহণ।।
অতঃপর জানিবে নাই কোন ভয়।
সম্মিলিত এই তেজে হবে দৈত্য জয়।।
“আপনার অর্ধতেজ অক্ষম ধারণে।
শূলপাণি মহাদেবে কন দেবগণে।।
“আমাদের অর্ধতেজ করুন গ্রহণ।
তারপর শত্রুগণে করুন নিধন”।।
সম্মত শূলপাণি সে প্রস্তাবে তখন।
অর্ধতেজ দেন তাঁরে সব দেবগণ।।
হইলেন মহাবলী তিনি স্বর্গধামে।
সেই থেকে খ‍্যাত তিনি মহাদেব নামে।।
দেবাদেশে বিশ্বকর্মা করেন নির্মাণ।
মহাদেবের বৃহৎ সেই যুদ্ধযান।।
নক্ষত্র নদী পর্বত গ্রহ বিভূষিত,
শক্তিশালী যুদ্ধযান হইল নির্মিত।।
চন্দ্র সূর্য হন তাঁরা সেই রথ চাকা।
তড়িৎ ভূষিত মেঘ তাহার পতাকা।।
ইন্দ্র বরুণ কুবের যম চারিজন।
হলেন রথাশ্ব তাঁরা গতি যেন মন।।
বিষ্ণু অগ্নি ঘনশম্পা মহাদেব-বাণ।
সারথি রথের কেবা নাহি খুঁজে পান।।
কহিলেন মহাদেব, “করহ শ্রবণ,
মোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দেবে কর অন্বেষণ।।
মোর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হইবেন যিনি।
মোর রথের সারথি হইবেন তিনি”।।
দেবগণ গমিলেন ব্রহ্মার শরণে।
সর্বশ্রেষ্ঠ দেব তিনি তাহার কারণে।।
দেবগণ কহিলেন প্রণমি তাঁহায়,
“আপনি আছেন মাত্র বিপদে সহায়।।
শঙ্কর-সারথ‍্য পদ করুন গ্রহণ।
অতঃপর রথ তাঁর করুন চালন”।।
প্রজাপতি মহামতি দিলেন সম্মতি।
অধিষ্ঠিত মহারথে হইয়া সারথি।।
ধায়িল রথ-দামিনী ত্রিপুরের পথে।
জাগরিত মহাদেব মহাবাণ হাতে।
ধ্বজাগ্রে স্থিত বৃষভ করিল গর্জন।
প্রাণীকুল হুলস্থূল কম্পিত ভুবন।।
হইল পরিলক্ষিত নানা ভয় ত্রাস।
রথ ভারে রথ চাকা করে ভূমি গ্রাস।।
উত্তোলিত রথ চক্র স্কন্ধে নারায়ণ।
বাণ হ’তে বৃষ রূপ করিয়া ধারণ।।
তারপরে অশ্ব পৃষ্ঠে রাখিয়া চরণ,
দৈত‍্যপুর দরশন করে নারায়ণ।।
মহাদেব ধনুর্বাণ করেন যোজন।
মহাবাণ যোগে তাঁর স্থিরিভূত মন।।
একত্র মিলিত হয় ত্রিপুর যখন,
মহাদেব মহাবাণ করেন মোচন।।
দৈত‍্যকুল বিলকুল গণিল প্রমাদ।
তিন পুরে তারস্বরে ওঠে আর্তনাদ।।
পতিত ভগ্ন ত্রিপুর পশ্চিম সাগরে।
দানবকুল নির্মূল এক মহাশরে।।
তিন পুর সংহার হলো সমাপন।
মদ্ররাজে কহে দিলা রাজা দুর্যোধন।।
রুদ্রের সারথ‍্য ব্রহ্মা করেন যেমতি।
কর্ণের সারথি হন আপনি সেমতি।।
যোদ্ধা কর্ণ রুদ্র তুল‍্য আপ ব্রহ্মা সম।
আপনার অধীনেই জয় লাভ মম।

আরও এক কাহিনী করিব বর্ণন।
মনোযোগ দিয়া তাহে করুন শ্রবণ।।
ভৃগুবংশে জাত মুনি জমদগ্নি নাম।
তাঁর পুত্র গুণবান তিনি পরশুরাম।।
তাঁর তপে তুষ্ট হন মহাদেব তিনি।
“তব যাচ্ঞা জ্ঞাত মম”, কন শূলপাণি।।
“অপাত্রে অস্ত্র আমার করিবে নিষ্প্রাণ।
হইলে পবিত্র তুমি অস্ত্র করি দান”।।
অতঃপর বহুকাল শঙ্কর-সাধনা।
নিয়ম পালন স্তোত্র পূজা হোম নানা।
তুষ্ট মহাদেব তাহে পরশুরে কন,
“একটি কর্ম এখন করহ পালন।।
সাধিতে জগত হিত মম প্রীতি তরে,
নাশিবে দেবের শত্রু তুমি অকাতরে”।।
উদ্বিগ্ন পরশুরাম মহাদেবে কন,
“কিরূপে সাধিব এই অসাধ‍্য সাধন।।
কোন শক্তি হে দেবেশ নাহিক আমার।
কিরূপে পালিব এই কর্ম গুরুভার”।।
মহাদেব পরশুরামে কহেন তখন,
“মম আজ্ঞা তুমি রণে করহ গমন।।
নাহিক তোমার কিছু ভয়ের কারণ।
অসাধ‍্য যাহা সহজে হইবে সাধন”।।

মহাদেবাদেশে তিনি গমিলেন রণে।
বজ্রতুল‍্য অস্ত্রে তিনি অসুর নিধনে।।
লভিলেন জয় তিনি সহজেই রণে।
স্মরিলেন মহাদেবে আনন্দিত মনে।।
মহাদেব কহিলেন, “শোন ভৃগুনন্দন,
তুষ্ট আমি অস্ত্র মোর করহ গ্রহণ”।।
দিব‍্যাস্ত্রে পরশুরাম করেন প্রস্থান।
সেই অস্ত্র পরে কর্ণে করিলেন দান।।
কোন কর্মে কর্ণ যদি হইতেন পাপী,
সেই অস্ত্র কর্ণে নাহি দিতেন কদাপি।।
সূতকুলে জন্ম নয় বোধ মোর মনে।
ক্ষত্রিয় তবু বঞ্চিত অসত্য কারণে।।
জননী কিরূপে সেই সূতনারী হন।
কবচ-কুণ্ডলধারী হন যেইজন।।
মদ্ররাজ শল‍্য, কভু এও কি সম্ভব ?
মৃগী কি কভুও করে শার্দুল প্রসব ?

( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *