অপমানিতের বেদনা ****
এম ডি আবুহোসেন সেখ
সন্ধ্যার দিকে ‘বুলবুল’ ঝড় ঞমশ প্রবল হইতে লাগিল। বৃষ্টির ঝাপট বজ্রপাতের শব্দ এবং বিদ্যুতের ঝিকিমিকিতে আকাশে যেন সুরাসুরের যুদ্ধ বাধিয়া গেল।কালো কালো মেঘগুলো মহাপ্রলয়ের জয়পতাকার মতো দিগ্-বিদিকে উড়িতে আরম্ভ করিল, খালের এপার ওপারে বিদ্রোহী ঢেউ গুলো কলকল শব্দে নৃত্য জুড়িয়া দিল। এবং বাগানের বড়ো বড়ো গাছগুলো সমস্ত শাখা প্রশাখা ঝটপট করিয়া হা-হুতাশ সহকারে দক্ষিণে পূর্বে পশ্চিমে লুটোপুটি করিতে লাগিল।
কিছু দিনের মধ্যে ‘বুলবুল’ ঝড় থামিয়া গেল পরিবেশ শান্ত স্নিগ্ধ হইয়া যায়। সূর্যের কিরণে চারিদিক ঝলমল করিয়া ওঠে
————-এর পর গল্প বাঁক অন্য দিকে। গল্পের মঞ্চে প্রবেশ করেন এক মমতাময়ী মা, ওই মমতাময়ী মায়ের পরনে ছিল লালচে রঙের এক শাড়ি, মাথা ভরতি চুল, রোগা-পাতলা চেহারা, দেখিলে মনে হয় এিশ-চল্লিশ বছর বয়স। দেখা যায় ওই মমতাময়ী মা গ্রামের একজন লোকের কাছে বলছে – – বাবা, বাবা, আমাকে দুটো খেতে দাও না, আমি অনেক দিন না খেয়ে আছি।
তখন লোকটি জিজ্ঞেস করেন
—ও মেয়ে তোমার বাড়ি কোন খানে, তোমার ছেলে মেয়ে কেউ নাই?
মেয়েটি একটু চুপ করে থেকে তারপর বলল
—বাবা সব বলিব আগে আমাকে দুটো খাইতে দাও খুদায় পেটটা যে জ্বালা করে।
তার পর ওই মমতাময়ী মাকে ভাত খাইতে দেওয়া হইল, খাবার সময় তার দু-নয়নের জল টোপাকেটে, টোপাকেটে খাবারের উপর পরিতেছে। ওই দৃশ্য দেখিয়া মনে হচ্ছিল যেন শতশত বছরের যন্ত্রণা উঁকি মারিতেছে। তাঁর দু-নয়নের জল কিছু বুঝাইতে চাইতেছে।এর’ই মধ্যে চারিদিকে ভিড় জমিয়া গিয়াছে। তারপর খাওয়া শেষ হইবা মাত্রে ওই লোকটি আবারও জিঞ্জাসা করিলো
—ও মেয়ে তোমার কেউ নাই?
মেয়েটি একটু গম্ভীর ভাবে কিছু সময় চুপ থাকার পর কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিল
—বাবা আমার বাড়ি হল ওই যে ওই চৌরাস্তার হেকাতির মোড়ে, আর আমার কোনো মেয়ে নাই, শুধুমাত্র আছে একটা ছেলে।
গ্রামের রাজু নামের ওই লোকটি আবারও জিঞ্জাসা করিলো
—–তা ছেলে কি করে?
মেয়েটি অর্থাৎ ওই মমতাময়ী মা অতি কষ্টের সাথে বলছেন
—-আমার ছেলে. – – আমার ছেলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।
ভিড় জমিয়ে থাকা ভিড়ের মাঝ হইতে আবারও একটি মেয়ে জিঞ্জাসা করিল
—-তা তোমার ছেলে তোমাকে দ্যাখে নাই?
মেয়েটি কতটা যন্ত্রণা নিয়ে বলছেন
—হ্যা মা আমাকে দ্যাখে আর দ্যাখে বলেই তো আমি আজ অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। আমার ছেলের দুটি সন্তান আছে যাদের আমি খোকা আর খুকি বলে ডাকতাম। আমি যখন বলিতাম, খুকি, এক গ্লাস জল নিয়ে এসোতো খাব, তখন মা বৌমা বলিয়া দিত, মরগে যাও বুড়ি। আমি যখন বলিতাম খোকা, আমার কাছে এসোনা একটু গল্প করি তখন খোকার বাবা খোকাকে বলিয়া দিতো, বুড়ি চুপ করে বসে থাকো নইলে ঘর থেকে বাহির করিয়া দিবো।
এইতো সেদিন ‘বুলবুল’ ঝড়ের দুদিন পরে ছেলে,বউ, নাতি নাতনি সবাই মিলিয়া রাতে মাংস রান্না করিল লুচি ভাজলো এবং রাতে চারজনে মিলিয়া আনন্দ উৎসব করিয়া পেটপুরিয়া খাইলো আমাকে একটুও দিল না। জানো বাবা’রা জানো মা’রা সকালবেলায় খোকাকে ডাকিয়া বলিলাম
–খোকা, কাল রাতে তোমরা তো কত কিছু খাইলে,কই আমাকে একটু ও দিলেনাতো,
ওমনি খোকা গিয়া মায়ের কাছে বলিয়া দিল। আর তখনই দেখি যে মা, খোকার মা আর বাবা দুজনে মিলিয়া ঝগড়া জুড়িয়া দিল তার পর কিছুক্ষণ পরে দুজনে মিলিয়া আমাকে গালি-গালাজ দিয়া মিথ্যা চোরের অপবাদ দিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল।
সেই দিন হইতে আমি হইয়া গেলাম ফুটপাতবাসী তাই আমি আজও অন্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি দুমুঠো খাবারের আশায়।
ভিড় জমিয়া থাকা ভিড়ের মাঝে ওই টিনা নামের মেয়েটি আবারও বলল
—তা তুমি এই ভাবে না ঘুরিয়া কলকাতার মুনিব বাবুর বাড়িতে কাজ করিলে পারিতে। তাহলে তোমার মাঝে জমে থাকা দুঃখ কষ্ট গুলো একটু হইলেও কমিয়া যাইতো।
মেয়েটিকে বলিলেন
—মা আমার জন্ম হইয়াছে গ্রামে আর ছোট্ট বেলা থেকেই গ্রামেই বড়ো হইয়াছি। শহর কি জানি না, শহর কেমন হয় তা বলিতে পারবো না। আর না ছিল কোলকাতার মুনিব বাবুর সাথে যোগাযোগ। হয়তো কারো কাছে বলিলে নিয়া যাইতো কিন্তু তা বলিনে শুধুমাত্র নাতি নাতনিদের জন্য। আমি নাতি নাতনিদের মুখ না দেখিলে থাকিতে পারিনে মাগো, সেইদিন সারাদিন বাইরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বিকাল পাঁচটার সময় গিয়াছি নাতি নাতনিদের দেখিতে, বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়াইয়া যেই ডাকিলাম খোকা, খুকি তোরা সব কোথায়? আয় না বাবা আমার কাছে, অনেক দিন হলো তোমাদের মুখ দেখিনে। তখুনি ঘরের ভিতর থেকে খুকির মা বলছে ও খোকা, দ্যাখতো কোথাকার ভিক্ষারিনী আসিয়াছে। শুনিয়া মাত্র মাগো কি বলিবো বুকটা যন্ত্রণায় ছটপট করিতে লাগিল।
এমনি করিয়া দু-তিন দিবস গিয়াছি মুখ দেখিতে পারি নাই। প্রথমবারের মতো প্রতিবার আমাকে অপমানিতের সাথে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে।
ওই মমতাময়ী মাকে ছেলে বউ মিলিয়া এতো লাঞ্ছিত, অপমানিত,দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা দিলেন তার পরেও করিছে ছেলে বউয়ের জন্য আশীর্বাদ। মা-জাতি অর্থাৎ নারী-জাতি বুঝি এমনিই হয়। তারপর দেখিতেছি ওই সর্বহারা বেদনাতুর মমতাময়ী মা ভিড় জমিয়ে থাকা সকল লোককে বলিতেছে দিয়োনাকো কাহারো আমার মতো এতো যন্ত্রণা। এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়াছো যাহাদের কোলে যতটুকু পারো করিয়া যাও তাহাদের সেবা। এটাই হবে মৃত্যুর পরে স্বর্গে যাবার রাস্তা যে। থাকতে রাস্তা দিয়োগো গো পাড়ি, সঙ্গে নিয়ে যেও স্বর্গের চাবি।
এই বলিয়া ভিড়ের মধ্যে থেকে বাহির হইয়া যাইবার সময় বারবার বলিতে বলিতে যাইতেছে ৮নং তিতকুমার গ্রামে যদি একটা বৃদ্ধাশ্রম থাকিতো তাহলে এই বয়সে ওই খানেতে গিয়া সকলের মাঝে সুখ-দুঃখের কথা কইয়া শান্তিতে দিন যাপন করিতে পারিতাম।
।জয়হিন্দ।