Spread the love

ছোটদি
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

রঞ্জিৎদার বছরক্রিয়ার নেমন্তন্ন খেয়ে এসে গৌতমবাবু ও স্ত্রী দেবস্মিতা একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন দুপুরে। তিন মেয়েই স্কুল-কলেজে। নিজের প্রেস উদিতা আর্টে সকাল থেকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর দুপুরে ঘন্টা দুই নিদ্রা। তারপর উঠে আবার একটানা রাত এগারটা পর্যন্ত কাজ। এই হোল গৌতম বাবুর ডেলি রুটিন। কিন্তু আজ ওঁর চোখে ঘুম নেই। চুপচাপ শুয়ে আছেন, আর ষাট বছর আগের ছোটদি ও আজকের বাৎসরিক শ্রাদ্ধে দেখা ছোটদি, মানে স্মৃতিদির কথা ভাবছেন। চাকদহ পি. সি. এম স্কুলের কাছেই ছিল পাশাপাশি ওঁদের বাড়ী। কোটিপতি ছিলেন ছোটদিরা; আর ওঁরা ছিলেন সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। তবু দুই পরিবারে ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশেষ করে, ছোটদির দাদা রঞ্জিৎদা, ছোটদি আর ওঁর পরের ভাই অম্মানের জন্য গৌতম বাবুর ও বাড়ীতে ছিল অবাধ অধিকার।

atOptions = { ‘key’ : ‘5308681ab1055595089c13c20bfa78fa’, ‘format’ : ‘iframe’, ‘height’ : 250, ‘width’ : 300, ‘params’ : {} }; document.write(”);


অম্লান আর উনি একই ক্লাশে স্কুলে পড়তেন, একই সঙ্গে খেলতেন, ছোটদিদের বাড়ীতে অধিকাংশ সময় কাটাতেন, খেতেন, ইত্যাদি। অল্প বয়সে পিতৃহারা ছোটদি গৌতমকে সহোদর হিসাবেই দেখতেন। ওঁর আরও দুই দিদি ছিল, আরতি ও ভারতী। তাঁরাও ওঁকে স্নেহ করতেন। কিন্তু ছোটদির স্নেহ ছিল তুলনাহীন। ওঁদের বাড়ীর কেয়ার টেকার বিকাশ নন্দী চোখ টাটাতেন। কিন্তু ছোটদির স্নেহের বন্যায় তাঁর কোন খবরদারি গৌতম সেনের উপর চলতো না। গৌতম বাবুর মনে পড়ছে যে ছোটদিদের বাড়ীর কোন এক বা একাধিক গোপন রহস্য বিকাশ বাবু জানতেন। সেই সুবাদে তিনি ছোটদিদের বাড়ীর উপর দাদাগিরি করতেন। প্রতিবেশীরা ভিলেনী চরিত্রের জন্য তার নাম দিয়েছিলেন বিল কিসমিয়া। আর ছোটদি? একে বড় লোকের মেয়ে। তার উপর অসামান্য রূপবতী, গুণবতী, মেধাবী। অথচ সাজপোশাকে কোন বাহুল্যতা ছিল না। অতি সাধারণ, আটপোরে পোষাক পরতেন সেই সপ্তদশী-অষ্টাদশী বয়সে। ওঁদের তাঁতঘরের শ্রমিকরা ওঁকে বলতেন প্রিয়দর্শিনী অর্থাৎ মা দুর্গা। কেউ ডাকতেন মা অন্নপূর্ণা বলে। শাড়ী-গহনা-গাড়ী, কোন কিছুরই দাবী ছিল না ছোটদির দাদা-বৌদি বা অকাল বিধবা মায়ের কাছে। শুধু দাবী ছিল, কোন দুঃস্থ মানুষ যেন তার কাছে বা তাদের কাছে সাহায্য চেয়ে বিমুখ না হয়। বাড়ীর নায়েব বিলকিস মিঞা কি বলবে তার পরোয়া করতো না ছোটদি।
১৯৮১ সালে বিয়ের দিনে গৌতম বাবু শেষ দেখেছিলেন ছোটদিকে। অম্লান ও উনি তখন ক্লাশ টেনে পড়তেন। সে কি জাকজমকপূর্ণ বিয়ে। বরপক্ষ সোনায় মুড়িয়ে দিয়েছিল ছোটদিকে। পাত্র ডাক্তার। ছোটদি সদ্য এম. এ পাশ। অম্লান ওঁকে খুব পীড়াপীড়ি করেছিল আগরতলায় ছোটদির বৌভাতে যেতে। কিন্তু কিশোর গৌতম যাননি। ওঁর স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছোটদি দীপুদা, দীপেন সেন নামে এক তরুণ National Scholar, কমিউনিস্ট অধ্যাপকের কাছে তাঁর বাড়ীতে প্রাইভেট পড়তেন। দুজন দুজনকে গভীর ভাবে ভালোবেসে ঘর বাঁধার অঙ্গীকার করেন। বিলকিস বারে বারে দীপুদাকে অপমান করেছে, কিন্তু সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেননি। বিদেশ যাবার সুযোগ পেয়েও দীপুদা ছোটদির পড়ার ক্ষতি হবে ভেবে বিদেশে যাননি। ছোটদির বাবার বছর ক্রিয়ায় ছোটদি পরম মমতাভরে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দীপুদাকে খাইয়ে ছিলেন এবং সবচাইতে আশ্চর্য্যের কথা, এঁটো পাতা ফেলার আলাদা লোক থাকলেও ছোটদি ঐ স্যারের এঁটো পাতা গ্লাস সহ ঐ বেঞ্চের সব এঁটো পাতা গ্লাস পরিষ্কার করেছিলেন।
ছোটদিকে সেদিন ওঁর মনে হয়েছিল রক্ত মাংসে গড়া এক দেবী। আর দীপুদার মেধা, গরীব মানুষদের লড়াই আন্দোলনে তাঁর ও তাঁর পরিবারের ত্যাগ, ইত্যাদি শুনে সেই তরুণ বয়সেই তাঁর মনে হোত ছোটদি-দীপুদা অমরাবতীর জুটি। গরীবদের জন্য এঁরা ঈশ্বরের অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু যেদিন-ঐরকম জাঁকজমকপূর্ণভাবে এক ডাক্তারকে বিয়ে করে ছোটদি ত্রিপুরা চলে গেলেন দীপুদাকে অস্বীকার করে, সেইদিন থেকে ওঁর প্রতি সবশ্রদ্ধা গৌতমবাবুর চলে গেছে। আবাল্য বন্ধু, সেই কারণে শালীনতার খাতিরে অম্লানকে উনি কিছুই বলেননি। কিন্তু বিগত চল্লিশ বছরে একদিনের জন্যও ছোটদির মুখদর্শন করেননি, বা ছোটদির কথাও তোলেননি। কালক্রমে তিনি জেনেছিলেন যে যত মেধাই দীপুদার থাক না কেন, তাঁদের কোন আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। গ্রামে বাড়ী, মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি, বাবা একজন প্রাথমিক শিক্ষক, যদিও স্বাধীনতা সংগ্রামী তিনি। এইসব কারণে, আত্মীয়স্বজনের কথায় ছোটদি ঘুরে যান। একজন বাম মনস্ক সাহিত্য সেবী হিসাবে গৌতম বাবু মনে মনে খুব বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এককালে তাঁর পরম শ্রদ্ধেয়া ছোটদি সম্পর্কে। ভাবতেন, শেষপর্যন্ত ভোগবাদী মূল্যবোধের কাছে ছোটদি হারিয়ে গেলেন!
কিন্তু, আজ প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে রঞ্জিৎদার বার্ষিক শ্রাদ্ধে অবসর প্রাপ্তা অধ্যাপিকা ছোটদিকে দেখে গৌতম বাবু বিস্মিত হয়ে যান। সবার পরণে দামী পোষাক, মূল্যবান গহনা, ব্যতিক্রম ছোটদি। সেই আটপৌরে পোষাক, সেই মমতাময়ী দৃষ্টি, সেই মেশোমশাই-এর বছর ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মত আজ দাদার বছর ক্রিয়া অনুষ্ঠানেও নিজ হাতে অতিথিদের এঁটো পাতা পরিষ্কার করা, এ সব করছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে গৌতম বাবু কত কি ভাবেন। একবার মনে হয়, ছোটদি ঠিক পথে চলতে চলতে রাহুগ্রামে পড়েছিলেন। তাই সেই কুক্ষণে সব ন্যায় নীতিবোধকে ভুলে ভোগবাদী আবেগে ভেসে দীপুদাকে ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু এ গ্রাস তো ক্ষণিক।
তাই, এত বছর বাদেও কৈশোরের তাঁর সেই সহজ সরল স্বভাব একটুও মরেনি। আবার কখনো ভাবছেন, চন্দ্র সূর্য্যের মিলন কখনোই হয় না। দিনে রাতে পৃথিবীকে আলো দেওয়াই, আলো দিয়ে সৃষ্টি রক্ষা করাই তাদের কাজ। কিন্তু, মিলন তাদের হয় না। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা তাদের সইতেই হয়। হিসাব নেয় না কেউ সে সবের। দীপুদা-ছোটদির জীবনটাই ঠিক তাই। দীপুদা আজ কোথায় এখন গৌতম বাবু তা জানেন নাঃ নিশ্চয়ই সাধারণের মাঝে অসাধারণ হয়ে কোথাও তিনি কাজ করছেন। ছোটদি মিনার বাসিনী হয়েও কুটীর বাসিনীর মত মানুষের সেবা করছেন। অথচ দূরত্বের শেলে তাঁরা ক্ষতবিক্ষত। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তটিনীর তট দেশে বয়ে যাওয়া ঝড় বয়ে যায় সবার অলক্ষ্যে। ভাবতে ভাবতে সুরের সাগরে ডুবে যান গৌতম বাবু। পাশের একটি ক্লাব থেকে মাইকে ভেসে আসছে–
বাঁশ বাগানের মাথার উপর
চাঁদ উঠেছে ওই;
মাগো আমার শ্লোক বলা কাজলা দিদি কই? . . .

atOptions = { ‘key’ : ‘5308681ab1055595089c13c20bfa78fa’, ‘format’ : ‘iframe’, ‘height’ : 250, ‘width’ : 300, ‘params’ : {} }; document.write(”);


গানটি শুনতে শুনতে ভেসে ওঠে ওঁর মনের ক্যানভাসে পঞ্চাশ বছর আগের চতুর্দশী ছোটদির স্নেহভরা মুখ; এবং তার পাশাপাশি আজকের মধ্যষাটের ছোটদির মুখখানিও।
লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট- টাকী
পিন- ৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ফোন- ৯৪৩৪৩৮৫৪৮৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *