ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য:
- কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *
—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–১৬
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
৭৷ যুধিষ্ঠির সকাশে ব্যাস।
★মৃত্যুর উপাখ্যান★
পাণ্ডবে ছাড়িয়া অভি গেল ইন্দ্রলোকে।
যুধিষ্ঠির বিলাপেন অভিমন্যু শোকে।।
“গো-বলয়ে প্রবেশে কেশরী যেমতি।
চক্রব্যূহে অভিমন্যু প্রবেশে সেমতি।।
মহারথ রথীগণ হলো পরাভূত।
তারে বধিল অন্যায়ে দুঃশাসন-সুত।।
হায় হৃষিকেশ কহ তুমি অন্তর্যামী,
ভ্রাতা ধনঞ্জয়ে আজ কিবা কব আমি।।
আজি যুদ্ধে নিজ কাজ করিতে পালন,
সুভদ্রা-অর্জুন সুতে করিনু নিধন।।
বালকের স্থান অগ্রে ভোজনে গমনে।
আর অগ্রে স্থান তার ভূষণে শয়নে।।
সেই সে বালকে করিনু যুদ্ধে অগ্রগামী।
হারায়ে তারে এ রাজ্য নাহি চাই আমি”।।
*
হেনকালে ব্যাসদেব আইলেন তথা।
ভ্রাতুষ্পুত্র শোকে কাঁদে যুধিষ্ঠির যেথা।।
আসি তথা কহিলেন তিনি যুধিষ্ঠিরে।
শান্ত কোমল স্বরে অতি ধীরে ধীরে।।
“কান্দ কেন যুধিষ্ঠির তুমি জ্ঞানবান।
শোক তুমি কর ত্যাগ তুমি যে ধীমান।।
নরশ্রেষ্ঠ অভিমন্যু করিয়াছে যাহা,
কোন বালক কভুও পারিবে না তাহা।।
বহু শত্রুসেনা একা করিল হনন।
তারপর ইন্দ্রলোকে করিল গমন।।
দেব দানব গন্ধর্ব মৃত্যুর অধীন।
লঙ্ঘিতে নারিবে তাহা কেহ কোনদিন”।।
ব্যাসদেবে যুধিষ্ঠির কহেন তখন,
“জীবমৃত্যু হেতু মোরে করহ বর্ণন”।।
ব্যাসদেব কহিলেন, “শোন এই ক্ষণে,
নারদ যা কহিলেন রাজা অকম্পনে।।
সত্যযুগে ছিল রাজা অকম্পন নাম।
ছিল তার পুত্র এক হরি তার নাম।।
হরি ছিল অস্ত্রবিদ্ অতি বলবান।
ছিল তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি অতি জ্ঞানবান।।
এক দিন যুদ্ধে হরি হয়ে গেল হত।
পুত্রশোকে রাজা সদা অতি শোকগ্রস্ত।।
দেবর্ষি নারদ এলেন দিতে সান্ত্বনা।
শোকনাশক আখ্যান করিতে বর্ণনা।।
*
প্রাণসৃষ্টি পরে ব্রহ্মা ভাবিলেন মনে।
উপায় তো চাই এক জীবন নিধনে।।
ক্রোধানল সৃষ্টি তিনি করেন গগনে।
দগ্ধ বুঝি হয় জীব অসহ্য তাপনে।।
অতিষ্ঠ জীবজীবন অনল কারণে।
করিবারে হিত শিব ব্রহ্মার শরণে।।
হেরিয়া তাঁহাকে ব্রহ্মা হইলেন প্রীত।
কিবা চাহ কহ মোরে করিবারে হিত।।
“বিপন্ন জীবজগৎ,” শঙ্কর বিনীত।
“আপনার কাছে আমি চাহি জীব হিত।।
আপনার মানসেই জীবকুল জাত।
আপনার তেজে দগ্ধ কেন আজ পিত।।
প্রসন্নতা আপনার করিনু কামনা।
শান্তি লভি থাক জীব করিনু প্রার্থনা”।।
ব্রহ্মা কন, “অকারণ ক্রোধ মোর নাই।
জীব ভারে ধরা ভার ক্রোধ মোর তাই।।
একদিন ধরা একা শরণে আমার।
নাশিবারে জীবপ্রাণ মিনতি তাহার।।
জন্মিল ক্রোধ আমার না হেরি উপায়।
তব অনুরোধে দেখি কিবা করা যায়”।।
মহাদেব প্রার্থনায় বিগলিত মন।
ক্রোধাগ্নি ব্রহ্মা স্বদেহে করেন ধারণ।।
বাহিরিল ভেদি তাঁর সব ইন্দ্রিয়দ্বার।
পিঙ্গলা নারী একটি রক্ত আঁখি তার।।
ব্রহ্মা কন,”মৃত্যু, শোন আদেশ আমার।
জীবপ্রাণ আজি হতে করিবে সংহার”।।
কহিলা মৃত্যু ব্রহ্মায় করিয়া রোদন।
“কিরূপে করিব এই কুকর্ম সাধন।।
করিবে বিলাপ লোক লাগি প্রিয়জন।
তাই নারিব হরিতে প্রাণ অকারণ।।
হে প্রভু, এ ক্রুর কর্ম অনুচিত অতি।
অধর্ম না যেন করি, আমার মিনতি”।।
কহেন ব্রহ্মা, “তুমি না করহ বিচার।
সকল জীবে নাশিবে আদেশ আমার”।।
তথাপি মৃত্যু সে কর্মে হলো অসম্মত।
ধেনুক ঋষি শরণে হলো উপনীত।।
অতঃপর ব্রহ্মা-ধ্যানে হইলেক রত।
তুষ্ট ব্রহ্মা বর দানে আসি উপস্থিত।।
কহিলা মৃত্যু তাঁহারে প্রণমি চরণে,
“চাহি না হইতে পাপী জীবন হরণে।।
পাপ কর্মে মুক্তি চাই, এই চাহি বর।
জীব কুল বেঁচে থাক হইয়া অমর”।।
“পাপ কর্ম নয় ইহা নাহি পাও ভয়।
তব পাশে আছি আমি দিলাম অভয়।।
সনাতন ধর্ম সদা রক্ষিবে তোমায়।
লোকপাল যম তব রহিবে সহায়।।
রোগ ব্যাধি যত সব সাহায্যে তরে।
রহিবে নিষ্পাপ তুমি আমারই বরে”।।
মৃত্যু কহিলা,”এ আজ্ঞা শিরোধার্য মম।
আজি হতে সব প্রাণী করিব সংহার।।
কিন্তু কাম ক্রোধ লোড বিদ্ধ যেই জন,
কেবল তারেই আমি করিব হনন”।।
ব্রহ্মা কহেন তখন, “হোক তবে তাই।
শুরু কর তব কাজ কোন ভয় নাই”।।
*
অতঃপর নারদ কন অকম্পনে,
“ব্রহ্মা আজ্ঞা মৃত্যু তাই রত নিসূদনে।।
অতএব মহারাজ না করিও শোক।
মরণের পরে জীব যায় পরলোক।।
অবস্থান করে তথা সূক্ষ্ম শরীরে।
কর্মক্ষয় হলে পুন মর্ত্যে আসে ফিরে।।
দেহ ভদি প্রাণবায়ু যদি হয় বার।
সেই দেহে কভুও সে ফেরেনা তো আর।।
লভি স্বর্গ তব পুত্র আনন্দিত মনে,
বিরাজে তথায় সুখে পুণ্যবান সনে।।
*
অমৃত কিরণে অভি আছে ইন্দ্রলোকে।
পুণ্যবান সনে সদা বিরাজিত সুখে।।
অতএব যুধিষ্ঠির ত্যাগ কর শোক।
আশীর্বাদ করি আজ তব জয় হোক।।
এত কহি ব্যাসদেব হলেন প্রস্থিত।
যুধিষ্ঠির মনে শান্তি শোক দূরীভূত।।
★★★★
(চলবে)