Spread the love

শঙ্খচিলের ওপারে 

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

********************

https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

ভাগ্যের চাকা যে এমনি করে ঘুরবে, তা এক বছর আগে ঘূণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি নীলয় বাবু, নীলয় সেনগুপ্ত। ছোটদি, মানে তনুজা সেনগুপ্তা তখন এখানে, ব্যারাকপুরের খানবাহাদূর রোডের বাপের বাড়ীতে। পূজোর ছুটি; কলেজ বন্ধ; আধ্যাপনা নেই; তাই গোটা অবকাশটা এখানেই কাটাতে চান। জামাইবাবু ডাক্তার সুবোল সেনগুপ্ত। Practice -এর জন্য আগরতলায়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজোর আগের দিন দীপাঞ্জন বিজয়া করতে ওঁদের বাড়ীতে। সবাইকে প্রণাম সেরে মিষ্টিমুখ করে ও চলে যাবার পর অধ্যাপিকা সেনগুপ্তা–ছোটভাইকে ডেকে বললেন — কাজটা তোরা মোটেও ঠিক করছিস না নীলয়।

https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

— কেন ছোটদি?

— এই যে দীপাঞ্জন বলে ছেলেটা আমাকে সহ তোদের সবাইকে প্রণাম করে গেলো, তোর বৌ মালা, বড়বৌদি ও মেজো, তিনজনে মিলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ওকে মিষ্টি মুখ করালো এই আদিখ্যেতা মোটেও ভালো না। ভাইঝিটার মানে তনুশ্রীকে মাথায় লেই দিয়ে সর্বনাশ করছিস তোরা। 

–এইভাবে বোলছো কেন ছোটদি? বড়দা আজ বেঁচে নেই। তনু আমাদের ভাইঝি নয়; ও আমাদের বড় মেয়ে: আমরা ওর সর্বনাশ চাইতে পারি?

–কিন্তু, আদপে করছিস তো তোরা তাই।

— কীভাবে?

–কীভাবে? ন্যাকা! ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানো না!

— না না, ছোটদি, বলো না, খুলে বলোনা!

— ওই যে দীপাঞ্জন! ওই ছোঁকড়ার কাজ তো এখন লবোডঙ্কা: ওর কোম্পানী তো মায়ের ভোগে গেছে; এখন তো B. D. O.

— বেকার ডেভালপমেন্ট অফিসার। 

— ছি, ছি, ছোটদি! তুমি একজন সম্মানিতা প্রবীণা অধ্যাপিকা, একজন Respected ডাক্তারের স্ত্রী; আগরতলার এক জমিদার পরিবারের বৌ। তোমার মুখে এমন অশালীন, এমন অমানবিক কথা কি মানায়? দীপাঞ্জন তো খুব ভালো ছেলে। অত্যন্ত সৎ, রুচিবান, পরোপকারী।

–সৎ আর পরোপকরী নিয়ে কি আমাদের ভাইজি ধুয়ে খাবে?

— না, তা না। কিন্তু এটা আগে জরুরী। ও তো ভালো একটা MNC –তে চাকরি কোরতো। করোনার আবর্তে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি লোকের চাকরি চলে গেছে। দীপাঞ্জনও সেই প্রক্রিয়ার শিকার। 

–সেই জন্যই তো বলছি, বাপহারা আমাদের ভাইঝিকে অতো লাই দিও না। একটু বোঝাও। ওসব প্রেম ফ্রেম সাময়িক চোখের নেশা। দীপাঞ্জন নামের দীপকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে আমার সাথে তনুকে ত্রিপুরায় পাঠাও। ওখানে আমার কলেজের এ্যাকাউন্ট ছেলেটি বেশ Handsome। ওর বাপমার সঙ্গে কথা বলে রেখেছি বিয়ের। 

— Sorry ছোটদি। সেটা হবে না।

–কেন হবে না?

–তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমার ছোটভাই; আমার অপরাধ মার্জনা কোরো–

–যে অন্যায় তুমি করেছো, আমাদের ভাইঝি সেই অন্যায় করবে না, আমি অন্তত তাকে তা করতে দেবো না।

–অন্যায়? কিসের অন্যায়?

–ছোটদি! তুমি আমার বিবাহিত বড়বোন। আমি তিক্ততা বাড়াতে চাই না। শুধু এটুকু বলি, তুমি অঞ্জনদার বাকদত্তা ছিলে; অঞ্জনদার তখন অস্থায়ী চাকুরি। তাই কলেজ জীবন থেকে University জীবন, এই দীর্ঘ পাঁচ-ছ’বছরের প্রেম ভালোবাসার সব সম্পর্ককে রাতারাতি পায়ে দলে তুমি অর্থোপেডিক্স-এর ডিগ্রিধারী সুবোলদাকে বিয়ে করলে; কাজটা তুমি ভালো করোনি; আর আখেরে তোমার কোন ভালোও হয়নি। 

–তার মানে?

–তার মানে দুটো — এক, অঞ্জনদার মতো একজন সৎ, কৃতি মানুষ, যিনি তিলে তিলে তোমার Career গড়ে দিলেন, তুমি তাকে প্রেমের নামে ঠকালে। আর দুই হচ্ছে, তাঁকে ঠকিয়ে তুমি নিজেকেই ঠকিয়ে নিজের ফাঁদে পা দিলে– justice of Nature পেলে।

–সেটা কি জিনিষ?

–সেটা বুঝলে না? ছোটদি! বর একটা পেয়েছো বটে। কিন্তু তুমি কি সুখী হতে পেরেছো? হ্যাঁ, অনেক অনেক টাকা তোমার ও জামাইবাবুর। কিন্তু কোন Intellectual and emotional bonding আদৌ আছে তোমাদের দু’জনের মধ্যে? তুমি ও অঞ্জনদা দু-জনেই ইংরাজী সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রী ছিলে, কত গল্প কবিতা ও প্রবন্ধ দু-জনে লিখতে, কত পত্র পত্রিকায় সে সব বেরুতো। কিন্তু চল্লিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তোমার সব finished। সুবোলদা হাড়ের ডাক্তার। ভিন্ন মেরুর লোক। সব সময় নার্সিং হোম আর টাকা উপার্জন নিয়ে ব্যস্ত, তোমার মনের সুখ কোথায়? তার উপর, তুমি সন্তানহীনা। এটাই তো তোমার পাপের সাজা — এটাই হোল তোমার প্রতি justice of Nature ! অথচ অঞ্জনদা তোমার চেয়েও, রূপবতী, গুণবতী, সুলেখিকা, এক অধ্যাপিকাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছন: পুত্র কন্যা নিয়ে সুখে ঘর সংসার করছেন।

মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল প্রফেসার সেনগুপ্তার। উনি আর কথা বাড়াননি। 

এর মাস দুই বাদে নীলয় ও বাড়ীর সবাই দাঁড়িয়ে থেকে দীপাঞ্জন-তনুশ্রীকে সাতপাকে বেঁধে দিয়েছিলেন: দীর্ঘদিনের ওদের দু’জনের বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। বিয়ের সময়ও দীপাঞ্জনের কোম্পানী খোলেনি; আজও সেটা বন্ধ। ও একটা N. G. O. তে সামান্য বেতনের চাকরি করে; তনু একটা নার্সারী স্কুলে পড়ায়: তাছাড়া দু’জনে কিছু টিউশানি করে: তা দিয়ে একটা অংশ খরচ করে রেড ভলেনটিয়ারের কাজে, বাকীটা দিয়ে কষ্টেশিষ্টে হাসি মুখে সংসার চালায়। দু’জনেই নিরলস সমাজসেবী। করোনার প্রকোপ যত বাড়ছে, ততই রেড ভলেনটিয়ারদের কাজের বহর বাড়ছে — দীপাঞ্জন ও তনুশ্রীর ছোটাছুটিও লাগামহীনভাবে বাড়ছে।

এরইমধ্যে দুঃসংবাদটা এলো নীলয় বাবুর কাছে — আগরতলায় করোনায় মুড়ি মুড়কির মতো লোক মরছে: ছোটদি ও জামাইবাবু করোনা আক্রান্ত; বাড়ীতেই রয়েছেন; তাদের দেখার কেউ নেই; আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব কেউই এগিয়ে আসছে না। এখানকার মতো ত্রিপুরায় রেড ভলেনটিয়ারও নেই। নীলয় বাবু খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। মনে মনে স্থির করলেন ঝুঁকি যাই থাক, অবিলম্বে তিনি ছোটদি-জামাই-বাবুর ওখানে চলে যাবেন। বড় বৌদি শুনে বললেন– ছোটদা, তোমার যাওয়া লাগবে না, দীপু ও তনুর সঙ্গে কথা বলি — ওরা রেড ভলেনটিয়ার গ্রুপের সদস্য: ওরা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।

শাশুড়ী মায়ের মুখে ফোনে শুনেই দীপাঞ্জন এসে গিয়ে বলে উঠলো — কাকুমনি, আপনার যেতে হবে না: আমি ও তনু করোনারোগীর সেবার ব্যাপারে Well trained : আমরাই কাল ভোরে যাবো। 

–সে ভালো কথা; কিন্তু, আমিও একটু তোমাদের সাথে যেতে চাই।

— না কাকাই, এই ছোট্ট মা-টার কথা রাখো: তোমার সে ধরনের Protection নেওয়া নেই। তুমি যাবার Risk নিও না। আমরাও তোমায় নিয়ে যাবো না।

–হ্যাঁ ছোটদাভাই, ওদের কথাটাই ঠিক। তুমি যেয়ো না। ওরাই যাক।

আর্থিক সংকট থাকলেও দীপাঞ্জন ও তনুশ্রী মা বা কাকুর কাছ থেকে কোনো টাকাই নিতে চাইনি — মা ও ছোটকাকু জোর করে Updown প্লেন ভাড়া সহ বেশ কিছু টাকা ওদের হাতে দিয়ে দিলেন। 

টানা ১৭ দিন থেকে ছোট পিসি পিশেমশাইকে সেবা করে, পুরো তাঁদেরকে সুস্থ করে রেখে ১৮ দিনের মাথায় দীপাঞ্জন ও তনু বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কৃতজ্ঞতায়, আবেগে, ও লজ্জায়, ওরা বিদায় নেবার পর, তনুজা দেবী ছোট ভাইকে ফোনে ধরলেন — নীলয়, ভাই আমার, তুই-ই ঠিক; আমি ভুল; আমি মানুষ চিনতে পারেনি রে। দীপু ও তনু মাটির পৃথিবীর কেউ নয়। ওরা থাকে শঙ্খচিলের ওপারে। আমাদের বড় বৌদি, আর দীপাঞ্জনের মা, দেব শিশুর গর্ভধারিনী, ওঁরা রত্নাগর্ভা। ওঁদেরকে আমার প্রণাম জানাস।

–থাক ছোটদি, শরীর এখন তোর দূর্বল, জামাই বাবুরও। অতো ইমোশনাল হোসনা। আবার শরীর খারাপ হবে। শুধু তোরা দু’জনে বাপহারা এই বাচ্চাদুটিকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ করিস। আমি পরিস্থিতি আর একটু স্বাভাবিক হলে তোর ওখানে যাবো। 

ভাইবোনের ফোনালাপ শেষ হলো। দূরের কোনো অনুষ্ঠান থেকে নীলয় বাবুর কানে ভেসে আসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান–

আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার 

চরণ ধূলার তলে। 

ছোটদির জন্য তাঁর মনে কষ্টও হয়, আবার বিনম্র শ্রদ্ধায় তার প্রতি মনটা ভরে যায়। 

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

পোষ্ট- টাকী

পিন- ৭৪৩৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *