বার্তা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
মডার্ণ এজ পাবলিক ইস্কুলের একটি নতুন ব্লকের উদ্বোধনে এসেছেন শিক্ষা সচিব ডঃ সঞ্জীব দাশগুপ্ত। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তাঁকে পুষ্প স্তবক, উত্তরীয়, রবীন্দ্র রচনাবলী ইত্যাদি দিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হয়েছে। এবার তাঁর উদ্বোধন ও বক্তৃতার পালা।
লাল ফিতে কেটে নবনির্মিত ভবন উদ্বোধন করে তিনি বলতে শুরু করলেন–এই নিয়ে আপনাদের এই প্রতিষ্ঠানে আমার দ্বিতীয়বার আসা।
কর্মকর্তাদের বেঞ্চ থেকে জোর হাততালি–তাই দেখে গোটা হলেই মিনিট দুই ধরে উচ্ছ্বসিত করতালি। তারপর আবার ডঃ দাশগুপ্তের সংযোজন–প্রথমবার এসেছিলাম আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেঃ আমার দাদুর সাথে; তখন আমার ছয় বছর বয়েস। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে। এ্যাডমিশান টেস্টে ফার্স্ট হয়েও আমার ভর্তি হওয়া হয়নি। কারণ টাকা। আমার বাবা ছিলেন না। বৃদ্ধ ঠাকুরদা ছিলেন দরিদ্র প্রাথমিক শিক্ষক। ভর্তির অতটাকা দেবার মতো এবং মাসে মাসে অত মাহিনা দেবার মতো ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাই তাঁর অনুরোধ ছিল যদি ভর্তি ফি এবং প্রতিমাসের টিউশান ফি fifty Per cent কমানো যায়। হেডস্যার ও Secretary sir দাদুকে বলেছিলেন–এটা বটতলার স্কুল নয়, Well famous Modern Age Public School। এটা চ্যারিটির জায়গা নয়। চ্যারিটির জায়গা হোল বটতলা আমড়া তলার স্কুল। নাতিকে নিয়ে সেসব জায়গায় যান।
ষাট ছু্ঁই ছুঁই আমার বৃদ্ধ দাদু ম্লানমুখে আমার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং যাদেরকে সেদিন তাচ্ছিল্য করে বলা হয়েছিল বটতলা, কেওড়া তলার স্কুল, সেই রকম একটা অখ্যাত অজ্ঞাত স্কুলে উনি আমায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন। নাম ছিল দক্ষিণ বাগুন্ডী ফ্রি প্রাইমারী স্কুল। সেখান থেকেই আমার যাত্রা শুরুঃ ছেঁড়া জামা, টায়ারের জুতো পরা শিক্ষক মশায়দের স্নেহ, যত্ন, আশীর্বাদ নিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষ করেছিলাম যেটা অনেকের ভাষায় অজপাড়াগাঁ, সেই অজ পাড়াগাঁর একটি কলেজেঃ কোন এলিট প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ আমার হয়নি।
একটু জল খেয়ে শিক্ষাসচিব বললেন–আপনাদের এই শিক্ষায়তন একটি নামী অভিজাত শিক্ষায়তন। আমি এর আরও শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। তবে একটি আবেদন, একটি বার্তা, আমাদের মতো গরীব দেশে শিক্ষাকে মহান সেবা হিসাবে সবাই দেখুন। মুনাফাবাজির জায়গা হিসাবে দেখবেন না। আজকের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র আপনারা দিয়েছিলেন প্রায় একমাস আগে। রক্তমাসে গড়া মানুষ আমিঃ প্রথমটায় মনে হয়েছিল ত্রিশ বছর আগের সেই স্মৃতির কথা। ভেবেছিলাম আসবো না। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম আমার অন্তরের মধ্য থেকে আমার স্বর্গতঃ দাদু আমায় নির্দেশ দিচ্ছেন এখানে আসতে, আর আমার বাল্যের মতো যারা আর্থিকভাবে দুর্বল, মেধা থাকতেও ভর্তি হতে এসে এখান থেকে যাতে তাদের কাউকে ফিরে যেতে না হয়, তার জন্য কিছু একটা করতে। তাই সরকারী তহবিল থেকে নয়, আমার কষ্ট অর্জিত সঞ্চয় থেকে সেদিন যে বৃদ্ধ প্রাথমিক শিক্ষক ম্লানমুখে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এই স্কুল থেকে তাঁর শিশু নাতির হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, আমার সেই স্বর্গতঃ দাদু রমারঞ্জন দাশগুপ্তের স্মৃতিতে, দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জাতিধর্ম-ব্রাহ্মণ-হরিজন-হিন্দু-মুসলিম-খৃষ্টান-নির্বিশেষে সবার পড়াশুনার জন্য একটা স্থায়ী তহবিল গড়তে কুড়িলক্ষ টাকার একটি চেক আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি, এই বিদ্যালয় পরিচালন সমিতিরও সভাপতি, মিস্টার হাফিজুর রহমানের হাতে দিয়ে গেলাম।
এগিয়ে গিয়ে ডঃ দাশগুপ্ত চেকটি হাফিজুর সাহেবের হাতে দিলেনঃ মাথা নীচু করে তিনি সেটা নিলেন; কথা বলার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়লো; কিন্তু হাফিজুর সাহেব তালি দিলেন কিনা সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
ডঃ দাশগুপ্ত সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেলেন। গাড়ী রওনা দিল। দূর থেকে মাইকে তখন তাঁর কানে ভেসে আসছে পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠে গান
চিরদিন
কাহারো সমান নাহি যায়।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত