বিশ্ব বরেণ্য সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন স্মরণে
✍️বটুকৃষ্ণ হালদার✍️বিভিন্ন লেখনীর মাধ্যমে আমরা প্রিয় সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন সম্পর্কে নতুন করে জানলাম, তাঁর সম্বন্ধে যে টুকু জেনেছি তা যৎসামান্য আমাদের কাছে। তবে গভীর সমুদ্রের তলদেশের হদিশ কি কেউ পায়?একটা দেশের মূল স্তম্ভ হল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থ ছাড়া দেশের সুস্থ সামাজিক উন্নত বিকাশের ধারা সম্পূর্ণ অচল ঠিক তেমনি নবনীতা দেব সেন ছিলেন সাহিত্যের এক অন্যতম মূল স্তম্ভ। তাঁর প্রয়াণে সাহিত্যের অঙ্গনে যে মহা শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।বার্ধক্য কিম্বা দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে হার মানাতে পারেনি, জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত শুধু দিয়ে গেছেন কলমের কারুকার্য। নিয়মের গন্ডির কাছে শুধুমাত্র হার মেনেছিল তাাঁর শরীরটা, দৃঢ় মানসিকতা নয়। নিজের ঘর টাকে বানিয়েছেন বইয়ের সমুদ্র। কাঠের আলমারি,শোকেস গুলোতে স্তরে স্তরে সজ্জিত শুধু বই আর বই। তারি মাঝে ফুলে ফুলে ঢাকা,”শেষপারের” খেয়াতে শায়িত নিথর দেহটি।এই মুহূর্তে কেউ মন থেকে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সাহিত্যিক নবনীতাদেব সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।”তোমার দেহ ফুলে ফুলে ঢাকা কে বলে আজ তুমি নেই”। নবনীতা দেব সেন যে আজ আর আমাদের মাঝে নেই, এই কথাটা বিশ্বাস করতে আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। মৃত্যু অতি বাস্তব,তাকে মেনে নেওয়াটা শ্রেয়। কিন্তু আমাদের দেশে তথা বিশ্বে এমন মহানুভবদের মৃত্যুতে সমাজ তথা দেশের যে অভাবনীয় ক্ষতি হয়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।সত্যিই তিনি অমর হয়ে রইলেন সমস্ত পাঠককুলের হৃদয়ে। জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন কিন্তু পুরস্কারটা জীবনে বড় কথা নয়, কতটা পাঠককুলের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন সেটাই বড় কথা। তিনি ছিলেন এ সবের ঊর্ধ্বে। নবীন সাহিত্যিক দের কাছে তিনি “মা” হিসাবে পরিচিত ছিলেন।তিনি হয়তো নিয়মের গন্ডি অনুসারে ছেড়ে গেছেন আমাদের রেখে গেছেন অগণিত ভক্ত ও জাগতিক সংসার।নোবেল জয়ী বাঙ্গালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের প্রাক্তন স্ত্রী ছিলেন সাহিত্য জগতের মুকুট পালক। সেই পালক ঝরে পড়ল।এ শুন্যতা আর যুগ যুগ ধরে আর পূরণ হবার নয়। তবে তিনি নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের স্ত্রী হিসেবে যতটা না পরিচিত,তার থেকে বেশি পরিচিত সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন রূপে। সমগ্র ভারত তথা মহা বিশ্বের হৃদয়ে এক বিশাল জায়গা রেখে গেলেন।তিনি ছিলেন একজন বিশেষ খ্যাতনামা কবি লেখক ও বিশিষ্ট শিক্ষা বিদ। বাংলা ভাষা ছাড়া ও অনেক ভাষায় ছিলেন সমান পারদর্শী। বিশ্বের প্রায় ৫০ টি ভাষা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।১৯৬১ সালে লন্ডনে, বিয়ের পর গিয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে।এসময় অক্সফোর্ডের বিভিন্ন কলেজে আমন্ত্রণ পেতে শুরু করেন। এর পর অগণিত দেশে ভ্রমণ করেছেন। তাঁর বিদেশ ভ্রমণ অধিকাংশই ছিল আলোচনা চক্রে আমন্ত্রণমূলক সফর।১৯৮৭ সালে ভ্যানকুভার বিশ্ববিদ্যাল য়ে শিক্ষকতা করার জন্য ডাক পেলেন।সেই বছরেই ইউটা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউইয়র্ক এর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণের জন্য ডাক পেয়েছিলেন। তাঁর জীবনে বিশেষ বক্তব্য ছিল গবেষণা মূলক কাজের উপর।১৯৮৯ সালে দিল্লি, ১৯৯১ সালে আমেরিকার ও জাপান,১৯৯৬ _১৯৯৭ সালে অক্সফোর্ডে রাধাকৃষ্ণাণ স্মারক বক্তৃতা মালা বিশেষ উল্লেখ্য ছিল।একে একে চিন জাপান বনাম পোল্যান্ড পেরু আর প্রতিবেশী বাংলাদেশের গেছেন বহুবার আমন্ত্রিত হয়ে কানাডা অস্ট্রেলিয়া জার্মানি যেখান থেকে ডাক পেয়েছেন সেখানে ছুটে গেছেন ভগ্ন শরীর তার বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর লেখা “ভ্রমণ সমগ্র”তে তার বিস্তারিত তথ্য আছে।খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে নরওয়ে র উত্তরতম বিন্দু তে মধ্যরাতে দেখেছেন সূর্যোদয়।১৩ বছর বয়সে প্যারিস ভ্রমণ। বালিকার চোখে অবাক পৃথিবীতে দেখেছেন নোতরদাম গির্জা, গল্পের হ্যাঞ্জব্যাক, কোয়াসিমোদো।এমন উজ্জ্বল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বিদগ্ধ নবনীতা দেব সেনের জীবনে ঘনিয়ে এসেছিল শ্রাবণের কালো মেঘ। জীবনে হঠাৎ বেঁকে দাঁড়িয়ে আবার তার বাক্য হরণ হয়েছিল। একটা আচমকা ধাক্কা লেগেছিল জীবনে যার জন্য তিনি কোনদিন মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। সে সময় বালিশ চাপা দিয়ে মুখ গুঁজে কেঁদে গেছে নীরবে। কারণ তিনি ছিলেন একজন নারী।কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছিল। মনে মনে আক্ষেপ করেছিলেন দুটো বাচ্চা নিয়ে হয়তো আমি একা হয়ে গেলাম। তখন তিনি ছিলেন বিলেতে। স্পিচ থেরাপি নিতে হয়েছিল কথা বলার জন্য। কিন্তু মৌনব্রত দিলেন ডাক্তার এক মাসের। তাঁর কণ্ঠস্বর জন্মের মতো ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। অবশেষে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ পাকা হয়ে গেল। ফিরে এলেন কলকাতায় দুটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে। সে সময় অন্তত তিনমাস উচ্চস্বরে কথা বলবার বিধি নিষেধ ছিল। কিন্তু দেশে ফিরে আবার নতুন জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে লাগলেন। নতুন কর্মজীবন শুরু করলেন। এরপর একের পর এক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চললেন সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেন। তার অদম্য মনোবলের কাছে হার মানল অনিচ্ছা শক্তি। দুটি ছোট বাচ্চা নিয়ে কারো সাপোর্ট ছাড়াই কিভাবে জীবন যুদ্ধে উত্তীর্ণ হতে হয় সেই লড়াইটা শিখিয়ে দিয়ে গেলেন এ সমাজের অসহায় নারীদের।এভাবে জিতে ও জীবনের কাছে হার না মানা গল্পের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন।
https://www.patrika.kabyapot.com