নাদিরা
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী
ঊর্ধ্বশ্বাসে দাড়িওয়ালা লোকটা তার বাচ্চামেয়েটার হাত ধরে ছুটছে। পিঠে তার একটা ঝোলা। তার পিছু পিছু ছুটছেন সামান্য দূরত্ব রেখে ধোপ ধূরস্ত দু’জন। রাস্তার দু’ধারে লোকজন দেখতে দেখতে তারাও কেউ কেউ পেছন পেছন ছুটতে লাগলো। একজন গেরুয়াধারী ছুটতে ছুটতে মন্তব্য কোরলো–এর দাড়ি গোঁফ, লুঙ্গি পাঞ্জাবী দেখে আমি নিশ্চিত, এ হোল নিশ্চিত মোল্লার ব্যাটা; আর দেখতে হবে না, শালা নিশ্চিত ঐ ভদ্রলোকদের কিছু হয় চুরি করেছে, নইলে ছিনতাই করেছে। ধরি আগে, তারপর মজা দেখাচ্ছি।
ছুটতে ছুটতে চৌরাস্তার মোড়ে বাপ বেটী হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।
–উঃ, আব্বা! বাচ্চাটা কাতরে উঠলো।
–খুব লেগেছে মা নাদিরা?
–খুব আব্বা।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});পেছনের ধুতিপরা, গলায় তুলসী মালা দেওয়া ভদ্রলোক কাছে আসার আগেই গেরুয়াধারী ওদের কাছে এসেই নাদিরা নামটা শুনেই বলে উঠলো–
হিসেব আমার ভুল হয়নি। শালারা জেহাদীর পো, যারা গোটা দুনিয়াটা জ্বালাচ্ছে।
–কি এসব আজেবাজে বলছেন আপনি?
–কেন? এরা সাধু নাকি?
–আলবৎ সাধু। ধুতি–তুলসির মালা পরা ভদ্রলোকটি বললেন।
–জয় সিয়ারাম। তাহলে আপনি ছুটছিলেন কেন এদের পিছনে?
–তার কারণ, ওনার বাচ্চাটা খুবই ক্ষুধার্ত। হয়তো বা উনি এবং বাড়ীতে ওঁর স্ত্রীও। তাই তাড়াতাড়ি আমার দোকান থেকে রুটি কিনে টাকা দিয়ে উনি বাড়ীর উদ্দেশ্যে এই ছোট্ট মামনিকে নিয়ে ছুটছিলেন। কিন্তু Balance টা উনি ফেরৎ নিতে ভুলে গেছেন। ভাবুন তো, দশ টাকা রুটির দাম, উনি একটা দু’হাজার টাকার নোট দিয়ে বাকীটা ফেরৎ না নিয়ে খিদের জ্বালায় বাচ্চাটাকে নিয়ে ছুটেছেন বাড়ীর দিকে। তাই Balance টা দেবো বলে ছুটছি।
–শুধু Balance নয়। উনি আগেই নগদ দুশো টাকা দিয়ে এই চালের প্যাকেটটা কিনেছিলেন। সেটাও নিতে ভুলে গেছেন। তাই আমিও কাকাবাবুর সঙ্গে ছুটতে ছুটতে এসেছি।
–আপনি কে?
–আমি কাকাবাবুর দোকানেরই এক কর্মচারী। ভোলা, ভোলানাথ নিয়োগী।
–যত্তোসব।
বিরক্ত মুখে গেরুয়াধারী চলে গেলেন। চালের প্যাকেট ও দশ টাকা কম দুই হাজার টাকা নাদিরার বাবাকে তুলে তার হাতে দিলেন দোকানের মালিক ও কর্মচারী। জিজ্ঞেস করলেন
— আপনার নাম কি ভাই?
কাঁচুমাঁচু মুখে উত্তর এলো–নাজির শেখ।
একটু থেমে হাতজোড় করে নাজির বললেন–
–আমার গোনা মাপ করবেন।
–সে কথা পরে হবে। ভোলা তুই একটু নাদিরা মাকে নিয়ে দোকানে গিয়ে মিষ্টি মুখ করা তো। আমি একটু আসছি শেখ সাহেবকে নিয়ে।
ভোলা নাদিরাকে নিয়ে দোকানে গেল।
–বলুন, আপনি কি যেন বলছিলেন নাদির ভাই।
–বলছিলাম, আপনি ফেরেস্তা। বাচ্চা মেয়েটাকে খিদের জ্বালা থেকে বাঁচাতে আপনার দোকান থেকে আমি রুটি চুরি করেছি। আর আপনি কিনা উল্টে আমায় দু’হাজার টাকা ও দশ কিলো চাল দিলেন! হে আল্লা! এ কি তোমার রহম? আপনি আমাকে আমার বাচ্চাটার কাছে, রাস্তার লোকজনের কাছে মান বাঁচিয়েছেন। আল্লা আপনাকে রহম করবেন। আমি এমন কাজ আর কোরবো না।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});–আমাকে এই বলে লজ্জা দেবেন না। এটা আমার কর্তব্য ভাই। আমি সেটাই পালন করেছি মাত্র। পরিস্থিতি আপনাকে এটা করিয়েছে।
–দাদা বাবু! ঠিক তাই। আমি ও আমার স্ত্রী রমলা সেন দু’জনেই এম. এ পাশ। একটি MNC তে দু’জনেই ভালো চাকরি করতাম। আজ দু-বছর সংস্থাটি বন্ধ। সঞ্চয় সবশেষ। কোথাও কাজ নেই। টিউশানীও নেই। খিদের জ্বালায় বাচ্চাটির ছটফটানি দেখে উপায়হীন হয়ে এটা করেছি। আপনি না হয়ে অন্য কেউ হলে তো আমায় চোর বলে পিটেয়ে মেরে ফেলতো।
–জানি না নাজির ভাই। তবে এটা জানি, বাংলাদেশ, পাকিস্থান ইত্যাদি জায়গায় অমুসলমান মানেই কাফের, Criminal, এদেশে মুসলিম মাত্রই Criminal, একটা বিষাক্ত সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে চলছে–মানুষ বড়ো নয়, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারী বড় নয়; বড় হোল ধর্মীয় পরিচয়। এ দেশে রাষ্ট্র ও সরকার, আমি হিন্দু হয়েই বলছি, হিন্দুত্বের নামে মুসলিম ভাইবোনদের অস্তিত্বের সংকট ঘটাচ্ছে। আসলে ভাই Criminal দের তো কোন ধর্ম নেই–সব ধর্মের লোকের মধ্যেই Criminal রা আছে। কিন্তু, আমাদের এখানে এমন একটা বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং হচ্ছে যেন হিন্দুদের মধ্যে কোনো Criminal-ই নেই। সব Criminal-ই রয়েছে মুসলমানদের মধ্যে।
–আমি একজন মোমিন হয়েই বলছি যে যেখানে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু, সেখানে সেখানে তারা অমুসলিমদের অস্তিত্বের সংকট ঘটাচ্ছে। অথচ এমনটা কোথাও হবার কথা ছিল না। হবার কথা ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারী-অপুষ্টি-অনগ্রসরতার অস্তিত্ব সংকট ঘুচানোর।
–ঠিক তাই নাজির ভাই। সেই লড়াই-এরই অংশ হিসাবে তো আজ এটা করলাম। এই লড়াইটাকে আরো ছড়িয়ে দিতে হবে দিকে দিকে।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});—You are great, really great দাদা।
–না না, ওসব বলবেন না–
বলুন ক্ষুধা–দারিদ্র্য–বেকারীর বিরুদ্ধে সবাই একসাথে লড়তে হবে এবং সবাইকে সবার সন্তান বাঁচাতে হবে তাৎক্ষনিকতায় না ভেসে।
দোকানী ভদ্রলোক নাজির সাহেবের হ্যান্ডশেক করে দোকানের দিকে চললেন। নাজির সাহেবও চললেন নাদিরাকে নিতে। পথ চলতি লোকজন মামুলিভাবে এদিকে দৃষ্টিপাত করে চলে যেতে লাগলেন। দূরের একটা ক্লাবের পাশ থেকে ভেসে আসছে ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের গান–
“বিস্তীর্ণ দুপারের, অসংখ্য মানুষের হাহাকার
শুনেও নিঃশব্দে নীরবে
ও গঙ্গা তুমি
গঙ্গা বইছো কেন?”
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2139129812952104 (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত