প্রমা-৩
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
লালমনির গায়ের রং ঘোর কালো টিকা লো নাক চোখ দুটোর গভীরতা অনেক ,—মাপা সম্ভব নয়। বিশাল ওষ্ঠ ।দাঁতের সারিতে উপরের পার্টিতে বাম ও ডান দিকে আলাদা করার জন্য একটা ফাঁক। চওড়া কপাল, উচ্চতা ভালো। চেহারা দোহারা গলায় দারুন জোর। আর দাপুটে।
পাশে কিছু বয়সে বড় মেজ মাসি, সাদা ফর্সা চোখ নাক ওষ্ঠ অনেক বেশি চোখা। দুজনে রেষারেষি করে কে কতদূর সম্পত্তির মালকিন হতে পারে।
লালমনির মা লালমনিকে জন্ম দিয়ে মারা যায় ফলে লালমনি, মামার বাড়িতেই মানুষ হতে থাকে লালমনির বাবা লালমনির জন্মের পূর্বেই মারা গিয়েছিল যথা সময় মাসি ও বোনঝির বিবাহ দিয়ে দেন দাদা মশাই ও দিদিমা। লালমনির বিয়ে হয় ভুরসুট গ্রামে। দামোদরের বাঁধ না হওয়ায়,—
তখন প্রতিবছর এ সকল জায়গায় বন্যা হত ।
লালমনির স্বামী অত্যন্ত সজ্জন কখনো শ্বশুরবাড়িতে এসে বিরক্ত করত না, লালমনিকেও কষ্টে রাখত না। বন্যার পর পলি পড়া জমিতে ভালো চাষ হতো, সেই আলু ও চালে বছর কেটে যেত, কুমড়ো কলা আম কাঁঠাল লিচু বাক্স বাদাম পুকুর ভরা মাছ গেঁড়ি গুগলি, কোন কিছুর অভাব ছিল না। ঘরে গরু হাঁস। তবুও লালমনি বছরে ছমাস মামার বাড়িতে এসে আস্তানা বাঁধত। কারণ কিছু পাওয়ার নেশা তাকে পেয়ে বসেছিল।
ওদিকে মেজ মাসির বিয়ে হয় নিমতায়। নিমতার বেশিরভাগ জমির মালিক ছিল মুখুজ্যে মশাই। নিমতা কালিবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় তার বাড়ি, গোটা আষ্টেক পুকুর বাগান কিছু জলা ধানি জমি এসব নিয়ে তাদের বিশাল সম্পত্তি ছিল। মুশকিল একটাই। তার প্রথম এবং দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যায়। মেজ মাসি মুখুজ্যে মশায়ের তৃতীয় পক্ষ। তাই এই স্ত্রীর বিরোধিতা কখনোই করত না মুখুজ্যে মশাই। সংসারে কাজে ফাঁকি দিতে মেজো মাসি ১৫ দিন বাপের বাড়ি ১৫ দিন শশুর বাড়ি থাকতো ইহার সম্পত্তির দিকে বিশেষ নজর ছিল না, ইহার চার পুত্র ও তিন কন্যা যথাক্রমে তিনকড়ি, নারায়ণ বাদা ও মানা চার পুত্র, এবং তিন কন্যা ছিল, তারা অণু ও বাদী।
অপরপক্ষে লালমনির চার পুত্র যথাক্রমে সহজ সরল বক্র ও রিজু এছাড়া লালমনি আর
মেজ দিদির থেকে অনেক বছরের ছোট আরো কিছু ভাই বোন ছিল। যেমন তোর দাদা মশাই ও তারপর দুই বোন আরো এক ভাই।
ওই দুই বোনের মধ্যে এক বোন খোঁড়া, তাই স্বামী সমেত বাচ্চাদের নিয়ে এ বাড়িতেই থাকতো। ছোটবোন বিমলার স্বামী কোল ইন্ডিয়াতে চাকরির সুবাদে উড়িষ্যার তালচেরে থাকতো, তারা এ বাড়িতে আসলে বেশ অনেকদিন কাটিয়ে তবেই যেত । ইহার পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা যথাক্রমে বাপি সোমনাথ মনটু বদলা ডাকু দুই বোন পুতুল ও পারুল ।
ছোট ভাই ও ছিল খোঁড়া। এদের মধ্যেই জায়গা হল অনাথা লতিকা দেবীর। খোঁড়া ননদের চার সন্তান ভুন্ডি কালু বিলাই এরপর তোর মা টুকু আর তারপর আবার খোঁড়া ননদের ছোট মেয়ে টুনি। এরা সকলে এবাড়িতে পার্মানেন্ট, বাকিরা কিছুদিন হলেও যে যার বাড়ি চলে যেত। এ বাড়িতে বড় লম্বা একখানা রান্নাঘর তার একপাশে মাটির দুটো উনুন, একটা ছোট একটা বড় ।
এ বাড়িতে মাংস ডিম পেঁয়াজ আজও প্রবেশ করেনি শুধুমাত্র মাছ রান্না হতো। তাও সকল রান্না শেষে। শনি মঙ্গল বৃহস্পতি তিনদিন মাছ বন্ধ,— ওই তিন দিন রান্নার শেষে মুড়ি ভাজতো লালমনি, তারপর কৌটা ভরে সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত সকালের দুধ জাল দেবার পর এক বাটি সাবু হতো, তাতে চিনি ও দুধ দিয়ে খোঁড়া ননদের ঘরে দিয়ে দিতে হতো, ওদের সঙ্গেই টুকুও দুধ সাবু খেত। বড়রা মুড়ি পুজোর পাওনা ফলমূল ইত্যাদি টিফিন করতো। মেজো মাসি মানে টুকুর মেজো পিসি লতিকা দেবীর মেজো ননদ আফিম খেতেন, সঙ্গে এক বাটি দুধ। বাকি দুধ শাশুড়ি মাকে দিয়ে যেটা বাঁচতো সেটা লতিকা দেবীর ঘরে চলে যেত, তা নিয়ে কটাক্ষে বাচ বিচারে বসেন জটিলা কুটিলা ।সেই থেকে লতিকা দেবী দুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দুধ ঘি দুটোই ছেড়ে দিলেন। এই বৃত্তান্ত শোনার পর প্রমা বলল এখন তো আর ওরা বেঁচে নেই, তাহলে তুমি দুধ ঘি এখন কেন খাও না? গরিবের মেয়ে, দয়া করে বিয়ে করে এনেছে,— দুধ ঘি না খেলে কি এমন ক্ষতি হবে? প্রমা এবার কঠোর প্রশ্নে বলে এত জন লোকের এক বাড়িতে বাস থাকা সত্ত্বেও তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম কেন করতে না গো? তখন তো ঘরে ঘরে সব ছেলে মেয়েরাই স্বাধীনতা সংগ্রাম করত। লতিকা দেবীর যুক্তি, সারাদিন এত কাজ করতে হতো যে মাঝে মাঝে মনে হতো আমার একদিন অসুখ করে না কেন ? তোর দাদা মশাই তাড়াতাড়ি খেয়ে আমায় নিয়ে একটু আধটু সিনেমা দেখতে যেত ।কিন্তু ফিরে এসে দেখি গরু দুধ দেয়নি টুকুর ঠাকুমাকে কেউ খেতে দেয়নি, ওলট-পালট অবস্থা । সে সামলাতে আবার বেশ কিছুক্ষণ লেগে যেত।
মাঝে মাঝে আনন্দ হতো, পুজোয় পার্বনে তোর দাদা মশাই পূজো করতে গেলে আমরাও পুষ্পাঞ্জলী দিতে যেতাম, খাবার দাবার আসতো, তাছাড়াও তোর দাদা মশাই যাত্রাদলের তবলা বাজাতো। সে তবলার আবার ইতিহাস আছে, টুকুর ঠাকুমা কোন মেয়ের পায়ের তোড়া ঘরে সিন্দুকের ওপর রেখেছিল সে তোড়া বেচে তোর দাদা মশাই ওই তবলা কিনেছিল, তার ফলে তোর দাদা মশাইকে চোর বদনাম নিতে হয়েছিল। যাত্রাপালা পরিচালনা করতেন ফন্তুদা ,কেদার নাথ বন্দোপাধ্যায় রচিত “দক্ষযজ্ঞ” পালা প্রতিবছর হতো এছাড়াও গিরিশ ঘোষের কিছু নাটক যেমন বিল্ল মঙ্গল কোন কোন বার হত। মেয়েদের চিকের আড়ালে বসার ব্যবস্থা থাকত। তখনও আমরা বাড়ির মেয়ে বউরা যেতাম।
স্বাধীনতার কথা আর বলিস না, একবার মাথার উপর খালি এরোপ্লেন ঘুরতে আরম্ভ করল, রাতে আলো দেখলেই সেখানে বোমা ফেলতে আরম্ভ করল
তখন তো বিদ্যুৎ ছিল না লম্প হারিকেন জ্বলতো কেরোসিনে,— সেটাও জ্বালা বারণ । সূর্য অস্ত গেলেই অন্ধকারে হাতড়াও ,
বাচ্চা থাক, আর রোগী থাক !
কোন কিছুরই কোন ব্যাপার নেই, দম বন্ধ করা পরিস্থিতি। বেলঘরিয়ার এক ভদ্রলোকের টয়লেট পেয়েছিল সে পুকুর ধারে টয়লেটে গিয়ে, গাছের আড়ালে লমফো জ্বালিয়ে টয়লেট করছিল আর ব্যস
ওখানেই
পড়ল বোম ,—পুকুর ভর্তি মাছ সব ছিটকে পড়ল বাগানে, পুকুরের জল শুকিয়ে একদম একাকার অবস্থা।
বলাই বাহুল্য তখন টয়লেট এখনকার মতো বাড়ির মধ্যে হতো না ,
ঘরেই যখন স্বাধীনতায় বসবাস করা যাচ্ছে না, তখন দেশের স্বাধীনতার কথা আমার মোটা মাথায় আসেনি রে—
তা বোম ফেলল কারা? জানিনা ,—
তবে সবাই বলতো, সারেগামাপাধানি ,বোম ফেলেছে জাপানি।।