ছন্দ কবিতায় ছন্দ থাকা আবশ্যক (দ্বিতীয় পর্ব)
ছন্দ শেখার চটপট কৌশল:–
বিধান চন্দ্র হালদার
প্রথমে বলি, অনেকেই আছেন আমার থেকে ভালো ছন্দ জানেন। তাদেরকে প্রথমে সম্মান ,শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই। তাদের জন্য এ লেখা নয়। যারা একদমই ছন্দ জানেন না কেবলমাত্র তাদের জন্য এই লেখা। কিভাবে চটপট সুন্দর ছন্দ শিখব? কিভাবে ঝটপট ছন্দে ছন্দে কবিতা লেখা যায়? নির্ভুল ছন্দে কিভাবে কবিতা লেখা হয়?–এর একটি প্রাথমিক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি। যেগুলি না বললেই নয় কেবল মাত্র সেগুলি বলবো। ছন্দ বিষয়টি খুবই সোজা। আসলে আমরাই খুব জটিল করে ফেলি। বিভিন্ন বইতেই ছন্দ সম্পর্কে এত ভারী ভারী শব্দ শুনতে শুনতে আমরাই ছন্দহীন হয়ে যাই। সেই জটিলতার মধ্যে না গিয়ে, কত সহজে, কত তাড়াতাড়ি নির্ভুল ছন্দে কবিতা লেখা যায় তার একটি নব কৌশল। যারা ছন্দ জানেন তারা ভুল ধরিয়ে দিলে নিজে সমৃদ্ধ হবো। রবীন্দ্রনাথের কথায়–“দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে”
ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা:—
“সেতারে তার বাঁধা থাকে বটে কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া । ছন্দ হচ্ছে সেই তার বাধা সেতার। কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে”
—কিভাবে তার বাধা সেতার থেকে খুব সহজে সুর তৈরি করা যায়?- সেটাই জানতে হবে আমাদের।
ছন্দ সম্পর্কে অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন এর ধারণা:—
“সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত বাক্ বিন্যাসের নাম ছন্দ”
—শব্দ ও বাক্য কিভাবে সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত করা যায় সেটাই আমাদের শিখতে হবে।?
ছন্দ সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু এর ধারণা:–
“কাব্যের প্রধান বাহন সেই সুনিয়ন্ত্রিত বেগ বিকশিত ভঙ্গি যার নাম ছন্দ”
—সেই সুনিয়ন্ত্রিত বেগ বিকশিত ভঙ্গি আসলে কি সেটা জানা খুবই প্রয়োজন?
ছন্দ সম্পর্কে আরো অনেকে অনেক কথাই বলেছেন, স্বল্প পরিসরে সেগুলি লিখলাম না কারণ আমরা চটপট ছন্দ শিখতে চাই।
রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধচন্দ্র সেন, বুদ্ধদেব বসু আরো অনেকে,–এদের ছন্দ সম্পর্কে কঠিন কঠিন মতামত ও ধারণা জেনে আমাদের কি লাভ প্রথমে মনে জাগে? লাভ তো আছেই নইলে লিখব কেন? এনারা ছন্দকে সরবত করে গিলে খেয়ে ছিলেন। আরো অনেকেই আছেন, আমি প্রথমেই বলেছি জটিলতা বাড়াবো না। যেটুকু না বললেই নয় সেইটুকু। জানি অনেক ছন্দ বিশারতের মন তৃপ্ত হবে না। তাও লিখব কারন যারা একদম ছন্দ জানেন না, তাদের জন্য। সাইকেল চালাতে গেলে যেমন করে হ্যান্ডেল, ব্রেক, বেল,চেন এমনকি রাস্তায় চলার কিছু নিয়ম কানুন শিখতেই হয়, নইলে যে কোনো সময়ে ধাক্কামারার সম্ভাবনা প্রবল। এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। ছন্দের ক্ষেত্রেও অনুরূপ।
ছন্দ শিখতে গেলে তেমনই কিছু প্রাথমিক বিষয় জানা আবশ্যক। সেই প্রাথমিক বিষয় গুলি এক এক করে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। নিম্নলিখিত বিষয় গুনি না জানলে ছন্দ কবিতা লেখা যাবে না–
১, ধ্বনি(sound):-
——————–
মানুষের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ যন্ত্রের সাহায্যে মুখগহবর থেকে যে শব্দ উচ্চারিত হয় সেটাই ধ্বনি।
২, বর্ন (letter):–
বাগ যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি গুলি কে যে প্রতীক চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় সেটাই বর্ণ।
বাক্ যন্ত্র কী?
কথা বলার জন্য। ঠোঁট, কন্ঠ, দাঁত, জিহ্বা, প্রভৃতি অর্থাৎ মুখের ভেতরের বিভিন্ন পার্টস।
—ধ্বনি ও বর্ণ ঠিক বোঝা গেল না? উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা বোঝা যাক–
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোন ব্যক্তিকে বললাম –“কুকুর” তখন মুখগহবর থেকে কুকুর শব্দটি ধ্বনি হয়ে বেরিয়ে এলো।
কুকুর={ক্+উ+ক্+উ+র+০)–পাঁচটি ধ্বনি।
কিন্তু দূরের কাউকে বোঝাতে গেলে এই পাঁচটি ধ্বনি সমষ্টিকে প্রতীকে বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তাই হল বর্ন।
এক কথায়–মুখের আওয়াজ অর্থাৎ কানে যা শুনি তাই ধ্বনি। আর ধ্বনির লিখিত রূপ অর্থাৎ ধ্বনি কে বোঝানোর জন্য প্রতীক তাই হলো বর্ন।
অনুরূপভাবে–
বিধান–(ব্+ই+ধ্+আ+ন +০)–পাঁচটি বর্ণ
কবিতা–(ক্+অ+ব্+ই+ত্+আ)–ছয় টি বর্ন
বাংলা ব্যাকরণ এর ক্ষেত্রে বর্ণ ও অক্ষর একসাথে ব্যবহার হয়। কিন্তু ছন্দের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহার হয়। এবার আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে ছন্দের ক্ষেত্রে ধ্বনি বা বর্ণ শিখে কি লাভ? লাভ তো অবশ্যই আছে। শব্দের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতে ধ্বনি বা বর্ণ কে জানতেই হবে। যেমন ভাবে হাঁটতে গেলে পা দরকার। কথা বলতে গেলে মুখ দরকার। ঠিক তেমনি ধ্বনি বা বর্ণ হল ছন্দের মূল আশ্রয় স্থল। ছন্দের মূল মেরুদন্ড হল ধ্বনি বা বর্ণ। একটি শব্দের কয়টি বর্ণ আছে জানতেই হবে। আগের উদাহরণ দিয়েছি। আবার দু- একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে—
কমল –(ক্+অ+ম্+অ+ল)-পাঁচটি বর্ণ
( Kamal)
সুপারি—(স্+উ+প্+আ+র্+ই) –ছয়টি বর্ণ
(Supari)
অক্ষর বা দল (syllable ) সম্পর্কে ধারণা
বর্ণ যদি ছন্দের মেরুদন্ড হয়, তাহলে অক্ষর বা দল কে ছন্দের মূল ফুসফুস বলা যায়।
ফুসফুস ছাড়া যেমন মানুষ অচল তেমনি ছন্দের ক্ষেত্রে অক্ষর বা দল ছাড়া ছন্দ অসম্পূর্ণ।
অক্ষর বা দল কী?
—–বাক্ যন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে অর্থাৎ এক ঝলকে বা এক ঝোঁকে বা এক প্রয়াসে শব্দের মাঝখানে যতটুকু ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারি তাকে অক্ষর বা দল বলে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝা যাক–
“গীতাঞ্জলি ” শব্দটির বর্ণগুলি এক নিঃশ্বাসে কমকম করে যতটুকু উচ্চারণ করা যায়–
গী+তান+জ+লি= চারটি অক্ষর বা দল
অনুরূপভাবে–
ছেলে–ছে+লে= দুটি অক্ষর বা দল
আনন্দ–আ+নন+দ=তিনটি অক্ষর বা দল
বিজয়বাসিনি—বি+জয়+বা+সি+নি= পাঁচটি অক্ষর বা দল
ছন্নছাড়া—ছন+ন+ছা+ড়া= চারটি অক্ষর বা দল
অশ্ব পৃষ্ঠ–অশ্ +শ +পৃষ+ঠ= চারটি অক্ষর বা দল
অক্ষর বা দল (syllable) এর প্রকারভেদ
দুই প্রকার–
১, মুক্ত দল(open syllable)
২, রুদ্ধদল(closed syllable)
মুক্ত দল
যে দলের শেষে স্বরধ্বনি থাকে সেই দলকে মুক্ত বা স্বরান্ত বা বিবৃত দল বলে।
যেমন–
ছেলেবেলা—ছে+লে+বে +লা =চারটি মুক্ত দল।
(ছ+এ),(ল+এ),(ব+এ) (,ল+আ)
রুদ্ধ দল
যে দলের শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে সেই দলকে রুদ্ধ বা ব্যঞ্জনান্ত বা সংবৃত দল বলে।
যেমন–
জল–জ+অ+ল= একটি রুদ্ধদল
বন্ধন–বন+ধন =দুটি রুদ্ধ দল
( ব+অ+ন), (ধ+অ+ন)
এবার মনে প্রশ্ন জাগে বর্ণমালা কাকে বলে? স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ কাকে বলে? কোন গুলি স্বরবর্ণ, কোনগুলি ব্যঞ্জনবর্ণ।
বর্ণমালা–
—একটি ভাষায় যতগুলি বর্ণ ব্যবহার করা হয় তাকে বর্ণমালা বলে।
স্বরবর্ণ–
——-অন্য কোন ধ্বনি সাহায্য ছাড়া আপনা আপনি যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় সেগুলি স্বরধ্বনি। অ থেকে ঔ পর্যন্ত।
ব্যঞ্জনধ্বনি–
——–স্বরধ্বনির সাহায্য ব্যতীত স্পষ্টরূপে যে ধ্বনি উচ্চারিত হয় না তাকে ব্যঞ্জন ধ্বনি বলে। ক থেকে ক্ষ পর্যন্ত।
এবার একটি শব্দ দিয়ে দেখাবো শব্দটির মধ্যে কয়টি বর্ণ আছে ও কয়টি দল আছে? কয়টি মুক্ত দল? কয়টি রুদ্ধ দল?
যেমন —
বিধান—
ব+ই+ধ+আ+ন=চারটি বর্ণ
বি+ধান= দুটি দল
বি= একটি মুক্ত দল (ব+ই)
ধান= একটি রুদ্ধ দল (ধ+আ+ন)
আরো একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক–
গীতাঞ্জলি= গী+তান+জ+লি= চারটি দল
গী-মুক্ত দল (গ+ঈ)
তান--রুদ্ধ দল (ত+আ+ন)
জ---মুক্ত দল (জ+অ)
লি---মুক্ত দল ( ল+ই)
—অর্থাৎ “গীতাঞ্জলি” শব্দটিতে তিনটি মুক্ত দল(গী,জ,লি)
একটি রুদ্ধ দল(তান)
অক্সিজেন ছাড়া যেমন আমরা বাঁচতে পারি না। তেমনি দল ছাড়া ছন্দ বাঁচবে না। এগুলি পরিষ্কারভাবে জানতেই হবে। নইলে ছন্দের কবিতা লেখা যাবে না। পরবর্তী অংশে কলা ও মাত্রা। ছেদযতি। অন্তমিল । –ছন্দ শিখতে তো 5 মিনিট লাগবে । যেমন করে মাংস ভাত খেতে পাঁচ মিনিটই লাগে। কিন্তু রান্না করতে 1 ঘন্টা 5 মিনিট লাগতে পারে। ছন্দ শেখার ক্ষেত্রেও অনুরূপ। তাই ছন্দ রান্না করাটা আগে শিখে নিতে হবে। তারপর খেতে মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে। পরবর্তী পর্বে সেই রান্নার কৌশল নিয়ে আলোচনা চলবে। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে সরাসরি ফোন করা যাবে। যে কোনো সময়ে।
সময়ের দর্পণ কবি
বিধান চন্দ্র হালদার
বাংলা শিক্ষক
M. A (J U),. B. ED (R.K MISSION RAHARA)
প্রাক্তন স্কুল–
পীরপুর জয়নগর উদয়চাঁদ ইনস্টিটিউশন (উচ্চমাধ্যমিক )
উলুবেড়িয়া। হাওড়া।
বর্তমানে কর্মরত–
মদনমোহন পুর আর. সি.এস বিদ্যামন্দির (উচ্চ মাধ্যমিক)
কুল্পি ব্লক, দক্ষিণ 24 পরগনা।
কাকদ্বীপ ।শান্তিনিকেতন। কবিতা কুঞ্জ।