আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমরা এই কথাটা কতটা মানি জানিনা তবুও সারা জীবন টা আমরা আমাদের সংসার সন্তান ভালোবাসায় ভরিয়ে দিই.. নিজেদের জন্য প্রায় কিছুই রাখিনা.. তবুও আজ একটি দিন মেয়েদের সম্মান পেতে দেখে খুব ভালো লাগে বছরের অন্যান্য দিনগুলি ও যদি সকলে এইভাবে সম্মান করতো না জানি সমাজটাই হয়ত পাল্টে যেত ,তবু সকলকে জানাই “শুভ নারী দিবস “তাই আজ আমার কলমে গল্প…
চাকরি
সোনালী মুখোপাধ্যায়
একি তুমি এখনো বাড়ি যাওনি? বললাম তো আমার ট্যাক্সি চালানোর জন্যে আমার একটা ছেলের প্রয়োজন ..মেয়ের নয়। প্লিজ তুমি বাড়ি যাও, এই কাজ তোমার জন্য নয়। প্রায় তিন ঘন্টা হয়ে গেল তোমাকে আমি এক কথা বলে যাচ্ছি তবুও তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো। তুমি আসতে পারো আমাকে বিরক্ত করো না এভাবে।
বলে সদাশিব বাবু অত্যন্ত বিরক্ত সহকারে আবার অফিস ঘরে ঢুকে পড়লেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে রিনিতা কি করবে কিছু ভেবে পায়না। গ্রাজুয়েট হওয়ার পর থেকে ছমাস ধরে একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে ও। বাড়িতে অসুস্থ বাবা। প্যারালাইজড। সেই কোন ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে রিনিতা, মনেই পড়ে না আর মায়ের কথা। তার কাছে বাবা ই সব। নিজে টিউশনি করে পড়াশোনা টা কোনমতে শেষ করেছে ও। বাবার শরীর বরাবরই খারাপ । আগে একটা দোকানে খাতা পত্র লেখার কাজ করতো। ওর টিউশনি আর বাবার কাজ এই দুই এ মিলে যাহোক করে সংসারটা জোড়াতালি দিয়ে চলে যেত। এখন প্রায় ছ মাস ধরে রণবীর বাবু প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়, বাবার কাজ কর্ম বন্ধ ।শুধু টিউশনির টাকায় সংসার চালানো আর বাবার ওষুধপত্র কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। তাই একটা চাকরির খুব দরকার।
অনেক খোঁজখবর করেও যখন কিছুতেই একটা চাকরি জোগাড় করতে পারল না রিনিতা তখন হঠাৎ খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল।
(প্রাইভেট কার চালানোর জন্য একজন সুস্থ-সবল ড্রাইভার চাই ।সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচ টা পর্যন্ত , সাম্মানিক দশ হাজার টাকা আগ্রহী বেক্তি রা যোগাযোগ করুন) । নিচে ঠিকানা দেওয়া ছিল।
এটা দেখেই রিনিতা সাতপাঁচ না ভেবে ই সকাল বেলায় ছুটে এসেছে সদাশিব বাবু র অফিসে । কারণ রিনিতা নিজে ট্যাক্সি চালানো য় দক্ষ। কলেজে পড়াকালীন অত্যন্ত সখে ও আর ওর একজন বন্ধু রিয়া দুজনে মিলে ড্রাইভিংটা শিখেছিল, এবং লাইসেন্স আছে ওর ।এটা যে এভাবে কাজে লেগে যাবে ও ভাবতেই পারেনি। কিন্তু এখানে আসার পর সদাশিব বাবু একটাই কথা বলছেন তোমাকে এখানে কাজে নেওয়া যাবেনা ,এটা ছেলেদের কাজ ।বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিনিতার মাথা আর কাজ করছে না। এবার কি করবে ও?যাও বা একটা ব্যবস্থা মনে হয়েছিল হবে, সেটাও তীরে এসে তরী ডুববে এভাবে?
কিছুক্ষণ পরে আবার সদাশিব বাবুর দরজায় গিয়ে নক করল রিনিতা।
সদাশিব বাবু… ইয়েস কাম ইন্ … তারপরেই রিনিতাকে দেখে বললেন এখনো তুমি বাড়ি যাও নি ?বললাম তো তোমায়? অত্যন্ত বিরক্ত উনি।
রিনিতা ….ঠিক আছে স্যার, আমি করবো না, কিন্তু আমার একটা ভাই আছে ..দয়াকরে ওকে চাকরি টা দিন.. ও খুব ভালো গাড়ি চালায়… আসলে চাকরিটা আমাদের খুব দরকার স্যার।
সদাশিব বাবু….তাহলে এই কথাটা এতক্ষণ বলনি কেন? আমি তো অনেকক্ষণ থেকেই বলছি এটা মেয়েদের কাজ নয় ,ছেলে ছাড়া কাউকে আমি আমার গাড়ি চালানোর জন্য রাখবো না।
রিনিতা .,..ঠিক আছে স্যার আমি আমার ভাইকে কালকে পাঠিয়ে দেবো।
সদাশিব বাবু ….ওকে …তাই দিও । আচ্ছা তুমি এখন এসো।
আচ্ছা আসছি স্যার।
বলে রিনিতা সদাশিব বাবু ঘর থেকে বের হয়ে এলো। মুখে তার যুদ্ধ জয়ের হাসি।
পরেরদিন সকাল দশটার মধ্যে সদাশিব বাবুর অফিসের দরজায় নক করল একটি কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে। মুখে চাপ দাড়ি মাথায় একটা টুপি সানগ্লাস। পরনে জিন্স প্যান্ট আর পাঞ্জাবি। ছেলেটিকে দেখেই সদাশিব বাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল।
আসবো স্যার?
হ্যাঁ এসো ভিতরে। তা
কি নাম তোমার?
আমার নাম রিমিল। রিমিল সেন। আমি গাড়িটা চালাতে পারব স্যার।
তুমি বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। এখনো পর্যন্ত গলাটাও ভারী হয়নি তোমার। এত ছোট বয়সেই গাড়ি চালাতে পারবে তুমি?
একবার দিয়েই দেখুন না স্যার। না পারলে কালকে থেকে আর আসব না।
ওকে ওকে ঠিক আছে ।এই নাও চাবি। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করো।আমি এখনি বেরোবো।
এরপর পুরো মাসটা রিমিল খুব সুন্দর করে স্বচ্ছন্দে গাড়ি চালিয়ে সদাশিব বাবুর মন জয় করে নিল।
সেদিন মাসের শেষ দিন। একমাস এর কাজ শেষ।
সদাশিব বাবু অফিসে ঢোকার মুখে রিমিল কে বললেন আজ ফেরার সময় মাইনে টা নিয়ে যেও। রিমিল ঘাড় নেড়ে চলে গেলো। সারাদিনের কাজের শেষে রিমিল সদাশিব বাবুর ঘরে ঢুকলো মাইনে নিতে। আজ তার খুব আনন্দের দিন। ঘরে ঢুকতেই একটা খাম এগিয়ে দিলেন সদাশিব বাবু। রিমিল খামটা নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে সদাশিব বাবু বললেন দাঁড়াও রিনিতা। চমকে উঠে রিমিল। সঙ্গে সঙ্গে অসহায় দৃষ্টিতে ঘুরে তাকায় সে। আর বোধহয় শেষ রক্ষা হল না। চাকরি টা বোধয় আজ ই চলে যাবে। যতটা খুশি নিয়ে মাইনেটা হাতে নিয়েছিল সে ততটাই কষ্টে চোখে জল এসে গেল তার। বাবাকে বোধয় আর ভালো করতে পারবে না ও। ডাক্তার পথ্য সংসার এক লহমায় চোখের সামনেই ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল।
সদাশিব বাবু ধীরে ধীরে ওর কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? আমি তোমার কাজে খুব খুশি হয়েছি.. তুমি আমার এতদিনকার চিন্তাভাবনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছো। সত্যিই তো মেয়েরা পারেনা এমন কোন কাজ নেই ,ইচ্ছা করলে সব পারে। আমি প্রথম দিনই তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম , খানিকটা কৌতূহল বসেই আমি দেখতে চেয়েছিলাম তুমি সত্যি সত্যিই এই কাজের যোগ্য কিনা।
দু’একদিনের মধ্যেই বুঝলাম সত্যি তুমি এই কাজের জন্য একদম পারফেক্ট। কাজ কাজ ই। আমারও একটা ভ্রান্ত ধারণা দূর হলো আজকালকার দিনে ছেলে মেয়ে আলাদা নয় ,ছেলেরা যা পারে মেয়েরাও পারে, হয়তো একটু বেশি ই পারে। আজ থেকে তোমার চাকরি পার্মানেন্ট হলো। কাল থেকে আর তোমায় ছদ্মবেশে আসতে হবে না ।তুমি যে পোষাকে স্বাচ্ছন্দ্য সেই পোশাকেই আসবে। বুঝলে?
রিনিতা সদাশিব বাবু পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। তার চোখে তখন আনন্দাশ্রু। নিজের কাছে নিজের কাজের যোগ্যতার পরিচয় দিতে পেরেছে সে।। চাকরি টা সে বজায় রাখতে পেরেছে। আজ যে নারী দিবস ।হ্যাপি ওমেন্স ডে। বাইরে বেরিয়ে আসে রিনিতা। এত বড় আকাশটা র দিকে তাকায়। ভাবে একজন নারী হয়ে সে প্রমাণ করে দিতে পেরেছে মেয়েরা সব পারে…. পারতেই হয়…..
নিজেই নিজেকে আর একবার মনে মনে বলে “শুভ নারী দিবস”।।
সমাপ্ত