“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” লাইনটি আজও প্রাসঙ্গিক
বটু কৃষ্ণ হালদার
সাল ২০১৯, সমগ্র বিশ্ব বাঙালির নোবেল জয়ে উচ্ছ্বাসিত। এর আগে বাঙ্গালী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনুস এর দেখানো পথের দিশায় বিশ্বের অর্থনীতি ব্যাবস্থা আলোর ঠিকানা পেলে ও ভারতবর্ষ রয়ে গেছে প্রদীপের আলোর তলায়। এ আমাদের দেশের এক চরম লজ্জা ছাড়া আর কি হতে পারে?যে সময়ে বাঙালির নোবেল জ্বরে কাঁপছে গোটা দেশ, সে সময়ে ভারতের আর্থিক বেহাল দশার চিত্র সামনে এসেছে,শুধু তাই নয় এমন এক চাঞ্চল্য কর তথ্য সামনে এসেছে যাতে স্তম্ভিত সমগ্র বিশ্ব, বিশ্বের অতি খুদার্থ দেশ গুলির মধ্যে ভারতবর্ষ এক ব্যঙ্গাত্মক নাম। আর এই বর্তমান সময়ে আমরা সবাই অবগত, চেয়ে করোনা ভাইরাসের হানায় সমগ্র বিশ্ব প্রায় লকডাউন। কাজকর্ম ফেলে মানুষ আজ গৃহবন্দি। এই অবস্থায় সাধারণ জনগণের জীবন ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠছে দিন দিন। সাধারণ মানুষকে কাছে পেটের অন্ন টুকু বর্তমানে খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।শুধু ভারত নয় একই পথে হাঁটছে,প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা,আফগানিস্তান, ইউক্রেন,রাশিয়া,পাকিস্তান সহ বহু দেশ।এই সময়ে কবি সুকান্তের কবিতার লাইনটি খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
“খুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। আজও চাঁদের দিকে তাকালে পূর্ণিমার চাঁদটা ঝলসানো রুটি বলে মনে হয়। সভ্যতা উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে।২০১৯ সালে এসেও এত টুকু ও পরিবর্তন হয়নি মানসিকতার। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার এই লাইন দুটিতে ধরা পড়েছিল সমাজের বাস্তব চিত্র।অনাহারে ক্ষুধার জ্বালায় তিনি অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও সমাজকে দিয়ে গেছেন অনেক কিছুই।সভ্যতার সৃষ্টির লগ্ন থেকে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছেন মানুষ। কখনো প্রকৃতির সাথে কখনো মানুষের সাথে। অন্নসংস্থান সহ বস্ত্র ও বাসস্থানের মত অন্যান্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের পর মানুষ সৌন্দর্যচর্চার অবকাশ পায়। মন তার প্রফুল্ল হয় পৃথিবীর আশ্চর্য রূপ আস্বাদনের। তখন প্রকৃতির রূপ রস তার কাছে প্রকাশিত হয় অধিক তর মন মুগ্ধকর রূপে। পৃথিবীটাকে মনে হয় অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি।কিন্তু যখন শুধু বেঁচে থাকার লড়াই হয়ে ওঠে রূপকথার গল্প, জীবন ধারণের জন্য অন্য সংগ্রহ হয়ে পড়ে নিষ্ক্রিয়। ক্ষুধার অসহ্য যন্ত্রণা লোপ পায় সুন্দরকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে আমরা তখনকার সমাজের দুর্ভিক্ষের বিভিন্ন চিত্র পাই।তাতে খাদ্যের জন্য লড়াই যে কি ভীষণ বাস্তব হয়ে ওঠে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষ মানুষের মাংস খেতে শুরু করে,তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পচা নর্দমার জল অমৃতসম মনে হয়। মানুষ হারিয়ে ফেলে সুন্দর-অসুন্দর এর মাঝে পার্থক্য করার বিচার বোধ। অপূর্ব পৃথিবীটা তার কাছে মনে হয় রসহীন গদ্যের মতো।চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে অসহ্য যন্ত্রণাময়।পূর্ণিমার জ্বলজ্বলে চাঁদটাকে মনে হয় অভুক্তের খাদ্যদ্রব্য বহু কাঙ্খিত একটুকরো ঝলসানো রুটি। বর্তমানে ভোগবিলাসী গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সভ্যতা বিপুল সংখ্যক মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছে ক্ষুধার অন্ন। ক্ষুধার যন্ত্রণা সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা।এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ সুকুমারবৃত্তি চর্চার সুখভোগ নষ্ট করে ফেলে ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এমনকি এক পুরুষ নিজের স্ত্রীকে বিকিয়ে দেয় অন্যের বিছানায়, এক মা তার নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয় কিংবা এক নারী তার জীবনকে টেনে নিয়ে যায় পতিতালয়ের ছোট্ট কামরার লাল আলোর রোশনাই এর মাঝে।আজও হাজার হাজার বস্তির অধিবাসী, টোকায় দারিদ্র্যের কোষাঘাতে জীবনধারণের জন্য দুবেলা-দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে পারে না। তাই”নিরন্ন দিন”,”ঘরে ঘরে বুভুক্ষা”দেখে কবির কল্পনা শক্তি হারিয়ে গেছে। তাইতো”অন্ন দে মা অন্নদা”বলে আকুল কান্নায় কেঁদেছিলেন সাধক রামপ্রসাদ।
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী ছিলেন তরুণ উদীয়মান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। জন্ম ১৫ ই আগস্ট ১৯২৬ সালে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,তেতাল্লিশের মন্বন্তর,ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,প্রভৃতি বিষয়ে জ্বলে উঠেছিল তার কলম।১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।সেই বছর “আকাল” নামক একটি কাব্য সংকলন গ্রন্থ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কৈশোর থেকে যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। পরাধীন দেশের দুঃখ-দুর্দশার জনিত বেদনা,শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন শোষিত মানুষের কর্ম জীবন এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম তার কবিতার মূল প্রেরণা।১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতার বেতারের গল্প দাদুর আসর এ যোগদান করেন। সেখানে তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর সেই আসরে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান।গল্প দাদুর আসর এ জন্য সেই বয়সে তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর সেই গান সুর দিয়েছিলেন সেকালের বিখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিক।কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কে আমার মূলত কবি হিসেবে জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন শুধুমাত্র কবি ছিলেন না,সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল তেমনি সুকান্ত ভট্টাচার্য ওই বয়সে লিখেছিলেন কবিতা ছড়া গান গল্প নাটক ও প্রবন্ধ। তাঁর”ছন্দ ও আবৃত্তি” প্রবন্ধ পাঠ এই বেশ বোঝা যায় ওই বয়সে তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিক শুধু আয়ত্তে আনেননি সে বিষয়ে তাত্ত্বিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।
একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোষহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণ সঙ্গী। সংগঠনের কাজে অধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচার করেছিলেন, ম্যালেরিয়া পরে, দুরারোগ্য ক্ষয় ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৯৪৭ সালের ১৩ ই মে। মাত্র ২১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। কলকাতার ১১৯ লাউডট স্ট্রিটের বেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন । তার জীবনের মাত্র ৬/৭ বছর লেখালেখি করেন। স্বল্পপরিসরে লেখালেখি জীবনে ব্যাপ্তির প্রভাব সুদূরপ্রসারী তা বলা বাহুল্য।
বটু কৃষ্ণ হালদার, কবর ডাঙ্গা,কল_১০৪,