* কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন *
—— কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–৬
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
* চতুর্থ দিনের যুদ্ধ *
পরদিন প্রাতে শুরু সেই মহারণ।
পার্থ অভিমুখে ভীষ্ম করেন গমন।।
অশ্বত্থামা, ভূরিশ্রবা, শল্য একসাথে,
করেন যুদ্ধ সকলে অভিমন্যু সাথে।।
শল্য-পুত্র সাথে যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্ন রত।
ধৃষ্টদ্যুম্ন-গদাঘাতে শল্য-পুত্র হত।।
ধৃষ্টদ্যুম্নে শল্য ক্রোধে করেন আক্রমণ।
শল্য-রথ রক্ষিতে রহেন দুর্যোধন।।
রণাঙ্গনে ভীমসেনে আসিতে হেরিয়া,
দশসহস্র গজসেনা আইল ধাইয়া।।
হস্তী যূথ হ’ল হত ভীম-গদাঘাতে।
নৃত্য রত পুলকিত ভীম গদা হাতে।।
সুষেন, সেনাপত্যাদি ভ্রাতা চোদ্দ জন,
ভীমসেনে সকলে করেন আক্রমণ।।
ব্যাঘ্র সম সৃক্কণী করিয়া লেহন,
ভীমসেন সেনাপতিরে করেন হনন।।
হেনরূপে একে একে সবে নিপাতিত।
দুর্যোধন-আনভ্রাতা ভয়ে পলাইত।।
ভীষ্মাদেশে ভগদত্ত উদ্বুদ্ধ তখন,
হস্তী পৃষ্ঠে ভীম সেনে করিতে দমন।।
ভীম সেন অচেতন তাঁর শরাঘাতে,
রথোপরি ভীম সেন ধ্বজদণ্ড হাতে।।
হেরি ঘটোৎকচ ভীম সেনে মূর্ছিত,
সাথেসাথে সেইক্ষণে তিনি অন্তর্হিত।।
মায়াবলে ঘোর মূর্তি করিয়া ধারণ,
আবির্ভূত ঐরাবতে করি আরোহণ।
অনুচর মহাপদ্ম, বামন, অঞ্জন,
আইল তাঁর সাথে ভয়ঙ্কর দর্শন।।
ভগদত্ত হস্তী পৃষ্ঠে করেন আক্রমণ।
ভীত ভগদত্ত-হস্তী করে পলায়ন।।
ভীষ্ম, দ্রোণ ভগদত্তে করিতে তারণ,
আইলে ত্বরা তাঁরে রক্ষার কারণ।।
হেনকালে ঘটোৎকচ করেন গর্জন।
গর্জনে কম্পিত সব ভীত সেনাগণ।।
কহেন ভীষ্ম, “হিড়িম্বা পুত্র দুরাত্মা ঘোর,
উহার সাথে রণিতে নাহি ইচ্ছা মোর।।
শ্রান্ত হয়েছে মোদের বাহন সকল,
ক্ষতবিক্ষত মোরা দুর্বল সেনাদল।।
দিবাকর দিগন্তে করিলেন গমন,
আজিকার মত স্তব্ধ হোক মহারণ”।।
****
* পঞ্চম দিনের যুদ্ধ *
( সাত্যকি পুত্রগণের মৃত্যু )
রাত্রিকালে ভীষ্মে কহেন দুর্যোধন,
পিতামহ কথা এক করি নিবেদন।।
আপনি, দ্রোণ, শল্য সকলে অতিরথ,
কৃপ, অশ্বত্থামা, ভগদত্ত এঁরা মহারথ।।
ত্রিলোক জিনিতে সমর্থ জ্ঞাত সকলে,
প্রস্তুত ত্যজিতে প্রাণ এই যুদ্ধকালে।।
কেন তবে সেনা মম ভুলিয়া শপথ,
রণাঙ্গন ছাড়ি খোঁজে পালাবার পথ।।
পাণ্ডব কুলের দেখি বারেবারে জয়,
যুদ্ধ হেরি পিতামহ লাগে তাই ভয়।।
ভীষ্ম কহেন, রাজা কহিনু বহুবার,
তথাপি কথা তুমি না শুনিলে আমার।
পাণ্ডবের সহিত সন্ধি করহ তুমি,
লভিবে মঙ্গল তুমি ও জগৎ ভূমি।।
পাণ্ডবে করিতে তুমি সদা হীনজ্ঞান।
ফল তার ভগবান করিছেন দান।।
শাঙ্গধর কৃষ্ণ রক্ষা করেন যাঁদের,
কোন কালে কেহ নাহি জিনিতে তাঁদের।।
না শুনিলে কোন কথা তুমি মোহবশে,
আজ তুমি পরিণত মোহগ্রস্ত রাক্ষসে।।
পাণ্ডবগণ রক্ষিত মাধব সহায়,
হইবেই জয়ী তারা নাহি সংশয়।।
প্রাতে ভীষ্ম মকর ব্যূহ করেন রচন।
শোন ব্যূহ রচনা করেন পাণ্ডুপুত্রগণ।।
দুই পক্ষ ভীষণ রণে হইল রত,
সেনা অশ্ব গজ হত কত শত শত।।
সেনাক্ষয় ভাতৃমৃত্যু করিয়া স্মরণ,
আচার্য দ্রোণাচার্যে কহেন দুর্যোধন,
“হে আচার্য, কথা এক করি নিবেদন,
আপনি সুহৃদ মম জ্ঞাত সর্বজন।
আপনি ও পিতামহ এই দুই জন,
সম্মিলিত যবে হার মানে দেবগণ।।
সেখানে পাণ্ডবগণ অতি হীনবল,
তথাপি জীবিত কেন পাণ্ডব সকল।।
ক্রুদ্ধ আচার্য কহেন তুমি অজ্ঞ জন,
তব মুখে হেন কথা নহে অশোভন।।
নির্বোধ তুমি তাদের কর হেয়জ্ঞান।
জয়ী তারা হইবেই সাথে ভগবান।।
জিনিবারে পাণ্ডবেরে নাহি কোন জন।
তথাপি করিব যুদ্ধ আমি প্রাণপণ।।
*
ভীষ্ম করেন যুদ্ধ ভয়ঙ্কর তুমুল।
অশ্ব মরে হস্তী মরে সেনা বিলকুল।।
রণেন ভীষ্ম মহারণ অর্জুন সনে।
চলে যুদ্ধ ভয়াবহ ভীমে দুর্যোধনে।।
দ্রোণ অশ্বত্থামা ও সাত্যকি চেকিতান,
রত সেই মহারণে ল’য়ে ধনুর্বাণ।।
বারিদ হইতে পতিত যেমতি শিলা,
ছিন্ন মুণ্ড সেমতি রণে একি রণলীলা।
সাত্যকির মহাবল পুত্র দশ জন,
ভূরিশ্রবায় করেন বাণ বরষণ।।
ক্রুদ্ধ ভূরিশ্রবা করি ভল্ল নিক্ষেপন,
করেন হত্যা দশে করি শিরশ্ছেদন।।
তাহা হেরি সাত্যকি হন উচাটন।
ভূরিশ্রবায় করেন তিনি আক্রমণ।।
অশ্ব বিনষ্ট দোঁহাকার সুতীক্ষ্ণ বাণে।
তাই যুদ্ধ খড়্গ-ঢালে আর লম্ফদানে।
সাত্যকি রক্ষিতে তথা যান ভীম সেন।
হস্তধরি রথোপরি তাঁরে লইলেন।।
ভুরিশ্রবায় রক্ষিতে এলেন দুর্যোধন।
নিজ রথে তাঁরে তিনি করেন উত্তোলন।।
পঞ্চবিংশতি সহস্র সেনা রথী রথ,
অর্জুন শরাঘাতে তারা সকলে হত।।
অতঃপর সূর্যাস্ত নামিল আঁধার,
রণ ক্লান্ত সকলে ঘোষিত অবহার।।
★★
* ষষ্ঠ দিনের যুদ্ধ *
( ভীমের জয় )
প্রাতে ভীষ্ম ক্রৌঞ্চ ব্যূহ করেন রচন।
মকর ব্যূহ রচেন পাণ্ডু পুত্রগণ।।
ভীষ্ম দ্রোণ, ভীমার্জুন ঘোর যুদ্ধে রত।
শর বর্ষণে পীড়িত সেনা পলাইত।।
শুনিয়া সঞ্জয় মুখে যুদ্ধ বিবরণ,
কুরুপতি ধৃতরাষ্ট্র কহেন তখন,
“বহু গুণ সম্পন্ন সকল সৈন্য মম।
তারা নহেক বৃদ্ধ কিম্বা বালক সম।।
কৃশ নয়, স্থূল নয়, ক্ষিপ্র দীর্ঘ দেহী।
হীনবল অসুস্থ এমন কেহ নাহি।।
শিক্ষিত অস্ত্র প্রয়োগ বাণ নিক্ষেপনে।
নিপুন সবে হস্তী রথ অশ্ব চালনে।।
পরীক্ষিত হ’য়ে সবে নিযুক্ত তখন।
করিনু তুষ্ট প্রদানে সঠিক বেতন।।
আহূত নয়তো কেহই গোষ্ঠী হইতে।
কিম্বা নহে নিযুক্ত বন্ধু মন রাখিতে।।
তাদের নেতা সবাই বিজ্ঞ মহারথী।
তথাপি বিপরীত ফল কেন এমতি।।
মনেতে বোধ দেবগণ পাণ্ডবে সবে।
ঘোর রণ রণি তাই রক্ষা নাহি হবে।।
কহিলেন বিদূর সদা হিত কথন।
মূর্খ পুত্র মম তা না করিল শ্রবণ” ।।
“ভবিতব্য সে নির্দিষ্ট করেন বিধাতা।
যা ঘটিবার ঘটিবে হবে না অন্যথা।।
আপনার দোষেতে হইল দ্যূতক্রীড়া।
ভুগিতে হইবে এবে কর্মফল পীড়া”।।
সঞ্জয় দিব্য চোক্ষে করিয়া দরশন,
বর্ণিতে লাগেন পুন যুদ্ধ বিবরণ।।
রথাবতরি সারথিরে ভীমসেন কন,
গদাযুদ্ধ করি আমি তিষ্ঠ কিয়ৎক্ষণ।।
শত্রু মাঝে ভীমসেন যান গদা হাতে।
মরে হস্তী অশ্ব রথী ভীম গদাঘাতে।।
না হেরিয়া রথে ভীমে উচাটন মন,
ভীম পাশে ধৃষ্টদ্যুম্ন করেন গমন।।
করি দরশন ভীমে পুলকিত মন,
অতঃপর তাঁরে রথে করেন তোলন।।
সভ্রাতা দুর্যোধন করিলে আক্রমণ,
ধৃষ্টদ্যুম্ন ত্যজিলেন অস্ত্র প্রমোহন।।
প্রমোহন অস্ত্র হানে আঘাত ভীষণ।
মূর্ছিত দুর্যোধনাদি বিলুপ্ত চেতন।।
এই অবকাশে ভীম লইয়া বিরাম,
হইলেন তেজোদীপ্ত লভিয়া আরাম।।
দুর্যোধনের হেন গতি করিয়া শ্রবন,
তাঁর পাশে দ্রোণ ত্বরা করেন গমন।।
অতঃপর প্রজ্ঞাস্ত্র করেন নিক্ষেপন।
সেই অস্ত্রে কাটে প্রভাব অস্ত্র প্রমোহন।।
দ্রৌপদী পুত্রগণ যুধিষ্ঠির আদেশে,
করেন গমন ত্বরা ভীমসেন পাশে।।
অভিমন্যু ধৃষ্টকেতু হইলেন সাথী।
কুরু সেনা মাঝে তাঁরা যেথা রথ রথী।।
সূচিমুখ ব্যূহ এক করিয়া রচন,
কুরু সেনা ভেদ করি করিল গমন।।
দুর্যোধন ভীমসেন শরযুদ্ধে রত,
আহত হইল সেনা হত কত শত।।
চলে তীব্র শরযুদ্ধ ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণে,
সেনা কত হইল হত তাহাদের বাণে।।
সক্রোধে ভীমসেন কহেন দুর্যোধনে,
আগত সেই মহাকাল দেখি এক্ষণে।।
বহুকাল ধরি আমি করিনু কামনা,
বধিয়া তোমারে দূরিব মন যাতনা।।
দিয়াছ কষ্ট বনবাসে মাতা কুন্তীরে।
করিয়াছ অপমান তুমি দ্রৌপদীরে।।
সবান্ধবে নাশিব এই করিনু পণ।
কেহ নাহি আজি আর বাঁচাতে জীবন।।
সারথি আহত তাঁর ভীম শরাঘাতে।
রথাশ্বও হইল হত ভীম গদাঘাতে।।
ছিন্ন ধনু দুর্যোধন হারিয়ে চেতন,
সশব্দে ভূতলে তাঁর হইল পতন।।
কৃপাচার্য ত্বরা সেথা করিয়া গমন,
নিজ রথে দুর্যোধনে করেন তোলন।।
অভিমন্যু ,দ্রৌপদীপুত্রের শরজালে,
দুর্যোধন চারি ভ্রাতা ভূপতিত সকলে।।
হইল সূর্যাস্ত তার কিয়ৎক্ষণ পরে,
রহিল তবুও সবে ব্যাপৃত সমরে।।
ক্ষণিক পরে তার ঘোষিত অবহার।
আইলেন সকলে শিবিরে যে যাহার।।
(ক্রমশঃ)