ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য
কবি কৃষ্ণপদ ঘোষ
কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন
৩৭তম উপস্থাপন
২০। কর্ণ বধ
অর্জুন করেন তীব্র বাণ বরিষণ।
আঘাতে কর্ণ-কিরীট করেন ছেদন।।
ছেদিত হলো কর্ণের কনক কুণ্ডল।
দ্বিখণ্ডিত শরাঘাতে কবচ উজ্জ্বল।।
ক্ষত বিক্ষত হলেন কর্ণ সেই রণে।
তবুও অসীম তেজ শক্তি তাঁর মনে।।
বক্ষে তাঁর বিদ্ধ এক লৌহময় বাণ।
সেই বাণে সংশয় হয় তাঁর প্রাণ।।
অতঃপর মুষ্টি তাঁর হইল শিথিল।
ধুম্রজালে আচ্ছাদিল ভুবন নিখিল।।
ক্লান্ত হইয়া ত্যাজেন তিনি ধনুর্বাণ।
শরাচ্ছন্ন হয়ে তিনি হন কম্পমান।।
দরশিয়া কর্ণদশা অর্জুন তখন,
হয়েন শিথিল রণে নাহি থাকে মন।।
হেন হেরি ব্যস্ত কৃষ্ণ হন উচাটন।
পাণ্ডুপুত্র মোহাচ্ছন্ন কেন অকারণ।।
শত্রুরে সুযোগ নাহি দেন বুদ্ধিমান।
হোক সে বিপদগ্রস্ত তবু নেন প্রাণ।।
ত্বরা করি কর্ণে তুমি করহ হনন।
নতুবা পরেতে তুমি করিবে শোচন।।
কৃষ্ণ-বচনে কাটিল অর্জুনের ঘোর।
শরাঘাতে ক্লীষ্ট কর্ণ অতি ঘন ঘোর।।
আসন্ন কর্ণের সেই মরণ সময়।
সেইকালে বিপ্র-শাপ মনেতে উদয়।।
ব্রাহ্মণের শাপে জাগে তাঁর মনে ত্রাস।
মেদিনী করিল তাঁর রথচক্র গ্রাস।।
পরশুরাম-অস্ত্র না হইল স্মরণ।
মেদিনীর গ্রাসে বুঝি হইবে মরণ।।
বিষণ্ণ কর্ণ ভাবিত শুধু সারাক্ষণ,
রক্ষা করে ধর্ম তারে ধার্মিক যে জন।।
আজীবন ধর্ম আমি করিনু পালন।
তথাপি ধর্ম এখন চাহিছে মরণ।।
তারপর কর্ণ শর মোচেন আবার।
অর্জুনের ধনুর্গুণ ছিন্ন বারে বার।।
কৃষ্ণোপদেশে দিব্যাস্ত্র করিয়া গ্রহণ,
অর্জুন উদ্যত তাহে করিতে মোচন।।
কর্ণ-রথচক্র ভূমি আরো করে গ্রাস।
হেরিয়া তাহা কর্ণের মনে ধরে ত্রাস।।
কহিলেন, পাণ্ডুপুত্র তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
রথচক্র গ্রাসে ভূমি কী মন্দ কপাল!!
কাপুরুষ হেন তুমি ত্যাজ তব মন।
বিপন্ন হত্যা অধর্ম কন সাধুগণ।।
তিষ্ঠ ক্ষণকাল তুমি আজি এই রণে।
ধার্মিক ক্ষত্রিয় তুমি রাখিও স্মরণে।।
বিপন্ন কর্ণে কেশব কহেন তখন,
অদৃষ্টের বশে ধর্ম করিছ স্মরণ।।
বিপদেতে ধর্ম চিন্তা করে মূর্খজন।
কুকর্মের নিন্দা কভু করে না তখন।।
সভা মাঝে পাঞ্চালীরে করিলে লাঞ্ছনা।
সেইকালে ধর্ম কথা স্মরণে ছিল না।।
কূট কৌশলী শকুনি পাশা খেলা কালে,
হারাইল যুধিষ্ঠিরে অধার্মিক চালে।।
ধর্ম তব ছিল কোথা ছিলে কেন মূক ?
ধর্মহানি ক’রে তুমি পেলে কত সুখ।।
দুর্যোধনে অনুমতি করিলে প্রদান।
বিষাক্ত খাবার ভীমে করিবারে দান।।
জতুগৃহে পাণ্ডবেরা ঘুমন্ত যখন,
চেয়েছিলে তাহাদের করিতে দহন।।
ত্রয়োদশ বর্ষ পরে পাণ্ডবের রাজ্য,
রাখিলে ধরিয়া তাহা কোন ধর্ম কার্য ?
চক্রব্যূহে সব রথী মহারথ মিলে,
অভিমন্যু বালকেরে তোমরা বধিলে।।
এ হেন কুকর্ম সব করিলে যখন,
ছিল তব ধর্মকথা কোথায় তখন ?
ধর্ম যদি নাহি হয় তখন স্মরণ,
নিজের বিপদে তারে কেন উচ্চারণ ?
তাই ধর্মবাক্যে আর নাহি কোন গতি।
মরণে হইবে আজ তোমার নিষ্কৃতি।।
লজ্জিত হলেন কর্ণ কেশব-বচনে।
রহিলেন ধীরস্থির নির্বাক বদনে।।
অতঃপর ক্রোধে ওষ্ঠ কম্পিত তাঁর।
ধনুতে যোজেন বাণ করিতে সংহার।।
বল্মীকে করে প্রবেশ মহাসর্প যথা,
অর্জুনের বাহু মধ্যে সেই বাণ তথা।।
ঘূর্ণিত মস্তক তাঁর লোচন আঁধার।
পড়িল খসিয়া ভূমে গাণ্ডীব তাঁহার।।
ইতিমধ্যে কর্ণ ভূমে করি লম্ফদান,
রথচক্র উত্তোলনে প্রচেষ্টা আপ্রাণ।।
কিন্তু নাহি নড়ে চক্র কিম্বা তাঁর রথ।
হলেন বিফল কর্ণ ব্যর্থ মনোরথ।।
ক্ষণিক পরে অর্জুন লভিয়া চেতন,
বধিতে ক্ষুরপ্র বাণ করেন ক্ষেপন।।
সেই বাণে রথ-ধ্বজ ভূমিতে পতিত।
উজ্জ্বল লাঞ্ছন রজ্জু হ’য়ে দ্বিখণ্ডিত।।
তারপর তূণ হ’তে করি নিষ্কাষণ,
অঞ্জলিক বাণ গুণে করেন যোজন।।
যমদণ্ড তুল্য সেই বজ্র মহাবাণ।
গাণ্ডীবে যোজিত তাঁর লইবারে প্রাণ।।
প্রণমিয়া ধনুর্বাণে অর্জুন তখন,
কহিলেন, যাগ-যজ্ঞে থাকে যদি মন,
মোর কর্মে তুষ্ট যদি হন গুরুজন,
এই বাণ কর্ণ-প্রাণ করিবে হরণ।।
হেন কহি সেই বাণ করেন ক্ষেপন।
সেই বাণ কর্ণ-শির করিল ছেদন।।
রক্তরাগ দিবাকর যথা অস্তাচলে,
ছেদিত কর্ণ মস্তক সেমতি ভূতলে।।
তেজজ্যোতি এক ক্ষিপ্ত সূরয মণ্ডলে।
কর্ণ দেহ ত্যাজিলেন হেরিল সকলে।।
ধ্বনিত শঙ্খের ধ্বনি পাণ্ডব মাঝারে।
বিষাদগ্রস্ত কৌরব মগ্ন হাহাকারে।।
★
( চলবে )