সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শিল্প জীবন *অশেষ গাঙ্গুলী*
প্রত্যেক বাঙালির কাছে একজন জনপ্রিয় ব্যাক্তি হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । তিনি সিনেমা জগতের একজন উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। আট থেকে আশি সমস্ত বয়েসের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় এবং কাছের। তিনি অভিনয়’টি যথেষ্ট দক্ষতার সাথেই করতেন।
তিনি প্রত্যেক সিনেমাতে চরিত্র গুলো এতটা নিখুঁত করতেন যে চরিত্র গুলো জীবন্ত হয়ে উঠতো। তিনি গোয়েন্দা চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, এবং দক্ষতার সাথে চরিত্রটি ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি কখনও নায়ক চরিত্রে আবার কখনও খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করে চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। আবার কখনো নায়ক বা নায়িকার পিতার চরিত্রে অভিনয় করে চরিত্রটিকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর জীবন দ্বারা সমাজকে বার্তা দিতে চেয়েছেন। তিনি সিনেমায় যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন তা তিনি খুব সাবলীল ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি শুধু সিনেমা জগতেই নয়, সাহিত্য জগতেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি আবৃত্তি শিল্পী হিসাবে পরিচিত ছিলেন সবার কাছে।
তিনি একদিকে যেমন কবি অন্যদিকে অনুবাদকও ছিলেন। তিনি যাএা, নাটক, টিভি সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন। প্রত্যেক ক্ষেত্র দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি যেমন নাটকে অভিনয় করেছেন তেমনি তিনি নাটক লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন। 1959 সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম ‘অপুর সংসার ‘ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু সিনেমাতে পার্শ্বচরিএে অভিনয় করেছেন। সে ক্ষেত্রেও তিনি সুন্দর অভিনয় দ্ধারা ফুটিয়ে তুলেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সুদীর্ঘ ষাট বছর চলচ্চিত্র জগতে বিচরণ করেছেন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনশোর বেশি সিনেমা করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। 1960 সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘ ক্ষুধিত পাষাণ ‘ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। 1961 সালে সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করেন। ‘ তিন কন্যা’ সিনেমাতে অর্পণা সেনের বিপরীতে তিনি অভিনয় করেন। তপন সিংহের ‘ ঝিন্দের বন্দি’ সিনেমাতে খলনায়ক হিসাবে অভিনয় করেন, উওম কুমারের সাথেও অভিনয় করেছেন । সেখানেও তিনি চরিত্রটিকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। সে সময় শ্রেষ্ঠতার বিচারে উওম কুমারের সাথে তাঁকে নিয়ে বিভক্ত ছিল। 1961 সালে মুক্তি প্রাপ্ত ‘ পুনঃশ্চ ‘ চলচ্চিত্রে মৃণাল সেনের পরিচালনায় অভিনয় করেন। সেই সিনেমাতে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেন। 1961 সালে অজয় করের পরিচালনায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ‘সাত পাকে বাধা ‘ সিনেমাতে খুব দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থিয়েটারের প্রতি আজন্ম ভালোবাসা ছিল। সোনার কেল্লা দৃশ্যায়নের সময় এক স্থানে দ্রুত দৃশ্যায়ণ করা হয়, যেন পরবর্তীতে তিনি কলকাতায় ফিরে থিয়েটারে অভিনয় করতে পারেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সর্বপ্রথম সিনেমা ‘ অপুর সংসার ‘ । সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমাতে অভিনয় করেন এবং শর্মিলা ঠাকুরের বিপরীতে । সত্যজিৎ রায়ের সাথে তিনি 14 টি সিনেমা করেন।সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সিনেমাতে বিভিন্ন চরিত্রে আর্বিভূত হন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিছু কিছু সিনেমা দেখে মনে হয় যেন তাকে মাথায় রেখে গল্পটি লেখা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের দ্বিতীয় শেষ চলচ্চিত্র ‘ শাখা – প্রশাখা ‘তেও তিনি অভিনয় করেন। তাঁর চেহারা দেখে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন ” তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথ ” অনেকের মতে তিনি সত্যজিৎ রায়ের মানসপুত্র ছিলেন । সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে ‘ মানিকদার সঙ্গে ‘ নামে একটি বই লিখেছিলেন। তাঁর রচিত ইংরেজি অনুবাদটির নাম ‘ দ্যা মাষ্টার অ্যান্ড আই ‘।
তাঁর অভিনীত চরিত্র গুলোর ভিতরে সবথেকে জনপ্রিয় হল ফেলুদা। তিনি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘ সোনার কেল্লা ‘ এবং ‘ জয় বাবা ফেলুনাথ ‘ ছবিতে ফেলুদা ভূমিকায় তার চেয়েও ভালো কাউকে নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তাঁর অভিনীত ফেলুদার প্রথম ছবি করতে পারতেন না।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ অপুর সংসার ‘ এটি অপু এয়ীর শেষ চলচ্চিত্র। এরপর তিনি সত্যজিৎ রায়ের সাথে একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিন কন্যা ( 1961), অভিযান ( 1962), চারুলতা ( 1964), অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত ( 1973), সোনার কেল্লা ( 1974), জয় বাবা ফেলুনাথ ( 1978), হীরক রাজার দেশে ( 1980), ঘরে – বাইরে ( 1984), ও গণশত্রু ( 1989)। পাশাপাশি তিনি অন্যান্য বাঙালি পরিচালকের সাথেও কাজ করেছেন
মৃণাল সেনের সাথে’ আকাশ কুসুম ‘ ( 1965), তপন সিংহের সাথে ‘ ক্ষুধিত পাষাণ ‘ ( 1960) ও ‘ ঝিন্দের বন্দী ‘ ( 1961), অজয় করের সাথে ‘ সাত পাকে বাধা ‘ (1963), পরিণীতা ( 1969) এবং তরুণ মজুদারের সাথে ‘ সংসার সীমান্তে ‘ ( 1975), ও ‘গণদেবতা ‘ ( 1978), ‘ Patalghar ‘ ( 2003)।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত / নির্দেশিত বিখ্যাত নাটক 1969 খ্রী ঃ ” তাপসী ” 1978 খ্রীঃ ‘ ‘ ‘নামজীবন ‘ , 1983 খ্রীঃ রাজকুমার, 1987 খ্রীঃ ফেরা , 1988 খ্রীঃ নীলকন্ঠ, 1990 খ্রীঃ ঘটক বিদায়, 1992 খ্রী ঃ দর্পণে শরৎশশী, 1994 খ্রীঃ চন্দনপুরের চোর, 1996 খ্রীঃ টিকটিকি, 1988 খ্রীঃ প্রাণ তপস্যা প্রভৃতি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বরচিত কিছু বই আছে যে গুলি খুব জনপ্রিয় – শ্রেষ্ঠ কবিতা ( 1993), মানিকদার সঙ্গে ( 2 0 14 ), পরিচয় ( 2013), অগ্রপথিকেরা ( 2010), প্রতিদিন তব গাঁথা ( 2009), চরিত্রের সন্ধানে ( 2004) শব্দরা আমার বাগানে, কবিতা সমগ্র ( 2014), মধ্যরাতের সংকেত ( 2012), নাটক সমগ্র -;1 ( 20 15 ) , নাটক সমগ্র – 2 ( 2017)
প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান 1991 সালে অন্তর্ধান চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষ জুরি বিভাগে। 9 বছর পরে দেখা চলচ্চিত্রের জন্য একই বিভাগে পুরস্কার পান। অভিনয় জীবনের সুদীর্ঘ পাঁচ দশক পর 2006 সালে পদক্ষেপ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সম্মানিত হন। 2012 সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
2004 সালে ‘ পদ্মভূষণ ‘ সম্মানে ভৃষিত হন । এরপর 2012 সালে ‘ সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ‘ পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর কয়েক বছর পর ফরাসি সরকারের দেওয়া সম্মান ‘ লেজিয়ঁ দ্য নর এবং লেজিয়ঁ দ্য নর’ এবং ‘কম্যান্দর দ্য লার্দ্র দে আর্ত্ এ দে লের্ত্র’-এ ভূষিত হন তিনি। 2017 সালে বঙ্গবিভূষণ , পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
2020 সালের 15 ই নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন।