Spread the love
আজ আমার কলমে গল্প 
                সম্পর্ক 
       সোনালী  মুখার্জী
কলিং বেলের শব্দে দৌড়ে গিয়ে দরজা টা খুলে ছন্দা দেখে পাশের বাড়ির মইদুল আলী দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।
ঈদ মোবারক বহিনজি
হ্যাঁ ভাইজান ঈদ মোবারক।
কেমন আছেন?আসুন ঘরে, 
মেহের কি করছে রান্না করছে বুঝি?
হ্যাঁ আর বলো না বহিন জী  আজ ঈদের দিন  কত খুশির দিন   কিন্তু দেখো এই লকডাউন এর জন্য কাউকে দাওয়াত দিতে পারলাম না তাই  নিজেরাই পালন করছি ঘরে বসে । শুধু আমার চাচা আর  চাচী  এসেছেন পাশের পাড়া থেকে জানো তো ওদের কোনো সন্তান নেই আমাকে ওরা সন্তানের মত ভালবাসে। তাই চাচি লকডাউন উপেক্ষা করেই আমার কাছে এসেছে তাই আজ আর বসবো না। আমি চলি ,  ও হ্যাঁ মেহের বলছিল ওই বাটি টা  তোমাদেরই… তুমি যে কিছুদিন আগে তোমার সত্যনারায়ণের প্রসাদ দিয়েছিলে না ? ওটাতে করেই সিমুইয়ের  পায়েস টা দিয়েছে। আমি আসছি ,আর আমার পিকলু বাবা কেমন আছে?
ভালো আছো ভাইজান ওতো আপনার জন্যই বেঁচে আছে।
এভাবে বলোনা বহীন জী  আমরা তো মানুষ … এসবই আল্লাহর খেলা ..যাক আমি আসি.. সাবধানে থেকো। বলে মইদুল ভাই  চলে যান।
দরজা বন্ধ করে খাবারগুলো এনে টেবিলের ওপর রাখে ছন্দা। 
পিকলু দৌড়ে আসে বলে মা কে  এসেছিল?
ছন্দা বলে ও বাড়ি থেকে তোর মামা এসেছিল । সবার  জন্য খাবার দিয়ে গেল ।টেবিলে আছে চল তোকে খাবারটা দিই।
টেবিলে বসে পিকলু কে খেতে দিয়ে ছন্দা  হারিয়ে যায় তিন বছর আগে র একটা ঘটনা র আবর্তনে। কিভাবে সেদিন ওরা পরিস্থিতি সামলে ছিল আজও ভাবলে মনের ভিতরটা ছটফট করে ওঠে। সেদিন যদি এই মানুষটা পাশে না থাকতো কি হতো তার জীবনটা য়।
তখন পিকলু মাত্র পাঁচ বছরের, সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে । স্কুল বাসে যাতায়াত করছে হঠাৎ করে স্কুল থেকে খবর আসে ওদের বাস টা  একসিডেন্ট করেছে ।এবং কিছু বাচ্চা গুরুতর আহত.. তার মধ্যে তাদের পিকলু ও আছে ।পাগলের মত ছুটে যায় ছন্দা স্কুলে, ওর বাবা বারীন বাবু তখন অফিসে, কোনমতে বারীন বাবু কে  ফোন করে ঘটনাটা বলে সাথে সাথে স্কুল থেকে বলা হসপিটালে পৌঁছে যায়  ছন্দা।
গিয়ে দেখে পিকলু কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । হসপিটাল কর্তৃপক্ষ জানালেন ব্লাড লাগবে প্রচুর রক্তক্ষরণ  হয়েছে। ও এখনো হচ্ছে। ছন্দা  পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে। ওর রক্তের গ্রুপ ছাড়া অন্য কোন গ্রুপ ওর কাজ করবে না। কি করবে? কোথা থেকে পাবে রক্ত ?
ছেলেটা একটা বিরল রক্তের গ্রুপ নিয়ে জন্মেছে ছন্দা  বা বারীন  কারোরই এই গ্রুপ নয়। হসপিটালে ও এই গ্রুপের রক্ত নেই ।ছন্দা পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে থাকে।বার বার বারীন কে ফোন করতে থাকে।বারীন ও রাস্তায় যতটা পারে ফোনে ফোনে চেষ্টা করে রক্ত জোগাড় করার।কিন্তু বিফল হয় প্রতিবার।
এমন সময় হঠাৎ দেখে মইদুল কে । ও এই হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়। ওইভাবে ছন্দা কে কাঁদতে দেখে এগিয়ে আসে। বলে কি হয়েছে ভাবিজি?আপনি  কাঁদছেন কেন? আপনি তো আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন.. আমি দেখেছি আপনাকে …যাতায়াতের পথে.. কি হয়েছে ?
শুনে ছন্দা  যেন একটা কূলকিনারা পায় ।তখনও পর্যন্ত বারীন  এসে পৌঁছয় নি। জ্যামে আটকে গেছে রাস্তায়। এখন এক একটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে যেনো এক একটা যুগ ।
এই সময় চেনা পরিচিত একটা মুখ অনেক ভরসা যোগায় ।মইদুল কে সব খুলে বলে ছন্দা। এবং ছেলের রক্ত যে O-    এটাও বলে। এদিকে ডক্টর রা  বারবার তাড়া লাগাচ্ছে অপারেশন টেবিল থেকে এক্ষুনি দরকার রক্ত। কি হবে ওরা আধঘন্টা সময় দিয়েছে…
 কি করবো এই সময়ের মধ্যে কোথায় পাবো এই গ্রুপের রক্ত ? কি করে বাঁচাবো আমার পিকলু কে?
ছন্দা কাঁদতে কাঁদতে মইদুল কে  সমস্ত খুলে বলে।
মইদুল সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় যেখানে পিকলুর অপারেশন হচ্ছিল সেখানে ।গিয়ে ডাক্তারকে বলে  আমার রক্তের গ্রুপ O-   প্লিজ আমার রক্ত নিন  ডাক্তারবাবু ওকে বাঁচিয়ে দিন পিকলু বাবাকে বাঁচিয়ে দিন ।
ডাক্তার বাবু অবাক হয়ে মঈদুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন …বলেন তুমি দেবে? তুমি রক্ত দেবে?
 হ্যাঁ ডাক্তারবাবু আমি দেবো… কেন দেব না? একটা ছোট বাচ্চা রক্তের অভাবে বাঁচবে না ..আর আমি সেই রক্ত থেকেও দেব না ..শুধুমাত্র ও হিন্দুর ছেলে বলে ? আমি আল্লাহর কাছে  গিয়ে কি জবাব দেবো বলুন??
না ডাক্তার বাবু আমি হিন্দু মুসলমান মানি না …আমি মানুষে বিশ্বাস করি… মানুষের জন্য কাজ করি..  মানুষের সম্পর্কে সম্পর্কিত হই ..চলুন ডাক্তারবাবু আর দেরি করবেন না ।
ডাক্তার বাবু মইদুল কে নিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যান এবং লালবাতি টা   জ্বেলে দেন বাইরে।
প্রায় ঘণ্টা তিনেক বাদে পিকলুর জ্ঞান ফিরে আসে এবং সে মা বলে ডাকে। ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ছন্দা ।ডাক্তারবাবু বলেন সব বিপদ কেটে গেছে সময়মতো রক্ত টা না পেলে খুব ক্ষতি হয়ে যেত ।
অবাক হয়ে ডাক্তার বাবুকে জিগ্যেস করে ছন্দা  কে  দিল ডাক্তার বাবু? রক্ত ?
ডাক্তারবাবু মইদুল কে দেখিয়ে বলে …এইতো .. ইনি  দিয়েছেন। এনার জন্য আমার সত্যিই গর্ব হচ্ছে । ইনি আমাদের হাসপাতালের স্টাফ। সত্যিই অনেক বড় একটা কাজ করলেন উনি একজনের জীবন বাঁচালেন। বলে ডাক্তার বাবু চলে যান।
ছন্দা ছুটে এসে মঈদুলের পা দুটো জড়িয়ে ধরে ।বলে ভাইজান আপনি না থাকলে আমার ছেলেটা আর বাঁচতো  না। আপনার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না ।মইদুল হাসতে হাসতে বলে ওঠো বোহিন জী । কে বলল তুমি ঋণ শোধ করতে পারবে না? ভাই বোনের ঋণ কি  শোধ হয়? আমাকে ভাইজান বলে ডাকলে তুমি আমার বহিন ।এই সম্পর্কটাই আমাদের আরো শক্ত করুক আরো দীর্ঘ করুক ।ছেলের কাছে চলো।
ততক্ষনে বারীন ও এসে গেছে । সব কিছু শুনে মইদুলের কাছে বার বার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।মইদুল ও বারীন একে অপরকে  জড়িয়ে ধরে।
তারপর প্রায় একসপ্তাহ পিকলু ওই হাসপাতালেই থাকে।এই সময় মইদুল আর তার স্ত্রী মেহের কিছুতেই তাদের রান্না করে খেতে দেয়নি ।এই কদিন ওরাই সমস্ত কিছু করেছে ।এতে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কটা একটা বন্ধন এ পরিণত হয়েছে ।সেই বন্ধন টা হিন্দু-মুসলিমের নয়, এটা মানবতার বন্ধন।  ভালোবাসার বন্ধন ।যেটা হয়তো দুই পরিবারের মধ্যে সারা জীবন থেকে যাবে এইভাবে ই।
              সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *