ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য
★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★
কাব্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ২৫
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
।। দ্রোণবধ পর্বাধ্যায়।।
১৮। দ্রুপদ – বিরাট বধ
দুর্যোধনের বাল্য স্মৃতি।
[পঞ্চদশ দিনের যুদ্ধ]
ভয়ানক সেই রণ নিশীথ দুপুর।
রণক্লান্ত সেনাদল সবে নিদ্রাতুর।।
ত্যাজি অস্ত্র কেহ ব্যস্ত করিতে শয়ন।
কেহ কেহ হস্তী পৃষ্ঠে ঘুমেতে মগন।।
অনেকে নিদ্রান্ধ প্রায় বিলুপ্ত চেতন।
শত্রু বোধি স্বপক্ষকে করিছে হনন।।
অর্জুন হেরিয়া হেন কন উচ্চৈঃস্বরে,
“আচ্ছাদিত রণভূমি ধূলি অন্ধকারে।।
রণক্লান্ত নিদ্রাতুর সব সেনাগণ।
ত্যাজি অস্ত্র নিদ্রা যাও সকলে এখন।।
চন্দ্রোদয় হবে যবে সকলেই শুন।
আমাদের যুদ্ধ শুরু হইবেক পুন”।।
হেন বচনে সকল কুরু-সেনাগণ,
উচ্চ রবে তারা সবে কহিল তখন।।
“ত্যাজি অস্ত্র যুদ্ধ ক্ষান্ত হইলাম এবে।
রণাঙ্গনে নিদ্রা যাও সকলে নীরবে”।।
নিদ্রাচ্ছন্ন হয় সবে সব সেনাগণ।
হেরি বোধ শিল্পী দ্বারা হয়েছে চিত্রণ।।
হেনরূপে কিছুকাল স্তব্ধ রণাঙ্গন।
শব্দহীন মৃত্যুপুরী ভয়াল ভীষণ।।
উদিলেন চন্দ্রদেব পূরব গগনে।
মৃদু হাস্য রয় যথা বধুর বদনে।।
আলো তাঁর মুছে দেয় গভীর আঁধার।
সেনাগণ তৈরী সবে যুদ্ধে পুনর্বার।।
কহিলেন দ্রোণাচার্যে হীন দুর্যোধন।
“গুরুতর কথা এক করুন শ্রবণ।।
অবসন্ন শত্রু সব লইল বিশ্রাম।
নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে তারা লভিল আরাম।।
লক্ষ্যরূপে পাইয়াও করিনি হনন।
মুখ চাহি আপনার করিনি নিধন।।
লভিয়া আরাম তারা হলো বলবান।
আমাদের শক্তি তেজ ক্রম হ্রাসমান।।
ত্রিভুবন জয়ে শক্তি আছে আপনার।
তবুও পাণ্ডবে ক্ষমা কেন বারবার”।।
কহিলেন দ্রোণ, “আমি স্থবির এখন।
তথাপি কৌরব লাগি যুঝি প্রাণপণ।।
এর পর কহ তুমি কিবা করি আমি।
যুদ্ধ জয় সংশয় জেনে রাখ তুমি।।
লভিবারে জয় আমি করি কার্য হীন।
হোক ভালো কিম্বা মন্দ করিবে এ দীন।।
আমি দ্রোণ অস্ত্রগুরু এই করি পণ।
সমস্ত পাঞ্চালে আমি করিব নিধন।।
একজনও জীবিত রবে যতক্ষণ,
করিব না আমি মোর এ বর্ম মোচন।।
*
রাত্রির তিন মুহূর্ত অবশিষ্ট আর।
সেই ক্ষণে যুদ্ধ শুরু হলো পুনর্বার।।
বিভক্তিয়া কুরুসেনা দুই ভাগে ভাগ,
অবতীর্ণ দ্রোণ রণে ল’য়ে একভাগ।।
উদিলেন পুবাকাশে সূরয নবীন,
ক্রমে ক্রমে চন্দ্রপ্রভা হইল মলিন।।
বিরাট, দ্রুপদ দোঁহে একসাথে রণে,
করিলেন আক্রমণ নাশিবারে দ্রোণে।।
দ্রুপদের তিন পৌত্র হত দ্রোণ-শরে।
কেকয় সৃঞ্জয় চেদি বিজিত সমরে।।
হেনরূপে চলে রণ আর কিছু ক্ষণ।
বিরাট দ্রুপদ পরে হইল নিধন।।
ভীমসেন উগ্রবাক্যে ধৃষ্টদ্যুম্নে কন,
“হলো তব পিতা আর ত্রিপুত্র হনন।।
দ্রুপদ বংশে করি জনম গ্রহণ,
করিলে উপেক্ষা তুমি শত্রুরে নিধন”।।
এতেক কহিয়া ভীম হন যুদ্ধে রত।
ধায়িলেন শত্রু প্রতি করিবারে হত।।
★
সাত্যকিরে হেরি কন ধূর্ত দুর্যোধন,
“পরস্পরে করি রণ কেন অকারণ।।
বাল্যকালে তুমি ছিলে বন্ধু প্রিয়জন।
আজ তারে নাশিবারে করি মহারণ।।
বাল্যকালে প্রিয় ছিলে প্রিয় প্রাণাধিক।
আজ রণে হীন মনে ক্ষত্রধর্মে ধিক।।
কোথা গেল সেই ক্রীড়া গুরুর অঙ্গনে।
ক্রোধ লোভে মোরা আজ এই রণাঙ্গনে।।
রাজ্য লোভে ধন লোভে রণ অকারণ।
কহ সখা সেই ধনে কিবা প্রয়োজন।।
দুর্যোধন-বাল্যস্মৃতি করিয়া শ্রবণ,
করিয়া হাস্য সাত্যকি দুর্যোধনে কন,
“এ নহে সেই মণ্ডপ কিম্বা গুরুগৃহ।
তুমি আমি শত্রু আজ বন্ধু নয় কেহ।।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম এই জানে সর্বজন।
রণক্ষেত্রে গুরুরেও করিবে নিধন।।
হই যদি তব প্রিয় শোন দুর্যোধন।
যথাশীঘ্র তুমি মোরে করহ হনন।।
ত্যাজি প্রাণ পুণ্যলোকে করিব গমন।
হেরিতে মিত্র-বিপদ নাহিক মনন”।।
এতেক কহি সাত্যকি হলেন ধাবিত।
ব্যাঘ্র হস্তী সম দোঁহে হন যুদ্ধ রত।।
★★★★
১৯। দ্রোণের ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ।
পাণ্ডবসেনা নিয়ত হত দ্রোণ-শরে।
হেরিয়া কৃষ্ণ অর্জুনে কহিলেন পরে।।
“দ্রোণ হস্তে যদি থাকে তাঁর ধনুর্বাণ।
দেবগণের অসাধ্য লইবারে প্রাণ।।
ত্যাজিলে অস্ত্র তাঁহার কভু তিনি রণে,
বধিতে পারেন তাঁরে অতি সাধারণে।।
জিনিবারে দ্রোণে কর আজ পন্থা স্থির।
অন্যথায় বধিবেন দ্রোণ মহাবীর।।
শোন পন্থা কহি আমি হলো যাহা মনে।
ত্যাজিবেন অস্ত্র তিনি এই মহারণে।।
ত্যাজিয়া অস্ত্র হবেন সমরে বিরত।
কেহ যদি কহে তাঁরে ‘অশ্বত্থামা হত’।।
অতএব কেহ যাও কহিবারে দ্রোণে।
অশ্বত্থামা আজি হত হইয়াছে রণে”।।
হেন প্রস্তাবে অর্জুন কন ক্ষুন্ন মনে,
“অসত্য বচন তাঁরে কহিব কেমনে”।।
হেন অর্জুন-বচন করিয়া শ্রবণ,
পাণ্ডবগণে কেশব কহেন তখন,
“আছে বড় হস্তী এক অশ্বত্থামা নামে।
সে হস্তী মালবরাজ ইন্দ্রবর্মা ধামে।।
সর্বাগ্রে সেই হস্তীরে করহ নিধন।
তারপর দ্রোণ পাশে করহ গমন।।
অতঃপর দিও তাঁরে খবর মরণ।
মিথ্যা কথা নহে ইহা আমার বচন”।।
ভীম যান হানিবারে অশ্বত্থামা হাতি।
গদাঘাতে হলো হত সেই বড় হাতি।।
তারপর দ্রোণ পাশে যেথা যুদ্ধ রত।
কহিলেন জোরে তিনি “অশ্বত্থামা হত”।।
ভীম-মুখে হেন বাক্য করিয়া শ্রবণ,
বিচলিত দ্রোণ অতি শোকাকুল মন।।
কিন্তু পুত্রের বীরত্বে অগাধ বিশ্বাস।
তাই নিজ মনে তিনি দিলেন আশ্বাস।।
ভীমবাক্যে তাই তিনি তবু অবিচল।
রত রন নাশিবারে পাণ্ডু সেনা দল।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণে চলে যুদ্ধ ভয়ঙ্কর।
দোঁহাকার শরজালে ভীষণ সমর।।
বিনষ্ট হইল শরে ধৃষ্টদ্যুম্ন-রথ।
লইলেন তাঁরে রথে ভীম মহারথ।।
রথে তুলি ভীমসেন ধৃষ্টদ্যুম্নে কন,
“আচার্য করেন যুদ্ধ অতীব ভীষণ।।
বধিতে আচার্যে এবে কেহ নাই আর।
তুমিই পারিবে চেষ্টা কর আরবার।।
করিলেন দ্রোণাচার্য ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ।
হাজার হাজার সেনা তাহাতে বিয়োগ।।
হত কত শত শত রথী মহারথ।
হস্তী অশ্ব নষ্ট কত কত শত রথ।।
হেনকালে উপস্থিত নানা মুনিগণ।
দ্রোণ পাশে সূক্ষ্ম দেহ করিয়া ধারণ।।
কহেন দ্রোণে,”ব্রহ্মাস্ত্র কেন অকারণ।
হাজির হয়েছে তব সময় মরণ।।
অকারণে এই অস্ত্র করিলে ক্ষেপণ।
ব্রহ্মাস্ত্র-অজ্ঞানে কর ব্রহ্মাস্ত্রে নিধন।।
হেন পাপ কর্ম কভু নাহি কর আর।
অবিলম্বে এই অস্ত্র কর পরিহার।।
ত্যাজি অস্ত্র ক্ষুন্ন দ্রোণ হলেন বিরত।
মনে দ্বিধা অশ্বত্থামা জীবিত না মৃত।।
যুধিষ্ঠির পাশে তিনি করেন গমন।
নিশ্চিত স্থির করিবে সে সত্য জ্ঞাপন।।
ত্রিলোকের সম্পদও করিলে অর্পণ,
যুধিষ্ঠির নাহি কহে অসত্য বচন।।
এই ছিল তাঁর মনে অগাধ বিশ্বাস।
শুধালেন যুধিষ্ঠিরে মনেতে আশ্বাস।।
উদ্বিগ্ন হয়ে কেশব যুধিষ্ঠিরে কন,
“অর্ধদিন দ্রোণ আর যদি করে রণ,
সমস্ত পাণ্ডবসেনা হইবে নিধন।
রক্ষিতে পাণ্ডবে দিন অসত্য ভাষণ।।
নিজ প্রাণ রক্ষা লাগি অসত্য আলাপ,
দোষ নয় তাহে কভু নাহি হয় পাপ”।।
অতঃপর যুধিষ্ঠির কহিলেন জোরে,
“অশ্বত্থামা হত”, ‘ইতি গজ’ মৃদুস্বরে।
যুধিষ্ঠির-মুখে হেন করিয়া শ্রবণ,
বিচলিত দ্রোণ অতি শোকাকুল মন।।
সাগর জলে গলিত বালুভূমি যথা।
হেন বাক্যে অবসন্ন দ্রোণ অঙ্গ তথা।।
পুত্রমৃত্যু সংবাদে দ্রোণ মুহ্যমান।
যুঝিবারে ব্যর্থ তিনি ল’য়ে ধনুর্বাণ।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন শর তাঁর করেন সন্ধান।
রোধিবারে দ্রোণ তাহে সচেষ্ট আপ্রাণ।।
খুঁজিলেন যোগ্য অস্ত্র রোধিতে মরণ।
কিন্তু সে অস্ত্রের নাহি হইল স্মরণ।।
গমিয়া দ্রোণ সকাশে ভীম ধীরে ধীরে।
করিলেন ভর্ৎসনা দ্রোণ মহাবীরে।।
“ত্যাজিয়া স্বধর্ম কেন পর ধর্মাচার।
এর চেয়ে নীচ কর্ম নাই কোন আর।।
ব্রাহ্মণ হইয়া কেন ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি।
স্ব-বৃত্তির অপমানে হইল প্রবৃত্তি।।
নীচ ব্রাহ্মণ হইল কেন হেন মতি।
করিলেন পাপ কর্ম হইবে দুর্গতি।।
শুধু শুধু অকারণে আর কেন রণ।
প্রিয় পুত্র রণভূমে করিয়া শয়ন।।
অশ্বত্থামা হত আজ নাহি সংশয়।
ধর্মরাজ বাক্য ইহা কভু মিথ্যা নয়”।।
হেন বচন তখন করিয়া শ্রবণ,
সব অস্ত্র দ্রোণ তাই করেন বর্জন।।
কহিলেন কর্ণ, কৃপ, কৃত, দুর্যোধনে,
“করহ যুদ্ধ তোমরা সবে প্রাণপণে”।।
এই কহি রণস্থলে হলেন যোগস্থ।
ধাবিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন হয়ে অসি হস্ত।।
হেরিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নের মূর্তি সংহার।
উভয় পক্ষের সেনা করে হাহাকার।।
যোগমগ্ন দ্রোণ তাঁর ভয় হীন প্রাণ।
নিমীলিত নেত্রে ধ্যানে মগ্ন মন প্রাণ।।
ব্রহ্মরূপ ওম্ মন্ত্র করিয়া স্মরণ,
ব্রহ্মলোক পথে তিনি করেন গমন।।
দেহ হতে দিব্যজ্যোতি হইল নির্গত।
অতি দ্রুত উল্কাসম হয় অন্তর্হিত।।
এ যাত্রা পঞ্চজনার দৃষ্টিলব্ধ হয়।
কৃষ্ণ, কৃপ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, সঞ্জয়।।
হেরি দ্রোণে অস্ত্রহীন রথোপরি বসি।
ধাবিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন হাতে ল’য়ে অসি।।
ধনঞ্জয় ধৃষ্টদ্যুম্নে করেন বারণ।
ধ্যানমগ্নে হত্যা কেন কর অকারণ।।
তবু ক্রুদ্ধ ধৃষ্টদ্যুম্ন করেন গমন।
দ্রোণাচার্য-কেশ হস্তে করেন ধারণ।।
তারপর মুণ্ড তাঁর করেন ছেদন।
হেরি তাই সেনাকুল আতঙ্কিত মন।।
শূন্যে ঘূর্ণিত করিয়া তরবারি তাঁর,
ধৃষ্টদ্যুম্ন ব্যাঘ্রনাদ করেন আবার।।
তারপর দ্রোণমুণ্ড করি উত্তোলন,
কুরুসেনা মাঝে তাহা করেন ক্ষেপণ।।
দ্রোণহীন কুরুগণ ভগ্ন মনোবল।
খুঁজিলেন দ্রোণ-দেহ সারা রণস্থল।।
হইলেন ব্যর্থ বহু কবন্ধ মাঝার।
না পাইলেন দর্শিতে দেহটি তাঁহার।।
ধৃষ্টদ্যুম্নে ভীম কন করি আলিঙ্গন,
“কর্ণ দুর্যোধনে যবে করিবে হনন,
সেইদিন সেনাপতি করহ শ্রবণ,
তোমারে করিব আমি পুন আলিঙ্গন”।।
হেন কহি ভীম করি ভূতল কম্পিত,
হৃষ্টচিত্তে তাল ঠুকে হন নৃত্যরত।।
★★★
(চলবে)