মহাজাগতিক দৃষ্টিকোন দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে,২০১৮ সালের শেষ দিকটা ভারত মা একে একে হারাচ্ছেন খ্যাতির শীর্ষে থাকা সন্তানদের।বিরল দৃষ্টান্ত নজির,একে একে অন্যতম মহা জ্যোতিষ্কদের ছন্দপতন ঘটে চলেছে নিরন্তর। আর আমরা হারিয়ে ফেলছি মাইলফলক স্টোন গুলিকে। নিয়মের গণ্ডি শিখরের ব্যতিক্রম ঘটেনি প্রবাদপ্রতিম মৃণাল সেনের ক্ষেত্রে।সেইসঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক অভিরূপ যুগের অবসান ঘটে গেল।শুধু ভারতের ক্ষতি হলো না,শূন্যতা সৃষ্টি হলো আন্তর্জাতিক স্তরে ও। যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যমণি মৃণাল সেন ছিলেন আধুনিক সিনেমার জনক।প্রাচীন এবং প্রাচ্য কে সামনে রেখে হারিয়ে যাওয়া সমাজ চিত্রে বৈশিষ্ট্যগুলোকে তিনি নিখুঁতভাবে রূপ দান করেছিলেন সিনেমার পর্দায়।সবাই চায় একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পেতে, জীবনের নতুন নতুন আস্বাদন পেতে,তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব বাংলা সিনেমায় একঘেয়েমি কাটিয়ে সিনেমার মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। অবশেষে ভারতীয় সিনেমা জগতের এক নিখুঁত শিল্পশৈলী কারিগর কে বিদায় জানাতে হলো, একরাশ ভারাক্রান্ত হৃদয় দিয়ে। মৃত্যু হল অতি বাস্তব। তবে তাকে মেনে নিতে হয়, তবু যেন মন মানতে চায় না। তার দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে যেমন অমূল্য সৃষ্টি দিয়ে গেছেন,তেমনি তিনি রেখে গেছেন নিজের হাতে গড়া বহু কারিগর কে। যারা সত্যিই অনাথ হয়ে গেলেন। এ কথা স্বীকার করে নিতে হবে যে সিনেমা জগতের স্বর্ণযুগ অধ্যায়ের অবসান হয়ে গেল। স্বর্ণযুগের পরিচালকদের “ত্রয়ী”নামে অভিহিত করলে ভুল হবেনা। ত্রয়ীরা হলেন সত্যজিৎ রায়,ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন। তাঁর মৃত্যুতে এক এবং অদ্বিতীয় সিনেমা তৈরীর আর ও ইচ্ছা অপূর্ণ হয়ে রইল।
কালজয়ী সৃষ্টির জন্য সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একই বন্ধনীতে উচ্চারিত হওয়া মানুষটির নাম মৃণাল সেন। জগৎবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেন বিশ্ব চলচিত্র জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। সত্যজিৎ রায় কে যেমন সমগ্র বিশ্ব “পথের পাঁচালী”র জন্য মনে রেখেছে, ঠিক তেমনই শুধুমাত্র “ভুবন সোম”এর জন্য মানুষ আজীবন মৃণাল সেন কে মনে রাখবে। সেই সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর ২৬ বছর পরে চলে গেলেন ভুবন সোম এর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভারতের প্যারালাল বা সমান্তরাল সিনেমার জনক ছিলেন। তার মেধার বুড়ো আঙুলের ছাপ রয়ে গিয়েছে অন্য ধরার বাংলা ছবির শিরায়,অস্থি,মজ্জায়। প্রথম ছবি “রাত ভোর” মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। এই সিনেমায় তেমনভাবে সাফল্য আসেনি।১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় “ভুবন সোম”। জগৎজোড়া খ্যাতির শীর্ষে তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।”পদ্মভূষণ ” সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন।”বাইশে শ্রাবণ”সিনেমা টি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সমাদৃত হয়।২০০৫ সালে তাকে দাদাসাহেব ফালকে সম্মানে ভূষিত করা হয়।
হাজার ১৯২৩ সালের ১৪ ই মে অবিভক্ত বঙ্গের ফরিদপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পদার্থ বিদ্যা নিয়ে কলকাতা য় স্কটিশ চার্চ থেকে কলেজ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ। ছাত্রজীবন থেকেই বামপন্থী মানসিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। বহুকাল ধরে কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়ার সংস্কৃতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ছিলেন।প্রথম জীবনে বাধ্য হয়ে কলকাতার বাইরে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর কাজ করতে হয়েছে। তবে তা ক্ষণস্থায়ী,ফিরে আসেন কলকাতায়। অবশেষে কলকাতা চলচ্চিত্র স্টুডিওতে একজন অডিও প্রযুক্তিবিদের চাকরি নেন। এখান থেকে শুরু তার পথ চলা।
একসময় বাংলা তথা ভারত জুড়ে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় বিশেষ করে কলকাতায় এবং তার আশেপাশের সেই অস্থিরতাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এই পর্যায়ে চলচ্চিত্রগুলি একই ধারাবাহিকতায় অনুসরণ করার চেষ্টা করতে শুরু করেন।তিনি বাইরের শত্রুদের খোঁজার পরিবর্তে নিজের মধ্যবিত্ত সমাজের শত্রুদের খোঁজার চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি কখনোই বিশেষ শিল্প মাধ্যম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করে দেননি।পরবর্তী জীবনে চলচ্চিত্রে তিনি বর্ণনামূলক কাঠামো থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং অন্যভাবে গল্প বলা বা তার চেতনাকে প্রতিফলিত করার কাজ করে গিয়েছিলেন।১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পার্লামেন্টের সম্মানীয় সদস্য ছিলেন। ফরাসি সরকার তাকে “কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অফ আর্টস অন্ড লেটার্স”এর সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছিলেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমিতির সভাপতিও ছিলেন। তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্র উৎসব যেমন কান,ভেনিস,বার্লিন,টোকিও, তেহেরান,শিকাগো সহ বিভিন্ন উৎসবের আন্তর্জাতিক জুরি সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।২০০৪ সালে তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনার শেষ করেন।২০০৮ সালে ওসিয়ান ফিলম ফেস্টিভাল এর ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁকে “লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট”পুরস্কার প্রদান করা হয়।২০০৯ সালে কেরালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ও কালজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক কে “লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট”সম্মান দেওয়া হয়েছিল। অবশেষে ২০১৮ সালে ৩০ শে ডিসেম্বর চলচ্চিত্র জগতের প্রাণপুরুষ মৃণাল সেন আমাদের ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর প্রয়ানে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে যে মহা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও পূরণ হবার নয়। জাগতিক নিয়মে তিনি এ জগত ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু তাঁর অমর সৃষ্টি রয়ে গেছে দর্শকদের হৃদয়ে। তাই তিনি আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।
বটু কৃষ্ণ হালদার,কল_১০৪