বাউল সম্রাট লালন ফকির
কলমে- ডঃ রমলা মুখার্জী
আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে যখন বাংলা গানের জগতে বাউল গান মানুষের মনে খুব প্রভাব ফেলেছিল, মানুষ যখন শুনতে পাচ্ছিল কোন এক আলোর দেশের কড়ানাড়া, ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই জন্ম নেন সাধক-গায়ক-কবি-গীতিকার লালন শাহ ফকির। কিন্তু আজও তাঁর সহজ ভাষায় মানব পুজোর গান মানুষের অন্তরে এক স্থায়ী আসন করে নিয়েছে যা কোনদিনই মুছে যাবে না। কথিত আছে কুষ্টিয়া জেলার ভাঁড়রা গ্রামে ফকির লালন শাহ ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে লালন হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট থেকেই খুব ভাল গান রচনা করে নিজেই সুর দিয়ে গাইতে পারতেন। তাই নানা অনুষ্ঠানে তিনি বাউল গান গাইতে যেতেন। একবার সঙ্গীদের সঙ্গে তিনি একটি অনুষ্ঠানে বাউল গান গাইতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পথে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখনকার দিনে এই রোগটি হলে কেউ বাঁচত না তাই তাঁর সঙ্গীসাথীরা প্রাণভয়ে তাঁকে ফেলে রেখে পালায়। মতিজান বিবি নামের এক মুসলমান মহিলা তাঁকে গঙ্গার ধারে পড়ে থাকতে দেখতে পান ও বাড়িতে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রষা করতে থাকেন। মতিজান বিবি ছিলেন তাঁতি মালাম শাহের স্ত্রী। ঐ মহিয়সী মহিলা যদি তাঁর নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে লালনকে অক্লান্ত সেবা করে বাঁচিয়ে না তুলতেন তো আমরা লালনের পরবর্তী জীবনের রচিত সেই অমূল্য গানগুলি পেতাম না, অকালেই ঝরে যেন তাঁর জীবন। এই নবজীবন লাভ করে লালন কিন্তু অনেকদিন বেঁচে ছিলেন- মনে হয় তাঁর ভেতরে এক প্রবল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছিল। তাঁর জীবন ইতিহাসে জেনেছি যে তিনি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ই অক্টোবর (১লা কার্তিক) মারা যান। প্রায় একশো ষোলো বছর তিনি বেঁচেছিলেন।
মতিজান বিবির পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে লালন আগের গ্রামে ফিরে গেলেও তাঁকে তাঁর হিন্দু পরিবার ও সমাজপতিরা গ্রহণ করেন নি কারণ তিনি মুসলমান বাড়িতে ছিলেন ও তাদের অন্ন-জল গ্রহণ করেছিলেন। চরম আঘাত পেয়ে পথকেই তিনি আশ্রয় করলেন। পথেই দেখা পেলেন ফকির দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের। সব দুঃখ ভুলে তিনি অমৃতের সন্ধান পেলেন। শুরু হল তাঁর গভীর অনুসন্ধান- সে সন্ধান মানুষের সন্ধান তাই তাঁর গানের মধ্যে আমরা মনের মানুষের সন্ধানেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করিঃ-
“ও ডুবে দেখ দিখি মন কি রূপলীলাময় আকাশ পাতাল খুঁজিস যারে এই দেহে সে রয়।“
গভীর জীবন দর্শন লালন খুব সহজভাষায় ব্যক্ত করতেন,
“অনেক ভাইগ্যের ফলে সেই চাঁদ কেউ দেখিতে পায়
অমাবস্যা রে নাই সে চাঁদের, বিদলে আর কিরণ উদয়।“- সত্যই চাঁদের সন্ধান কবি পেয়েছিলেন। সে চাঁদ মানুষের অন্তরের মধ্যে বিরাজ করে- তাই তো সব সাম্প্রদায়িকতা, সব ছুৎমার্গের ওপরে তিনি মানুষকে স্থান দিয়েছিলেন। তিনি সর্বদাই তাঁর আখড়াতে শিষ্যদের বলতেন, “সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন।“ হিন্দু ভক্তিবাদ ও মুসলিম সংমিশ্রণে লালন এক উদার ভাবধারার জন্ম দিলেন যেখানে মানুষের চাওয়া পাওয়াকেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। লালন নিজেও বিয়ে করেছিলেন এক মুসলমান কন্যাকে। জীবনকে সহজ, সরলভাবে গ্রহণ করে তিনি প্রকৃত মানব ধর্মের সেবা করে গেছেন, গানের মাধ্যমে মানুষের প্রতি ভালবাসা, ঈশ্বরের প্রতি সুগভীর প্রেম উজাড় করে দিয়েছেন। সারা জীবনে প্রায় দশহাজার গান তিনি রচনা করলেও মাত্র দু-তিন হাজার গান আমরা পেয়েছি; বাকি গান হারিয়ে গেছে, কারণ তাঁর শিষ্যরা লেখাপড়া জানতেন না। গানগুলির লিখিতরূপও পাওয়া যায় না। প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তো লালন ছিলেন না, কিন্তু তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর মানবতার শিক্ষা সারা পৃথিবীর লোককে প্রকৃত শিক্ষিত করার দাবী রাখে।
১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে লালন ফকিরের ছেঁউর গ্রামের আখড়াতে একটি গবেষণাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বছরে দুবার তাঁর স্মরণে ঐ আখড়াতে উৎসব হয়। একটি দোল পূর্ণিমাতে অপরটি তাঁর মৃত্যুদিনে (১লা কার্তিক)। সেই মহামেলায় একদিকে যেমন প্রচুর হিন্দু বাউল আসেন তেমনি অপরদিকে আসেন অনেক মুসলমান ফকির। ধর্মে-ধর্মে, মানুষে-মানুষের মেলবন্ধনে তিনি জগতে এনেছেন মহামানবের মেলা-যেখানে সবাই একজাতি, সে জাতি মানবজাতি।
******************
ড: রমলা মুখার্জী