Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★-Feb 23
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন– ৩৯
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

।। হ্রদ প্রবেশ পর্বাধ্যায় ।।

৪। দুর্যোধনের হ্রদ প্রবেশ ।

অবশিষ্ট কুরুসেনা ব্যস্ত পলায়নে।
দুর্যোধন অনুরোধে যোগ দিল রণে।।
তথাপি সুফল নাহি হইল বিশেষ।
পাণ্ডবের আক্রমণে সকলেই শেষ।।
নারায়ণী সেনা নাশ, নাশ কুরুগণ।
কুরু বংশ ধ্বংস বেঁচে দুর্যোধন।।
সাথে তাঁর নাহি কেহ সকলেই হত।
গদা হস্তে দুর্যোধন হন পলাইত।।
*
সঞ্জয়ে হেরি সহাস্যে ধৃষ্টদ্যুম্ন কন,
ইহাকে বন্দী করার নাহি প্রয়োজন।।
খরধার খড়্গ তুলি সাত্যকি তখন,
উদ্যত সঞ্জয়ে ত্বরা করিতে হনন।।
হেনকালে উপস্থিত ব্যাস ভগবন।
সাত্যকিরে করিলেন ত্বরা নিবারণ।।
কহেন, উচিত নহে সঞ্জয়ে হনন।
করহ তাহারে ত্বরা বন্ধন মোচন।।
সেই আদেশ সাত্যকি করিয়া পালন,
কহেন তাঁরে লভিলে নতুন জীবন।।
মঙ্গল হোউক তব যাও তুমি গেহে।
নিরস্ত্র সঞ্জয় যান রুধিরাক্ত দেহে।।

ত্যাজি রণ এক ক্রোশ করিয়া গমন,
হেরিলেন দুর্যোধনে করিতে ভ্রমণ।।
গদা হস্তে একা তিনি সজল নয়নে,
ভ্রমিছেন যত্রতত্র বিষন্ন বদনে।।
পুলকিত দুর্যোধনে হেরিয়া তখন,
কহেন সঞ্জয় তাঁরে মুক্তির কথন।।
অতঃপর দুর্যোধন ক্ষণপরে কন,
কি সংবাদ তাদের মোর প্রিয়জন।।
কহেন সঞ্জয় হত সব ভ্রাতাগণ।
জীবিত এখন মাত্র রথী তিন জন।।
কৃপ, কৃত, অশ্বত্থামা ভাগ্যের জোরে,
এখনো জীবিত কন, ব্যাসদেব মোরে।।
দুর্যোধন দীর্ঘশ্বাস করিয়া মোচন,
স্পর্শিয়া সঞ্জয়ে শোকে কহেন তখন,
তুমি ভিন্ন কেহ নাই মোর পক্ষে রণে,
কিন্তু সহায় সম্পন্ন দেখি শত্রুগণে।।
পিতৃদেবে গিয়া তুমি কহিও এখন,
দ্বৈপায়নে করিয়াছি আশ্রয় গ্রহণ।।
হইয়াছে গত মোর ভ্রাতা পুত্রগণ,
অতএব শ্রেয় মোর মরণে বরণ।।
হেন কহি হ্রদ মাঝে যান দুর্যোধন।
মায়া দ্বারা হ্রদ-জলে নাই আলোড়ন।।
ক্ষণপরে আইলেন তিন মহারথী,
কৃপ, কৃত, অশ্বত্থামা অতি দ্রুত গতি।।
কহেন সঞ্জয় সবে সব বিবরণ।
তাই শুনি করে সবে বিলাপ বচন।।

৫। যুধিষ্ঠিরের তর্জন।।

দুর্যোধনে খুঁজে ফেরে পাণ্ডুপুত্রগণ,
কিন্তু ব্যর্থ তাঁহাদের সব অন্বেষণ।।
অবশেষে পরিশ্রান্ত হইয়া তখন,
পাণ্ডব শিবিরে তাঁরা করেন গমন।।

কৃপ, কৃত, অশ্বত্থামা ক্রমে ধীরে ধীরে,
আইলেন তাঁরা সবে দ্বৈপায়ন তীরে।।
“ওঠ রাজা কর যুদ্ধ হইবেক জয়ী।
তব সাথে যুদ্ধে মোরা আছি এই ত্রয়ী”।।
হেন কৃপাচার্য-কথা করিয়া শ্রবণ,
দ্বৈপায়ন হ’তে সবে কন দুর্যোধন,
ক্ষত বিক্ষত শরীরে নাহি করি রণ।
নিরাময় হ’লে পুন করিবোই রণ।।
হ্রদ মাঝে আমি আজ লভিয়া আরাম,
যুঝিবোই রণাঙ্গনে আমি অবিরাম।।

হেনকালে তৃষাতুর ব্যাধ কয় জন,
আইল তথায় মাস করিয়া বহন।।
কৃপ-দুর্যোধনের সে কথোপকথন,
অন্তরালে থাকি তারা করিল শ্রবণ।।
হ্রদ মাঝে লুকাইত ভীত দুর্যোধন,
পাণ্ডবে সে সংবাদ দিল ব্যাধগণ।।
শুনি তাই রথারূঢ় পাণ্ডুপুত্রগণ,
দ্বৈপায়ন তীরে সবে করেন গমন।।

হাস্য করি যুধিষ্ঠির দুর্যোধনে কন,
“ওঠো তুমি যুদ্ধ কর ওহে দুর্যোধন।।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয় যুদ্ধ পলায়ন।
দ্বেষ আর দর্পে তব হইল পতন।।
নিপাতিত এই রণে ভ্রাতা পুত্রগণ।
তবু তুমি লুকাইত, সাঙ্গ কর রণ।।
হইল কত আত্মীয় হত মহারণে।
হইয়া ক্ষত্রিয় তুমি ভয় কেন রণে।।
বীর তুমি নও মোটে অতি ভীরুপ্রাণ।
মিথ্যা বীরত্বের তবু কর অভিমান।।
কর যুদ্ধ ত্যাজ তব এই মহাভয়।
ভোগ কর রাজ্য সুখ লভিয়া বিজয়।।
অন্যথায় পরাজয় করিয়া গ্রহণ,
নিহত হইয়া ভূমে করহ শয়ন”।।

“প্রাণীগণ হয় সদা ভয়ে অভিভূত।
বিচিত্র নহে তো তাহা জ্ঞাত সুনিশ্চিত।।
কিন্তু ভয়ে নহে মোর এই পলায়ন”।
যুধিষ্ঠিরের বচনে কন দুর্যোধন।।
“নিঃস্ব আমি ক্লান্ত আমি কেহ মোর নাই।
বিশ্রাম লভিতে আমি হ্রদে আছি তাই।।
আশ্বস্ত হও তুমি হে কুন্তিপুত্র শুন।
লভিয়া আরাম আমি রণিবোই পুন”।।

“আশ্বস্ত হলাম মোরা সুনিশ্চিত স্থির”।
দুর্যোধনের বচনে কন যুধিষ্ঠির।।
“ঘুরিলাম কত মোরা ব্যর্থ অন্বেষণে।
হ্রদ ছাড়ি ত্যাজি বারি এস তুমি রণে”।।
দুর্যোধন কহিলেন, “ওহে মহারাজ,
কুরুরাজ্য কাম্য মোর নাহি মনে আজ।।
যাদের লাগিয়া কাম্য এই রাজ্য ধন,
সেই সব ভ্রাতা পুত্র নাহিক এখন।।
হারাইয়া প্রিয়জন বীরশ্রেষ্ঠ গণে,
নাহি স্পৃহা আর মোর এই রাজ্য ধনে।।
তবু আমি আশা রাখি জয় করিবার।
কিন্তু তার প্রয়োজন নাহি দেখি আর।।
দ্রোণ, কর্ণ, পিতামহ হইল নিধন।
তাই আর রাজ্যপাটে নাই প্রয়োজন।।
দুই খণ্ড মৃগচর্ম করিয়া ধারণ,
অতি শীঘ্র বনে আমি করিব গমন।।
ত্যাজি ধন পুত্রগণ যাব মনোদুখে।
এ রাজ্য করুন ভোগ অতি মহাসুখে” ।।

“বন্ধ কর আর্তবাক্য হও তুমি স্থির”।
দুর্যোধনের বচনে কন যুধিষ্ঠির।।
“দান যদি কর তুমি সমগ্র ভুবন,
আমি সেই দান নাহি করিব গ্রহণ।।
সম্মুখ সমরে তব পরাজয় চাই।
তারপর রাজ্য যেন অধিকারে পাই।।
যে রাজ্যের অধীশ্বর নও তুমি আর।
সে রাজ্য দানের তব কিবা অধিকার।।
চাহিলাম যবে রাজ্য ধর্মানুসরণে,
তখন তা নাহি দিলে কিসের কারণে।।
করিলেন সন্ধি যাচ্ঞা কৃষ্ণ মহামতি।
প্রত্যাখ্যান কর তাঁরে হইল দুর্মতি।।
চিত্ত-ভ্রম হলো কেন তোমার এখন।
তুমি অতি মূঢ়মতি দুর্গতি-কারণ।।
নাহি দিলে সূচাগ্রের মেদিনী তখন।
এবে তবে কেন দাও সমগ্র ভুবন।।
পাপী তুমি করিয়াছ কত মহাপাপ।
ওঠ আজ কর যুদ্ধ ত্যাজ মনস্তাপ”।।
★★★★

( চলবে )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *