অশোক কুমার আচার্য্য
মানুষ অবস্থার দাস।বস্তুর যেমন তিন অবস্থা আমাদের ও ঠিক তাই।গরিব মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত।রান্নার ব্যাপারে যত রকমের পদ রান্না হয় তার মধ্যে মধ্যবিত্তরাই এগিয়ে। পয়সা থাকুক না থাকুক পেটের জন্য জিভে জল আনা পদ রান্না করা চাই। আমার নিজের রান্নার অভিজ্ঞতা সাংঘাতিক। জীবনে কোনদিন রান্নার অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথমবার যখন একবার রান্নার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।সময়টা যদি ও আজ থেকে অনেকদিন আগের তবু্ও সেদিনের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না।
সে-বছরই আমি স্নাতক হয়েছি।সাধারণ মানের ছাত্র, উচ্চাকাঙ্খা কিছুই ছিল না। পাশতো করেছি- এবার কি করব ভাবছি, এমন সময় বাবার কথা মতো গ্রামের এক ঠিকাদারের কাছে সুপারভাইজার হিসেবে লেগে গেলাম। মাইনে মাসে চারশো টাকা। ওই সময় ওই টাকার মূল্য ছিল। আমি বেশ কিছুদিন ঊনার কাছে কাজ করেছি। প্রথমে হলদিয়া ডক কমপ্লেক্সে এবং পরে নন্দীগ্রামের জেলিংহাম প্রজেক্টে। সোমবার হলদিয়ার টাউনশিপ থেকে লঞ্চে করে সাইটে যেতাম আর শনিবার বিকেলে বাড়ি ফিরে আসতাম। প্রজেক্টের কাজ খুব দ্রুত গতিতে চলছিল।
জেলিংহামে তখন কিছুই ছিল না- এখন ও নাই। প্রজেক্টের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। জায়গাটির চারপাশে শিল্পায়নের জন্য কোন পরিকাঠামো তৈরি করা হয়নি। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকা বলে নোনা হাওয়া আর চিটচিটে ভাব।বাজার হাট কিছুই কাছাকাছি নেই। ওষুধের দোকান চলছে অস্থায়ী ছাউনির মধ্যে।
আমাদের ঠিকাদার একটা ছোট কাজ পেয়েছিল। কয়েকটা লোহার স্ট্রাকচারাল গোডাউন তৈরির। নীচে পুরোটা ফেব্রিকেশন করে ইরেকশান করার পর অ্যাসবেসটস লাগিয়ে দিতে হবে। প্রতিদিন ওভারটাইম দিয়ে কাজ করাতে হতো। যাতে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায়। যাতায়াতের অসুবিধার জন্য কেউ হলদিয়া থেকে ওখানে যেতে চাইতো না।আমাদের কাজের লোকজনের মধ্য থেকে বিজয় নামে একজনকে ছেড়ে রাখা হত সবার রান্নার জন্য। একদিন কাজের পরিস্থিতি এমন হলো ওকে রান্না করতে পাঠানো যাচ্ছে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাইটে আলোর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়।এমন অবস্থা ইরেকশানটি কমপ্লিট না করেও আসা যাবে না। হেড- ফেব্রিকেটর কালিদা আমকে ডেকে বলল তুমি এখানে থেকে আর কি করবে বাসায় চলে যাও।স্টোভ জ্বেলে ভাত ডাল আর আলুসিদ্ধ করে ফেল।কাজটা শেষ করে আমরা যাচ্ছি। আমি তো খুব খুশি। এ আর এমন কি কাজ।বাসায় এসে ভাত মসুরের ডাল আর আলুসিদ্ধ করেছি।রাত দশটা হয়ে গেছে তখন ও কাজটা শেষ করে আসতে পারছে না। আমি ওদের আসতে দেরি দেখে আদা পেঁয়াজ রসুন ও লংকা কুচিকুচি করে কেটে কড়ায় তেল দিয়ে ভালো করে ভেজেছি। বেশ ভালো একটা গন্ধ ছাড়ছে। সময় যাচ্ছে আর আমার মাথায় বুদ্ধি খেলছে। হাতটা ভালো করে ধুয়ে আলুসিদ্ধ মাখালাম। কিছু সিদ্ধ আলু রেখে দিয়েছি সকালে যদি কেউ পান্তা ভাত খায় সেই জন্য।
রাত এগারোটার সময় সবাই এলো।ওদের পেট আর শরীর তখন জ্বলছে। কোনরকমে হাত পা ধুয়ে খেতে বসেছে। বিজয় সবাই কে প্রতিদিনের মতো খেতে দিচ্ছে। আলুসিদ্ধ মুখে দিয়ে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না। আমি মুখে দিয়ে দেখি আদা রসুনের বিদঘুটে গন্ধ ছাড়ছে। মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজ লংকা দিয়ে সবাই ভাত খেল আর আমাকে রাগে গরগর করতে করতে অনেক কটুকথা শুনিয়ে ছাড়ল।
আমার চোখ দিয়ে তখন জল পড়ছে।
পরবর্তী সময়ের আমি আর তখনকার আমি ‘র মধ্যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছে। রেলে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছি। ট্রেনিং ও পোস্টিং হলো মুঘলসরাই ডিভিশনে। সেখানের হোটেলের আতপচাল এর ভাত খেতে খেতে পেটে আমাশা হয়ে গেল। ঠিক করলাম এবার নিজে রান্না করে খাব।ততদিনে আমি বিয়ে করেছি ও আমাদের একটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। বাড়িতে গিয়ে মাঝে মাঝে শিখে নিচ্ছি কিভাবে রান্না করব।
কড়া থেকে উল্টোতে পারতাম না। মাছ ভাজা যে এতখানি কষ্টের সেটা বুঝতে পারলাম। একে ওকে জিজ্ঞেস করে ঠকে আর ঠেকে মাছটা ওল্টানো শিখেছি। এখনও মাঝেমধ্যে রান্না করে খেতে হয়।দু-একজন বন্ধুদের ও রান্না করে খাইয়েছি। আমার রান্না একেবারে সাধারণ। কোনও তরকারিতে আদা রসুন বা পেঁয়াজ বেটে দিইনি। সে মাংস হোক বা মাছের ঝোল হোক।সবসময় ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে কড়ায় তেল দিয়ে ভালো করে ভেজেছি।
বাঁধাকপিতে মটরশুঁটি ও আদাকুচি দিয়ে রান্না অনেকে চেটেপুটে খেয়েছে।
আমি যখন রান্না করি তখন আমার একটা স্পেশাল আইটেম থাকে, সেটা হলো বাগানসব্জী।নামটা দেখে সবাই কিছুটা আন্দাজ করুক আমি কেমন রাঁধুনি। তবু্ও বলি–রান্নাঘরে যা যা সব্জি থাকবে সবগুলো থেকে একটু একটু করে নিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে কড়ায় অল্প তেল দিয়ে কেবলমাত্র পেঁয়াজ, কাঁচা লংকা ও ধনেগুঁড়া দিয়ে রান্না করতে হবে। আদা আর
কাঁচকলা’র সম্পর্ক ভালো নয়।সেইজন্য কাঁচকলা থাকলে আদা দিই না।নাহলে একটু আদা কুচি দিতে হবে। আমারতো খেতে খুব ভালো লাগে।
আমফানের ঝড়ের তান্ডবে আমার কোয়ার্টার এর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। রান্নাঘরে দেখি কয়েকটি কচু পড়ে আছে। সব্জি ও অল্প আছে। মনে মনে ভাবলাম কচুগুলো আজকাল ইউরিক অ্যাসিড এর ভয়ে কেউ খেতে চাইছে না।এখন আমাদের মধ্যে সচেতনতা এতটাই বেড়ে গেছে যে আমরা ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে অন্যান্য রোগে ভুগছি।সব সব্জি যদি খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিই তাহলে স্বাদ গ্রহণ করব কিভাবে। বাড়িতে ভেটকি মাছের ঝোল কচু দিয়ে খেয়েছি। করুনার হাতের সেই রান্না এখনো মুখে লেগে আছে। আমি সেদিন কচুকে সেদ্ধ করে নিয়ে ডিমের মাখামাখা কারি বানালাম।আদাকুচি, পেঁয়াজ, রসুন এর চার-পাঁচটি কোয়া, একটা টম্যাটো, জিরাগুঁড়া ও তিন চারটি কাঁচা লংকা দিয়ে রান্না করেছি।সেদিন আমরা চারজন খেয়েছিলাম। তরকারিটা এত সুন্দর হবে আমি নিজেই ভাবতে পারিনি।
এভাবে আমি নিজে নিজে একটু উল্টো পাল্টা রান্না করে খেয়েছি। তারমধ্যে লেবু দিয়ে ডিমের টক সঙ্গে দু’এক টুকরো মিষ্টিকুমড়ো। অনেকেই নাক সিঁটকাবে।তবে সবাই কে একবার রান্না করে খেতে বলব।দেখুন না কেমন লাগে আমার রেসিপি গুলো। পেটুক মশাইরা সবই খায় স্বাদ আস্বাদনের জন্য।
——————————————————————