নাটক: মেঘলা দর্পণ
কলমে: বিধানচন্দ্র হালদার
(নিজের লেখা নাটক শেষ করবার পর আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়ল আমার লেখার খাতায়। আপনারাও পড়বার পর আপনাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারবেন না। আপনাদের চোখের জল গড়িয়ে পড়বে মোবাইলে)
চরিত্র লিপি:-
চাঁপা:-মাধ্যমিক পাস ছাত্রী
বিধুশেখর:-বাংলা শিক্ষক
সূর্যকান্ত:-চাঁপার বাবা
অর্ঘ্যদীপ:-ডাক্তার
প্রথম দৃশ্য
(বিধুশেখর মঞ্চে একা বসে আছেন একটি চেয়ারে। হাতে খবরের কাগজ ,সামনের টেবিলে অনেক বই)
চাঁপা:-(দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।) স্যার, বাড়িতে আছেন? (কোন উত্তর না পেয়ে) স্যার বাড়িতে আছেন?( দরজায় আবার টকা দিয়ে) স্যার বাড়িতে আছেন?
বিধুশেখর:-(আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ ,দরজা খুলে দিয়ে) কে? চাঁপা?
চাঁপা:- হ্যাঁ, স্যার।
বিধুশেখর:- এই বাদলা দিনে, সন্ধ্যার সময়।
চাঁপা:- খুব বিপদে পড়ে এসেছি স্যার।
বিধুশেখর:- বিপদ? আচ্ছা, পরে শোনা যাবে ।এখন এই গামছা দিয়ে ভালো করে মাথাটা মুছে নাও দেখি।
চাঁপা:-( গামছা না নিয়ে সরাসরি স্যারের পা দুটি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে) স্যার, আমি পড়তে চাই ,আমি বিয়ে করবো না ,আমাকে আপনি বাঁচান স্যার। বাবা জোর করে আমাকে বিয়ে দেবে ঠিক করেছে। এই সামনের ফাল্গুনে।
বিধুশেখর:-(চাঁপার হাতটি পা থেকে ছাড়িয়ে )তুমি অবশ্যই পড়বে। তুমি তো এ বছর মাধ্যমিকে আমাদের স্কুল থেকে স্টার পেয়েছো।
চাঁপা:-হ্যাঁ স্যার, কিন্তু বাবা তো আর পড়াতে চাইছে না!
বিধুশেখর:-ঠিক আছে, তোমার বাবাকে আমি বোঝাবো।
চাঁপা:-আমি পড়তে চাই স্যার, আমি পড়তে চাই স্যার, আমি পড়তে চাই স্যার।
(কান্না)
বিধুশেখর:-তুমি অবশ্যই পড়বে, আগামীকাল বিকেলে স্কুল ছুটির পর তোমাদের বাড়িতে যাবো।
চাঁপা:-সত্যি স্যার।
বিধুশেখর:-অবশ্যই, তুমি অবশ্যই পড়বে। তুমি আজ বাড়িতে যাও।
চাঁপা:-ঠিক আছে স্যার।
বিধুশেখর:-চাঁপা ,একটা কথা বলা হয়নি।
চাঁপা:- বলুন স্যার।
বিধুশেখর:-তোমার বাবাকে বিকেলের দিকে বাড়িতে থাকতে বলো।
চাঁপা :-হ্যাঁ স্যার ( চাঁপা স্যারকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল)
বিধুশেখর :-(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) আরে রাত ন’টা বেজে গেলো ,আগামীকাল annual sports, কিছু জিনিস কিনতে বাকি আছে।যাই একটু বাজারে যাই।এই বলে বিধুশেখর বাজার করতে চলে গেলেন।
দ্বিতীয় দৃশ্য
(ভাঙাচোরা মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাউনির ঘর। চাঁপার বাবা সূর্যকান্ত বাবু চাটাই পেতে বসে আছেন ,পাশে মেয়ে দাঁড়িয়ে।)
সূর্যকান্ত–চারটে বাঁচতে গেল কই তোর স্যার এখনো এলো না তো?
চাঁপা –চারটে বাঁচতে দু মিনিট বাকি আছে বাবা?
সূর্যকান্ত –ওই হলো আর কি? যাহাই বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন।
(এমন সময় স্যারে কণ্ঠস্বর শোনা গেল)
বিধুশেখর:-চাঁপা বাড়িতে আছো?
(চাঁপা তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে)
চাঁপা:-স্যার এসেছেন ,তোমাকে যে স্যারের কথা বলেছিলাম গতকাল।
সূর্যকান্ত বাবু:-নমস্কার স্যার ,ভিতরে আসুন ।(চাটাই পেতে দিলেন স্যারকে বসার জন্য, স্যার চাটাই এ বসেন)
বিধুশেখর :-আচ্ছা সূর্যকান্ত বাবু
সূর্যকান্ত বাবু :-বলুন স্যার
বিধুশেখর:- আপনার মেয়ের এত ভালো রেজাল্ট ,তাহলে আপনি পড়াবেন না কেন?
সূর্যকান্ত বাবু :-স্যার, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।
বিধুশেখর:- আমি সব পড়ার ব্যবস্থা করে দেব
সূর্যকান্ত বাবু:- বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন?
বিধুশেখর :-যতদূর পড়তে চায় ততদূর আপনার মেয়েকে পড়াবো, সব খরচ আমার।
সূর্যকান্ত বাবু:- এইখানেই তো বিপদ স্যার।
বিধুশেখর :-বিপদ? ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সূর্যকান্ত বাবু :-আপনাদের মত জ্ঞানী মানুষ যদি বুঝতে না পারেন!
বিধুশেখর :-সত্যি বলছি সূর্যকান্ত বাবু, পড়াশোনা করবে, সেখানে আবার বিপদ কোথা থেকে আসছে?
সূর্যকান্ত বাবু:-আপনি ঘটকালি করতে পারবেন?
বিধুশেখর:-ঘটকালী করার কাজ আমার নয়।
সূর্যকান্ত বাবু:- তাহলে আপনি আসতে পারেন স্যার।
চাঁপা :-(স্যারের পা জড়িয়ে ধরে )আমি পড়তে চাই স্যার, আমি পড়তে চাই স্যার, এই অল্প বয়সে বিয়ে করবো না স্যার, আমি পড়তে চাই স্যার।
সূর্যকান্ত বাবু :-(মেয়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে )বেশি দূর লেখাপড়া শিখলে তোকে বিয়ে দেবো কীভাবে হারামজাদী
বিধুশেখর:-ভালো পাত্র জোগাড় হয়ে যাবে, ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে.
সূর্যকান্ত বাবু :-আপনি আমার মেয়ের জন্য ঘটকালী করতে পারবেন ?
বিধুশেখর :-বলছি তো সূর্যকান্ত বাবু, আমাদের কাজ ঘটকালী করার নয়।
সূর্যকান্ত বাবু :-তাহলে আসতে পারেন স্যার
চাঁপা :-(আবার স্যারের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে )স্যার আমি পড়তে চাই স্যার ,আমি পড়তে চাই (কান্না)
সূর্যকান্ত বাবু:-( মেয়ের চুলের মুঠি ধরে হেচকা টানতে টানতে) গরীব ঘরের মেয়েদের পড়তে নেই খুকি।( কান্না )বেশি পড়লে বেশি পড়াশোনা জানা ছেলে দরকার। বেশি পড়াশোনা জানা ছেলেদের আবার বেশি বরপণ দরকার ।আমাদের তো দিন আনি দিন খাই, কোথায় পাবো টাকা? বাড়িতে চার চারটে পেট। মা মরা মেয়ে। তোকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলে অন্তত একটি পেটের চিন্তা কমবে রে খুকি (কান্না)
বিধুশেখর:- তা বলে আপনার মেয়েকে পড়াবেন না সূর্যকান্তবাবু
সূর্যকান্ত বাবু :-(কান্না )আমাদের মতো গরীব ঘরের মেয়েদের জন্মানোটাই অপরাধ, পড়াশোনা তো আরো অপরাধ।
বিধুশেখর:- এমন করে বলবেন না সূর্যকান্ত বাবু, গরীব ঘর থেকে তো পৃথিবীতে অনেক মহামানবের জন্ম হয়েছে।
সূর্যকান্ত বাবু :-হয় না স্যার, হয় না। চাষার ছেলে চাষা হয়, ডাক্তারের ছেলে ডাক্তার।
বিধুশেখর:- আপনার কথাটি ভুল সূর্যকান্তবাবু ,আমি একটা আবদার করবো।
বিধুশেখর :-আপনার মেয়েকে আমার বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করাতে চাই
সূর্যকান্ত বাবু :-এ তো আনন্দের কথা স্যার, অন্তত আমার একটা পেটের চিন্তা কমবে, মেয়েটাও মানুষ হবে। আমি গরীব বলে কেবল পেরে উঠিনি। আমিও তো চাই মেয়েটা লেখাপড়া শিখুক। টাকা না থাকলে কী করবো বলুন?
চাঁপা:-(পা জড়িয়ে ধরে) আমি পড়তে চাই স্যার, আমি পড়তে চাই।
বিধুশেখর :-(হাত দুটি ছাড়িয়ে) তুমি অবশ্যই পড়বে চাঁপা ,তোমার সব দায়িত্ব আজ থেকে আমার।
সূর্যকান্ত বাবু :-আপনি ভগবান স্যার। (স্যারের পায়ে হাত দিয়ে) আপনার মত দেবদূত আজ আমার বাড়িতে আসার জন্য আমার মেয়েটি সূর্যের মুখ দেখতে পাবে ।অন্ধকার ঘর থেকে অন্ধকার ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম (কান্না)।
বিধুশেখর :-আপনার মেয়ে আজ থেকে আমার মেয়ে। ওকে আমি মানুষ করবো। (সূর্যকান্ত বাবুকে সম্ভাষণ জানিয়ে চাঁপাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ির দিকে)
তৃতীয় দৃশ্য
(বিধুশেখরের বৈঠকখানা ।ঝাঁ চকচকে বাড়ির পরিবেশ। বিধুশেখর চা খাচ্ছে, পাশে চাঁপা )
বিধুশেখর:- চাঁপা।
চাঁপা :-বলুন স্যার।
বিধুশেখর:- তোমাকে মন দিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করতেই হবে।
চাঁপা:- অবশ্যই পড়াশোনা করবো স্যার।
বিধুশেখর :-কোনো ফাঁকি দেবে না কিন্তু?
চাঁপা :-কোনো ফাঁকি দেব না স্যার,।
বিধুশেখর :-তুমি পাশের রুমটাতে থাকবে?
চাঁপা :-ঠিক আছে স্যার।
বিধুশেখর :-তোমার কি পড়তে ভালো লাগে? আর্টস, সায়েন্স না কমার্স?
চাঁপা :-সায়েন্স স্যার।
বিধুশেখর :-সায়েন্স,বেশ ভালো ,তোমাকে এই মাসেই সুন্দরবন আদর্শ বিদ্যামন্দিরে ভর্তি করে দেবো।
চাঁপা:- আপনি যেখানে ভর্তি করে দেবেন, সেখানেই পড়বো স্যার।
বিধুশেখর :-কোনো লজ্জা করবে না চাঁপা, যা কিছু লাগবে বলবে আমাকে।
চাঁপা :-ঠিক আছে স্যার, কোনো লজ্জা করবো না।
বিধুশেখর :-জীবনে বড় হতে গেলে, এই তিনটি জিনিস মনে রাখবে।
চাঁপা :-কী স্যার?
বিধুশেখর :-লজ্জা ,ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয় ।তবেই তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারবে।
চাঁপা :-আপনার এই তিনটি বিষয় আমি সারা জীবন মনে রাখবো স্যার।
বিধুশেখর:- তুমি বায়ো, না পিওর সাইন্স রাখবে?
চাঁপা :-বায়ো সায়েন্স।
বিধুশেখর:- পিওর সায়েন্স রাখবে না কেন?
চাঁপা:-আমি ডাক্তার হতে চাই স্যার, তাই মেডিকেল পরীক্ষাটা দেবো স্যার
বিধুশেখর:- ঠিক আছে চাপা, তোমার যা মন চাইবে সেটাই পড়ো।
চাঁপা :-কবে ভর্তি করে দেবেন স্যার?
বিধুশেখর :-এইতো তিনদিন পরেই ,তুমি মন দিয়ে ক্লাস করবে কিন্তু।
চাঁপা :-অবশ্যই স্যার, খুবই মন দিয়ে পড়াশোনা করবো স্যার।
বিধুশেখর:-তোমার যা যা বই লাগবে আজ কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনবো?
চাঁপা :-ঠিক আছে স্যার।
বিধুশেখর :-তুমি নিরুপমা টেলারিং এ গিয়ে দুটি স্কুল ড্রেস কাটিয়ে আনবে, সামনেই দোকান ,আমি ফোন করে দেবো দোকানে, কোনো অসুবিধা হবে না কাটাতে।
চাঁপা:-ঠিক আছে স্যার, আজ বিকেলে গিয়ে কাটাতে দেবো জামা
চতুর্থ দৃশ্য
(প্রতিদিন স্কুলে যায় চাঁপা ।মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে পড়ে ।বাবাকে ফোন করে , সূর্যকান্ত রাতে খেতে বসেছেন ,এমন সময় রিং বেজে উঠলো)
সূর্যকান্ত:- হ্যালো, কে?
চাঁপা :-আমি বাবা
সূর্যকান্ত:- কেমন আছিস খুকি?
চাঁপা :-ভালো আছি বাবা ,তুমি কেমন আছো?
সূর্যকান্ত:- ঠাকুর যেমন রেখেছেন খুকি, তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?
চাঁপা :-ভালো
সূর্যকান্ত:- এখন কি পড়ছিস?
চাঁপা :-ডাক্তারী
সূর্যকান্ত:- সে কি?
চাঁপা:- হ্যাঁ গো বাবা।
সূর্যকান্ত:- এতো বড় আনন্দের খবর তুই তো বলিস নি।
চাঁপা :-তোমার ফোন পাচ্ছিলাম না বাবা।
সূর্যকান্ত:- ঠিক আছে খুকি, ভালো করে পড়াশোনা কর স্যারের বাড়িতে
চাঁপা :- করবো বাবা।
সূর্যকান্ত:- নিজের শরীরের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস খুকি
চাঁপা :-তোমার বয়স হয়েছে ,তুমি আগে তোমার শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখবে।
সূর্যকান্ত:- ঠিক আছে খুকি।
চাঁপা :-এখন রাখি বাবা ,এখন খাবো।
(স্যার চিৎকার করে ডাকতে থাকে, চাঁপার খাওয়ার টেবিলে আসার জন্য)
বিধুশেখর:-খাওয়ার টেবিলে চলে এসো চাঁপা
চাঁপা :-এই যাই স্যার ,খাওয়ার টেবিলে চলে আসে চাঁপা
বিধুশেখর:- এতক্ষন কার সাথে ফোনে কথা বলছিলে?
চাঁপা :-বাবার সাথে।
বিধুশেখর :-ও ঠিক আছ
(খাওয়ার টেবিলে দুজনে বসে)
বিধুশেখর :-ডাক্তারি পড়তে আর কতদিন লাগবে?
চাঁপা :-এইতো স্যার ,সামনের মাসের শেষ সেমিস্টার
বিধুশেখর :-ও …তুমি কিন্তু ডাক্তারি পাশ করার পর গরিবদের চিকিৎসা করতে হবে।
চাঁপা :-আপনার আদর্শে বড় হয়েছি স্যার, নিশ্চয়ই চিকিৎসা করবো গরিবদের ।আমি তো আমার অতীতকে ভুলে যাইনি স্যার।
বিধুশেখর :- তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে বারবার কাকে ফোন করো?
চাঁপা :-কখন স্যার?
বিধুশেখর:- রাতের দিকে।
চাঁপা :-আমাদের ডাক্তারী ক্লাসের একটি ছেলে।
বিধুশেখর:- তা তোমাকে প্রতিদিন ফোন করে কেন?
চাঁপা :-জানিনা স্যার!
বিধুশেখর :-সত্যি করে বলো?
চাঁপা :-সত্যি বলছি জানিনা স্যার!
বিধুশেখর :-তাকে কি তোমার ভালো লাগে?
চাঁপা :-জানি না স্যার!
বিধুশেখর :-ছেলেটির নাম কি? কোথায় থাকে
চাঁপা :-অর্ঘ্যদীপ। কোথায় বাড়ি সঠিক জানিনা!
বিধুশেখর :-আমি একদিন ফোনে সরাসরি কথা বলবো ,ফোন নম্বরটা আমাকে দাও
চাঁপা :-ঠিক আছে স্যার
পঞ্চম দৃশ্য
(অর্ঘ্য সদ্য ডাক্তারি পাস করার আনন্দে বন্ধুদের ফোনে সুখবরটা জানাতে থাকে, এমন সময় একটা অজানা ফোন নম্বর ভেসে ওঠে)
অর্ঘ্য:-হ্যালো, কে বলছেন?
বিধুশেখর:-আমি।
অর্ঘ্য:-আমি কে? ঠিক চিনতে পারলাম না তো!
বিধুশেখর:-তুমি চাঁপা কে চেনো?
অর্ঘ্য:-অবশ্যই চিনি। আজ তো আমাদের চূড়ান্ত রেজাল্ট বাহির হলো। আমার খুবই কাছের বন্ধু। কিন্তু আপনি চাঁপার কে হন?
বিধুশেখর:- চাঁপা আমার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে।
অর্ঘ্য :-আর কিছু বলতে হবে না স্যার, চাঁপার মুখে সব শুনেছি।
বিধুশেখর :-কি শুনেছো?
অর্ঘ্য :-আপনি ভগবান স্যার, চাঁপার জন্য যা করেছেন।
বিধুশেখর :-আমি ভগবান নয় অর্ঘ্য ,সবই উপরওয়ালা, তবে আমার একটা কথা রাখবে?
অর্ঘ্য:- কি স্যার?
বিধুশেখর :-বলতে সাহস পাচ্ছিনা।
অর্ঘ্য :-বলুন স্যার ,আপনি তো আমার কাছেও পিতৃ তুল্য।
বিধুশেখর :-কথাটি বলবো?
অর্ঘ্য:- হ্যাঁ স্যার
বিধুশেখর:-তুমি কি চাঁপাকে ভালোবাসো? লজ্জা করো না। তোমরা অনেক বড়ো হয়েছো, লজ্জা করার কিছু নেই।
অর্ঘ্য :-হ্যাঁ স্যার, আপনার কাছে লজ্জা করবো কেন স্যার?
বিধুশেখর :-তাহলে শুভ দিন দেখে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি?
অর্ঘ্য:- আগে আমরা হসপিটালে জয়েন্ট করি
বিধুশেখর:-ঠিক আছে তাই হবে, তখন সানাই বাজিয়ে দেবো, তখন না বোলো না কিন্তু।
ষষ্ঠ দৃশ্য
(অর্ঘ্য ও চাঁপা নীলরতন হসপিটালে জয়েন্ট করলো, অর্ঘ্য ও চাঁপা দুইজনে নিউরোলজিস্ট ।চেম্বারের ফাঁকে দুজনে প্রেমালাপ চলছে।)
অর্ঘ্য:-চাঁপা রানী।
চাঁপা:-বলো অর্ঘ্য।
অর্ঘ্য:-তাহলে এবার আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে।
চাঁপা :-এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?
অর্ঘ্য:-মেঘে মেঘে অনেক তো বেলা হলো চাঁপা রানী।
চাঁপা :-মেঘ সরে একদিন রোদ্দুর উঠবেই
অর্ঘ্য :-কবে সেটা?
চাঁপা :-খুবই শীঘ্রই।
অর্ঘ্য :-অপেক্ষায় রইলাম।
(পরস্পর গোলাপ দেওয়া নেওয়া চলে)
চাঁপা :-চলো অনেক তো আড্ডা হলো, এবার রোগী দেখতে চলো।
অর্ঘ্য :-আর একটু থাকো না চাঁপা ।
(এমন সময় রক্তাক্ত অবস্থায় একটি রোগী হাসপাতালে এলো। বিশেষভাবে মাথায় চোট খেয়েছে ,সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এমার্জেন্সিতে দুই নিউরোলজিস্ট অর্ঘ্য ও চাঁপার ডাক পড়লো।
চাঁপা :-(রক্ত মুছে মুখটার দিকে তাকাতেই বিস্ময় ) বাবা! তোমার কি করে এমন এক্সিডেন্ট ঘটলো?
সূর্যকান্ত:-(ক্ষিনকন্ঠে) গা–ড়ি
চাঁপা :-ও –আর বলতে হবে না!
(সঙ্গে সঙ্গে ওটি তে নিয়ে যাওয়া হল)
চাঁপা :-দেখো অর্ঘ্য তুমি সব শুনেছো, যে কোনো মূল্যে আমাদের বাবাকে বাঁচাতেই হবে।
অর্ঘ্য :-চেষ্টা তো করবোই।
(দীর্ঘ অপারেশনের পর)
চাঁপা:-এখন কেমন আছো বাবা?
সূর্যকান্ত:-একটু ভালো আছি খুকি। কে আমাকে অপারেশন করলো?
চাঁপা :-আমি ও অর্ঘ্য
সূর্যকান্ত:-তুমি ?
চাঁপা :-হ্যাঁ গো বাবা, আমি সেই চাঁপা
সূর্যকান্ত:-তুই আমার প্রাণ বাঁচালি খুকি?
চাঁপা :-আমি কেবল একা নয়, অর্ঘ্যও আছে
সূর্যকান্ত:-অর্ঘ্য কে?
চাঁপা :-তোমার হবু জামাই
সূর্যকান্ত:-সেও ডাক্তার?
চাঁপা:-হ্যাঁ গো বাবা, আমরা দুজন আপ্রাণ চেষ্টা করে তোমাকে বাঁচিয়েছি
সূর্যকান্ত:-অন্ধকার জঙ্গলে তোকে ফেলে রেখেছিলাম ,তুই আজ সারা আকাশকে আলোকিত করেছিস খুকি। বেলা শেষের চন্দ্র সজ্জায় ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে শান্তিতে খুকি।
চাঁপা :-তুমি বেশি কথা বলো না।
সূর্যকান্ত:- আমাকে যে কথা বলতেই হবে খুকি।
চাঁপা :-তুমি কথা বলো না, বিপদ হতে পারে।
সূর্যকান্ত:- কথা আমি বলবোই ।(ক্ষিন কণ্ঠে ) দুজনের দুটি হাত দে দেখি। (পরস্পর দুটি হাত মিল করে দিলো) একনাগাড়ে বলতে থাকলো, আমার মেঘ সজ্জায় আশ্বিনের কাশফুল ফুটেছে। আর আমার কোন দুঃখ নেই, আমি ভুল করেছিলাম।
চাঁপা :-কি ভুল বাবা?
সূর্যকান্ত:- তোকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দিয়ে
চাঁপা :-তোমার ইচ্ছে ছিল, টাকা ছিল না।
সূর্যকান্ত:- স্যার কোথায় গেলেন?
বিধুশেখর:-এই তো আমি, দূরে দাঁড়িয়ে।
সূর্যকান্ত:- দূরে কেন, কাছে আসুন।( কাছে এগিয়ে এলে)
সূর্যকান্ত :-আপনি ভগবান স্যার ,আপনি ভগবান। সত্যের পূজারী ,অমৃতের দীক্ষা মন্ত্র। আপনার হাতে আমার মেয়েকে দিয়ে গেলাম।
আ–মা–র –খু–কি–কে ।(কথা বলতে বলতে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে,
চাঁপা ,অর্ঘ্য , বিধুশেখর সবাই কাঁদতে থাকে। কান্নার রোল আকাশ ,বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে, সূর্যকান্তের বুকের উপর চাঁপা ও অর্ঘ্যর মাথা রইলো ।স্যারও দুঃখে ভেঙে পড়েন।
চাঁপা:-আমরা এতো বড়ো ডাক্তার হয়েও বাঁচাতে পারলাম না বাবাকে, বাঁচাতে পারলাম না বাবাকে।(কান্না)
বিধুশেখর:- জন্ম, মৃত্যু কেউ খন্ডাতে পারে না চাঁপা ।সবই বিধাতার লেখা।
(মৃতদেহ তিনজন জড়িয়ে থাকবে। তিনজনের চোখ ছলছল ।কান্না ভেজা চোখ। চোখের জল গড়িয়ে পড়বে মৃতদেহের উপর।আস্তে আস্তে লাল আলো নিভে আসবে, পর্দা পড়ে যাবে।ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা দুঃখের গান চলবে)
সময়ের দর্পণ কবি
বিধানচন্দ্র হালদার
কাকদ্বীপ। শান্তিনিকেতন। কবিতা কুঞ্জ।
১৮/০৪/২০২৪.