Spread the love

ধারাবাহিক পৌরাণিক কাব্য

★কুরুক্ষেত্রে আঠারো দিন★-Mar. 23
কাব‍্যরূপ:–কৃষ্ণপদ ঘোষ।
উপস্থাপন–৪০
( অন্তিম উপস্থাপন)

।। গদাযুদ্ধ পর্বাধ্যায় ।।
৬। ।। গদাযুদ্ধের উপক্রম ।।

দুর্যোধন হেন কথা করিয়া শ্রবণ,
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করি যুধিষ্ঠিরে কন,
“শোক তপ্ত একা আমি রথ রথী হীন,
সবাকার সাথে যুদ্ধে জয় অতি ক্ষীণ।।
একে একে এসো যদি সম্মুখ সমরে,
গদা ল’য়ে তার সাথে যাবো যুদ্ধ ক’রে”।।

কহিলেন যুধিষ্ঠির, “ওহে দুর্যোধন,
ভাগ্যক্রমে ক্ষত্রধর্ম বুঝিলে এখন।
রাজি মোরা আছি আজি তব এ বচনে।
হ্রদ ছাড়ি এসো তবে ত্বরা এই রণে।।
কহিলাম আমি তব মঙ্গল সাধনে,
করিলে নিধন তুমি মাত্র একজনে,
তাহাতেই রাজ্য লাভ জেনে রাখ মনে,
অন্যথায় কর যুদ্ধ সবাকার সনে”।।

কশাঘাতে বিচলিত স্থির অশ্ব যথা,
দুর্যোধন অসহিষ্ণু বাক্যবাণে তথা।।
যুধিষ্ঠিরের বচনে কন দুর্যোধন,
“দ্বৈরথ সমরে দিও সেরা যেই জন।।
তারি সাথে নামি আমি গদা ল’য়ে রণে।
হাত গন্ধ করিব না মুষিক নিধনে”।।

ছাড়ি শ্বাস ঘনঘন যেন নাগরাজ।।
উত্থিত আহূত রাজ্য হারা মহারাজ।।
স্বর্ণ বলয় মণ্ডিত তাঁর প্রিয় গদা।
হস্তে তাঁর সুশোভিত জাগরুক সদা।।
আইলেন দূর্যোধন যেন শূলপাণি।
হৃষ্ট পাঞ্চাল পাণ্ডব করে করধ্বনি।।
উপহাস বোধে মনে মূঢ় দুর্যোধন,
সক্রোধে কহেন ওষ্ঠ করি দংশন,
“শীঘ্রই লভিবে ফল পাণ্ডুপুত্রগণ,
যমলোকে সবে শীঘ্র করিবে গমন”।।
তারপর দুর্যোধন মেঘমন্দ্র স্বরে,
ক্লীষ্ট রুধিরাক্ত দেহে কন যুধিষ্ঠিরে,
“সবাকার সাথে চাহি করিবারে রণ।
কিন্তু একের বিরুদ্ধে নহে বহুজন।।
এই নীতি সকলের জ্ঞাত সুনিশ্চয়।
একজন প্রতিপক্ষে বহুজন নয়”।।

কহিলেন যুধিষ্ঠির, “ওহে দুর্যোধন,
হইলাম খুশি শুনি তোমার বচন।।
এই রণনীতি ছিল কোথায় তখন,
অভিমুন্যে সপ্ত রথী করিল হনন।।
বিপদে পড়িলে তব ধর্মকথা মুখে।
অসাধুতা সঙ্গী তব সম্পদে ও সুখে।।
বীর তুমি কর কেশ এক্ষণে বন্ধন।
তারপর বক্ষে বর্ম করহ ধারণ”।।

শিরস্ত্রাণ, স্বর্ণ-বর্ম করিয়া ধারণ,
সুসজ্জিত দুর্যোধন করিবারে রণ।।
সুসজ্জিত ভীমসেন হস্তে প্রিয় গদা।
রণং দেহি মূর্তিতে তৎপর সদা।।
উন্মত্ত হস্তীর পানে ক্ষিপ্ত হস্তী যথা,
ধায়িলেন গদা হস্তে ভীমসেন তথা।।
কহিলেন ভীমসেন, “ওহে দুর্যোধন,
যতেক কুকর্ম তব করহ স্মরণ।।
দ্যূতক্রীড়া কূটক্রীড়া তব চিন্তা-ফল।
পরাভূত ধর্মরাজ শকুনি-কৌশল।।
সভামাঝে পাঞ্চালিরে কর অপমান।
নিরপরাধ পাণ্ডবে নানা অসম্মান।।
সেই পাপের ফলই লভিবে এখন।
গদাঘাতে আজ তব নিশ্চিত মরণ।।
ভীষ্ম, দ্রোণ,শল্য তাঁরা সব অকারণে,
লভিলেন মৃত্যু সবে তোমার কারণে”।।

“স্তব্ধ কর আত্মশ্লাঘা”, কন দুর্যোধন।
“আজ তব যুদ্ধপ্রীতি হবে সমাপন।।
ন্যায়যুদ্ধে নাহি কেহ মোরে বধিবারে।
ইন্দ্রও অক্ষম মোরে আজ জিনিবারে।।
কুন্তিপুত্র, বৃথা কেন কর এ গর্জন।
যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি তব কর প্রদর্শন”।।

হেনকালে বলরাম পাইয়া খবর,
উপস্থিত হইলেন সেখানে সত্বর।।
হেরি তাঁরে পুলকিত পাণ্ডুপুত্রগণে।
যথাবিধি আপ্যায়িত তিনি সেই ক্ষণে।।
তারপর কহিলেন পাণ্ডুপুত্রগণ,
“শিষ্যের যুদ্ধ আজিকে হোক দরশন।।
বলরাম সবাকারে করি আলিঙ্গন,
সেখানে আসন তাঁর করেন গ্রহণ।।

৭। দুর্যোধনের উরুভঙ্গ ।
[ অষ্টাদশ দিনের যুদ্ধান্ত ]

“কুরুক্ষেত্র পুণ্যময় স্বর্গপ্রদ স্থান।
তথা হত হন যত ইন্দ্রলোকে যান।।
কুরুক্ষেত্র তীর্থক্ষেত্র অতি পুণ্যধাম।
ঋষি মুখে শোনা কথা” কন বলরাম।।
“কুরুক্ষেত্র নহে ইহা এ তো দ্বৈপায়ন।
সমন্তপঞ্চক পারে সবে তাহা কন।।
তাই তথা হোক এই দোঁহাকার রণ।
অতএব তথা সবে করহ গমন”।।
তারপর সকলেই পদব্রজে ধীরে,
গমিলেন সেই স্থানে সরস্বতী তীরে।।
অতঃপর প্রস্তুত ভীম দুর্যোধন।
বৃষবৎ দোঁহে তাঁরা করেন গর্জন।।
বাগযুদ্ধ দোঁহাকার চলে কিছু ক্ষণ।
তারপর গদাযুদ্ধে শুরু মহারণ।।
দুই বীর ক্ষিপ্র অতি রণে তৎপর ।
খুঁজিয়া ছিদ্র হানেন তাঁরা পরস্পর।।
বিচিত্র গতিতে চলে দোঁহাকার রণ।
কভু অগ্রে কভু পিছে কভুবা লম্ফন।।
চক্রাকার পথে তাঁরা করেন গমন।
হেনরূপে চলে নানা কৌশলে দ্বৈরণ।।
সুকৌশলে দুর্যোধন গদা দিয়া তাঁর,
ভীমসেন-শিরোপরি করেন প্রহার।।
ভীমসেন অবিচল সেই গদাঘাতে।
হইলেন তৎপর তিনি প্রত্যাঘাতে।।
ক্ষীপ্রগতি দুর্যোধন ত্বরিতে তফাতে।
ভীমসেন ব্যর্থ তাই তাঁহারে আঘাতে।।
অতঃপর দুর্যোধন ত্বরিত গতিতে,
হানেন আঘাত ভীমে তাঁহারে বধিতে।।
প্রহারে মূর্ছিতপ্রায় হন ভীমসেন।
পরক্ষণে দুর্যোধনে আঘাত হানেন।।
কিছু ক্ষণ দুর্যোধন আঘাতে বিহ্বল।
তারপর ভীমে ভূমে ফেলিতে সফল।।
সাথে সাথে ভীমসেন তাঁর বাহুবলে,
মহাতেজে দুর্যোধনে দেন ঠেলে ফেলে।।
হেনরূপে বহুক্ষণ চলে সেই রণ।
ক্ষতবিক্ষত আঘাতে তবু না পতন।।

শ্রীকৃষ্ণ নিজ ঊরুতে আঘাতে তখন,
ইঙ্গিতে ঊরুতে ঘাত হানিবারে কন।।
ইঙ্গিতে লভিয়া শিক্ষা ভীম সেই ক্ষণে,
ঊরুতে হানিতে ঘাত পণ মনে মনে।।
মহাবেগে সেই স্থলে করেন প্রহার।
দুর্যোধন ভগ্নঊরু পতন তাঁহার।।

ধূলাবৃষ্টি রক্তবৃষ্টি হইল তখন।
পিশাচেরা করে নৃত্য ঘোর দরশন।।
ভীমসেন কহিলেন করি ভর্ৎসনা,
নেই মোদের শঠতা কিম্বা প্রবঞ্চনা।।
চাহি না মানবে কভু পোড়াতে অনলে।
শত্রুদের করি জয় বুদ্ধি বাহুবলে।।
শঠ প্রবঞ্চক তুমি ওহে দুর্যোধন ।
উচিত শাস্তি আরও করহ গ্রহণ।।
হেন কহি মাথা তাঁর চরণে দলন।
অট্টহাস্যে ভীমসেন পুলকিত মন।।

সকলেই ক্ষুব্ধ তাঁর হেন আচরণে।
ধিক্কার দিলেন ভীমে উপস্থিত জনে।।
কহিলেন যুধিষ্ঠির ছাড় এইবার।
শিরোপরি পদাঘাত কভু নয় আর।।
সৎ বা অসৎ পথে জিনিয়াছ রণ।
ক্ষান্ত হও, প্রতিজ্ঞাও হয়েছে পূরণ।।
হতপ্রায় দুর্যোধন কুরু অধিপতি।
আমাদের ভাই তিনি আমাদের জ্ঞাতি।।
উচিত নহে তাঁহারে চরণে দলন।
উপহাস নয়, শোক করহ পালন।।
নিহত এনার যত ভ্রাতা পুত্রগণ।
লুপ্ত পিণ্ড,শান্তি হারা আত্মা সর্বক্ষণ।।
তারপর সাশ্রু কণ্ঠে দুর্যোধনে কন,
পূর্বকৃত কর্মফল লভিলে এখন।।
বধিলাম জ্ঞাতি ভ্রাতা তব অপরাধে।
তার লাগি আজ তাই মন মোর কাঁদে।।
ক্ষত্রোচিত শ্লাঘ্য মৃত্যু লভিছ এখন।
তারপর যোগ্যলোকে করিবে গমন।।
আজ আর কেহ নাই কোন প্রিয়জন।
তাই মোরা দীন ভাবে যাপিব জীবন।।
★★★
[ সমাপ্ত ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *