Spread the love

জয়

খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

এমনই যে একটা কিছু ঘটতে পারে সেটা অনুমান করেছিলেন অধ্যাপক সিদ্দিকি। প্রায় দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়িয়ে আসছেন। পড়িয়ে আসছেন মার্কস্‌বাদ-লেনিনবাদ। সমাজবিবর্তনের ইতিহাসে কারা দলিত, তা তাঁর জানা। বিত্তবানদের হাতে বিত্তহীনরা কীভাবে সেই দাসত্বপ্রথার যুগ থেকেই দলিত নিষ্পেষিত হয়ে আসছে, সেই বৈজ্ঞানিক সত্যটি তাঁর মর্মে মর্মে গাঁথা।

তিনি এটাও জানেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে সদ্য স্বাধীন দেশগুলিতে শোষিত মানুষের ঐক্যকে ভাঙ্গবার জন্য চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়কে শিখণ্ডী হিসাবে রেখে সি. আই. এর মদতপুষ্ট বুদ্ধিজীবিরা সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার নামে ধর্ম, বর্ণ (Colour), জাতপাত ইত্যাদির দৃষ্টিকোণে, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাজনীতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ফলে মানবজীবনের সর্বস্তরে বিভাজনী বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারই একটি অঙ্গ হিসবে তথাকথিত দলিত সাহিত্য, দলিত সংস্কৃতি, ইত্যাদির চর্চা শুরু হয়েছে। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এযাবৎকাল যাঁরা সেই বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, নজরুল, তারাশঙ্কর, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জসিমউদ্দিন প্রমুখরা দলিত-নিষ্পেষিত মানুষদের জীবনের উপর আলোকপাত করেছেন, তাঁদের সেই অবদানকে সংকীর্ণ জাতপাত বা ধর্ম ইত্যাদি কারণে উপেক্ষা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে তাঁরা নাকি দলিত সাহিত্যিক নন। দলিত সাহিত্যিকদের নামের তালিকা ঠিক হচ্ছে SC/ST/OBC উপাধি দেখে, তা সেই লেখক বণিক শ্রেনীর পক্ষে হলেও সাত খুন মাফ।

এই প্রক্রিয়ারই যে একটা অংশ হোল এ রাজ্যে তথা এদেশে তথাকথিত দলিত সাহিত্য-সংস্কৃতি মঞ্চ, এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু স্ত্রী রসিদা বেগমকে এটা বোঝাতে পারেননি। তাই যখন শুনলেন যে বারাসাত রবীন্দ্রভবনে ঐ মঞ্চ দলিত সাহিত্যিকদের একটা চিত্র প্রদর্শনী করছে, তখন তিনি স্বামীর কাছে বাহানা শুরু করে দিলেন যে মেয়ে শবনম ঐ প্রদর্শনীতে তার আঁকা নিয়মমাফিক পাঁচখানা ছবি দেবে। প্রফেসর সিদ্দিকী আপত্তি করলেন না। বললেন–

–বেশ দেখো।

Amazon Products

দলিত মানুষদের জীবন নিয়ে লিখেছেন, তাদের পাশে থেকেছেন, এই রকম পাঁচ জন কবি সাহিত্যিকের ছবি ও সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা লিখে মেয়ে তৈরী হোল: বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল, সুকান্ত, তারাশঙ্কর, জসিমউদ্দিন। এছাড়া শরৎচন্দ্র ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি: নীচে, ফুট নোটে ”অভাগীর স্বর্গ:” “পদ্মানদীর মাঝি”। আর উপরে উল্লিখিত সাহিত্যিকদের ছবির নীচে লেখা হোল যথাক্রমে সাঁওতাল জনজাতি ও বিদ্যাসাগর, বিষের বাঁশী/অগ্নিবীণা, ছাড়পত্র/রাণার, অগ্রদানী, নকশী কাঁথার মাঠ/রূপাই ও সাজু।

কিন্তু কিছুক্ষণবাদে, ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এলো শবণম।

–কি রে? ফিরে এলি?

–মা। ওঁরা বললেন বিদ্যাসাগর সহ যে সাতজনের ছবি আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, এঁরা কেউই দলিত সাহিত্যিক নন। ওঁরা বর্ণ হিন্দু, উচ্চ জাতের মুসলিম। নীচু তলার ওঁরা কেউ নন। 

–তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে না বেগম সাহেবা। এখন বুঝলে তো? 

–তাইতো দেখছি! এতো সাংঘাতিক ব্যাপার।

–সাংঘাতিক মানে, ভয়ঙ্কর রকমের সাংঘাতিক ব্যাপার। তুমি তো ইতিহাসের অধ্যাপিকা। গান্ধীজীর আন্দোলনের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে জাতপাতের রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষমাহীনভাবে লড়েছেন গান্ধীজী ও তাঁর দুই সেনাপতি সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গফুর খান ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। 

একটু থেমে উনি বললেন 

–রসিদা, ১৯৩০-৩২ -এর লণ্ডন বৈঠকের কথা মনে করে দেখো। গান্ধীজী এই বৈঠকে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন। কিন্তু, জিন্না ও আম্বেদকর গান্ধীজীকে শর্ত দিয়েছিলেন যে তিনি যদি মুসলিমদের জন্য ও অনুন্নত শ্রেনীর লোকদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার দাবী মেনে নেন, তাহলে তাঁরা দু’জনে তাঁর স্বাধীনতার দাবীকে সমর্থন করবেন। একজন দায়িত্বশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতা হিসাবে গান্ধীজী ওঁদের দাবী মানেননি। তিনি বলেছিলেন যে সর্বোদয় অর্থাৎ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণ তিনি চান। কোন বিশেষ ধর্মীয় বা বর্ণগত গোষ্ঠীর কল্যাণ বা বিশেষ সুযোগ সুবিধা আদায় তিনি চান না। ইংরেজরা এই মতভেদের পূর্ণ সুযোগ নেয়। গোলটেবিল বৈঠক ভেস্তে যায়। আম্বেদকরও জিন্নার বিরোধীতায় গান্ধীজীর পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। তার পথটা তো তোমার সবটা জানা। ব্রিটিশ সামাজ্যবাদীর মদতে জিন্না পাকিস্থানের দাবি আদায় করে নিলেন। মন ভেঙ্গে গেল গান্ধীজী, আজাদ, প্রমুখদের তার উপর খুন হয়ে গেলেন গান্ধীজী। এই পরিস্থিতির জটিলতার মধ্যে গণপরিষদে আম্বেদকর প্রস্তাবিত তথাকথিত অনুন্নত শ্রেনীর লোকদের জন্য সংরক্ষণের সুপারিশ পাশ হয়ে গেল: তপশীল জাতি উপজাতির তালিকা তৈরি হোল। এসব হোল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ -এর ঘটনা। আর ঠিক এরই অব্যবহিত পরে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হোল সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণার নামে ঐ ষড়যন্ত্র। রশিদা, এ সবেরই মিথক্রিয়া হোল ঐ তথাকথিত দলিত সাহিত্য, দলিত সংস্কৃতি, দলিত রাজনীতি, ইত্যাদির ওকালতি।

একটু থেমে প্রফেসার সাহেব বললেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে শ্রেনী তো দুটো: দলিত শ্রেনী, আর দলনকারী শ্রেনী: এই বিভাজনের ভিত্তি হোল অর্থনৈতিক ভিত্তি। জাতিগত, ধর্মগত, ইত্যাদি ভিত্তির তত্ত্ব হোল, unscientific unhistoric, absurd and nonsense। কি বিদ্যাসাগর, কি নজরুল, কি তারাশঙ্কর, কি জসিমউদ্দিন এঁরা সবাই তো প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এই অর্থনৈতিক বিভাজনের দৃষ্টিতেই নিষ্পেষিত মানুষদের, শ্রমজীবি মানুষদের, সুখ, দুঃখ, হাসিকান্না, জীবনযন্ত্রণাকে উপজীব্য করেই সাহিত্য রচনা করেছেন। এঁরা দলিত সাহিত্যিক নন তো দলিত সাহিত্যিক কারা? এঁদের নামের আগে পরে কাজী, সৈয়দ, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় আছে বলে আভাগী–কাঙালী চরণ–আমেনাদের কথা লিখলেও বুঝি এরা দলিত সাহিত্যের পুরোধা নন? SC তালিকা ভিত্তিক উপাধি যাদের নামের পাশে আছে, তারা শোষক শ্রেনীর তাঁবেদারী করলেও বুঝি তারা দলিত সাহিত্যের প্রবক্তা? এটা কখনোই হতে পারে না। এ প্রবণতার বিনাশ হবেই, জাতি ধর্ম উপাধি নির্বিশেষে যাঁরা শ্রমজীবি মানুষদের জীবন নিয়ে সাহিত্য করেছেন, করছেন ও করবেন, তাঁরাই প্রকৃত দলিত সাহিত্যের কাণ্ডারী, তাঁদের জয় অবশ্যম্ভাবী।

একটু এগিয়ে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সিদ্দিকী সাহেব বললেন-মন খারাপ করিস না মা। তোর এই সাধনার স্বীকৃতি তুই পাবিই পাবি: তুই যাঁদের ছবি নিয়ে গিয়েছিলি এঁকে, ওঁরা দলিত সাহিত্যের অগ্রনী সেনাপতি।

পদবি দেখে নয়, কাজী, সৈয়দ, বিশ্বাস, নস্কর, বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় দেখে নয়, দলিত সাহিত্যের বিচার হবে জাত পাত, ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে, বিত্তবানদের দ্বারা বিত্তহীনদের শোষণ, বঞ্চনা-অত্যাচার-লাঞ্ছনার-প্রেক্ষাপটে। কাজেই এই দৃষ্টিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-জসিম উদ্দিনদের রচনা দলিত সাহিত্যের অঙ্গ: আবার ঠিক উল্টোটা হলে কোন বিশ্বাস, বর্মন বা নস্করের লেখা কিছুতেই দলিত সাহিত্য বলে বিবেচনা পাবে না। দলিত বিচারের মাপকাঠি জাতি নয়, অর্থনীতি। 

ঠিক এই সময়েই পাশের বাড়ী থেকে ভেসে আসছে–

“দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে।” 

–ঐ শোন মা। প্রকৃত দলিত সাহিত্যের কর্ণধাররা, সুকান্ত-নজরুল-তারাশঙ্কর-জসিম উদ্দিনরা, অদৃশ্য সত্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, চিরকালই দাঁড়িয়ে থাকবেন গানের ওপারে। পিতা-পুত্রী মা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে, কানগুলো ভেসে আসা সুরের দিকে দিয়ে। 

লেখক পরিচিতি

অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

ঠিকানা-শরনিয়ার বাগান

পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯

পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *