Spread the love

শিউলির সুবাসে
খগেন্দ্রনাথ অধিকারী

দু’দিন বাদে মহালয়া। তাই নবারুণ সংঘের সভ্যরা আজ আলোচনায় বসেছেন কিভাবে সুষ্ঠুভাবে ক্লাবের এই শারদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। পূজো কমিটির তথা ক্লাবের সভাপতি হলেন দ্বিজেন সেন। তাঁর গোটা বাড়ী এখন ফাঁকা। তাই একাকীত্ব কাটাতে জামাই বাবুর সঙ্গে এই সভায় দর্শক ও শ্রোতা হিসাবে এসেছেন তাঁর শ্যালক অমিতাভ দাশগুপ্ত। প্রয়াতদের প্রতি এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সভার কাজ শুরু হোল। সম্পাদক আরশাদ কাদেরী সভাপতির প্রস্তাব মতো তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পেশ করলেন–
প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান একটি ব্যতিক্রমিক সংগঠন। দুর্গাপূজো, শ্যামাপূজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী অনেক ক্লাবেই হয়, কিন্তু আমাদের মতো বোধ হয় কেউই রক্তদান শিবির, বস্ত্রদান, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা পালন ইত্যাদির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা ও সহবস্থানের স্বার্থে শারদীয়া দুর্গোৎসব, ঈদ ও বিজয়া সম্মেলনী, বুদ্ধজয়ন্তী, বড়দিন উদ্‌যাপন ইত্যাদি করে না। আমরা এগুলি করি — ভবিষ্যতেও কোরবো। আমাদের immediate সামনে হচ্ছে দুর্গা পূজো, সেটা এই মাসে, অর্থাৎ অক্টোবরে। পরের মাস নভেম্বরে ইদল ফেতর, ডিসেম্বরে বড় দিন। বুদ্ধ জয়ন্তী বেশ পরে। আমি আপাততঃ দুর্গাপূজো–ঈদ ও খৃষ্টমাস উৎসবের একটা বাজেট আপনাদের সামনে রাখছি; পরের সভায় বুদ্ধজয়ন্তীর বাজেট রাখবো।
কাদেরী সাহেব তিনটি পর্বের জন্য বাজেট রাখলেন। বিস্তারিত আলোচনার পর তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হলো।
সভাপতিকে ধন্যবাদজ্ঞাপন ভাষনে সহঃসম্পাদক সঞ্জীব যোসেফ জানালেন, আসকারিদা ঠিকই বলেছেন যে আমাদের এই নবারুণ সংঘ সত্যিই এক ব্যতিক্রমিক প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় দিক দিয়ে দ্বিজেন দা হিন্দু, আসকারী দা মুসলিম, আমি খৃষ্টান, আমাদের সহ সভাপতি দীপঙ্কর দা বৌদ্ধ। কিন্তু, আমরা এখানে একটি সুখের সংসারের অংশীদার। এই সংসারকে আমরা প্রতিটি উৎসব ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অটুট রাখবো, অটুট রাখবো আমরা শারদ উৎসব ও পরবর্তী অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে। সভা শেষে শ্যালা ভগ্নিপতি বাড়ী এসে হাত পা ধূয়ে চায়ের টেবিলে বসলেন।
–কেমন লাগলো শ্যালাভাই আমাদের মিটিং?
–জামাইবাবু! অনবদ্য! অসাধারণ।
–তাহলে?
–সত্যি বলতে কি জামাইবাবু, বেশ কিছুদিন ধরে খুবই depression-এ ভুগছিলাম।
–কেন ভাই, কেন?
–এই দেখুন, রোজ টিভিতে ও কাগজে দেখছি ধর্মের নামে, জাতপাতেরন নামে মানুষ খুন। আমাদের দেশ অশোক–আকবরের মাটিতে মৌলবাদী হিন্দুরা অহিন্দুদেরকে, — রেঙ্গুনে বৌদ্ধ জঙ্গীবাদীরা মুসলিম হবার অপরাধে রোহিঙ্গা শরনার্থীদেরকে, আফগানিস্থান, সিরিয়া ইত্যাদি দেশে মুসলিম মৌলবাদীরা অমুসলিমদেরকে খুন করে শকুন শকুনীর মত নর মাংসের উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে আছে। মণিপুরে খৃষ্টান আধিপত্যবাদ কুকি ও মেইতিতের জাতি দাঙ্গার মূল কুচক্রী। গোটা উত্তরপূর্ব ভারতে এরা খৃষ্টান আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং ভারত থেকে এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। কি হোল কবিগুরুর “সু্ন্দর ভুবন”-এর হাল? কি হোল “সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি”-র দশা? স্বাধীনতা লাভের পৌনে এক শতাব্দী পরে কোথায় আছে ভারত আজ? চন্দ্র অভিযানের যুগে কোথায় আছে আমাদের সসাগরা ধরিত্রী? তাই জামাইবাবু খুব Mental Depression-এ ছিলাম। কিন্তু এখন . . .
–এখন কি ভাই অমিত?
–এখন আপনাদের ক্লাবের ঐ মিটিংয়ে গিয়ে নতুন প্রাণবায়ু পেয়েছি; আমার খুব ভালো লেগেছে জামাইবাবু; নতুন ভরসা জেগেছে মনে; ফাটল ধরা বিশ্বাসে আবার জোড় লেগেছে, উদাত্তকণ্ঠে বলার হিম্মৎ জেন্মেছে যে, না, মৌলবাদ শেষ কথা বলবে না, শেষ কথা বলবে মানবতাবাদ, শেষ কথা বলবে নাজিম হিকমৎ, আব্দুল গফুর খান, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ–গান্ধীজী, প্রেমচাঁদ–নজরুলের আদর্শবাদ। বলবে বাল্মিকী–হোমার–মীর্জাগালিব–রাসলের মানবতাবাদ।
শরতের সন্ধ্যা। বাইরে বাগানে অনেক ফুল আছে ফুটে। জানলা দিয়ে একটা মিষ্টি বাতাস ঢুকে পড়লো ভিতরে। গোটা ঘর ভরে ওঠে শিউলির সুবাসে, ভেসে যান শ্যালক-জামাইবাবু তার অদৃশ্য স্রোতে।
লেখক পরিচিতি
অধ্যাপক খগেন্দ্রনাথ অধিকারী রাষ্ট্রীয় বিদ্যাসরস্বতী পুরস্কার ও এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহু পুরস্কার প্রাপ্ত একজন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ। ইনি কোলকাতার সাউথ সিটি (দিবা) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।
ঠিকানা-
পোষ্ট-টাকী, পিন-৭৪৩৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *